প্রধানমন্ত্রীর সফর-মিয়ানমার: পূর্বযাত্রা শুভ হোক by ফারুক ওয়াসিফ

মরা যেন ভুলেই থাকি, পূর্ব বলে একটা দিক আছে, এবং সেই দিকে মায়ানমার নামে এক দেশ আছে। পূর্ব সীমান্তের সেই দেশটি এখন কিছুটা শান্ত। গত মার্চ মাসে সেখানে থিন সেনের নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। যদিও রেঙ্গুনে চুটকি চলে: এক বিদেশি বলছে স্থানীয়কে, ‘জেনারেলরা দেখছি উর্দি ছেড়েছে?’ স্থানীয়র উত্তর, ‘জি, উর্দি ছেড়ে লুঙ্গি ধরেছে। তবে ওদের সবকিছুই উল্টো, বাইরে লুঙ্গি পরে থাকলেও ঘরে ওরা উর্দিই পরে।


’ উল্লেখ্য, লুঙ্গি মিয়ানমারের পুরুষদের জাতীয় পোশাক। মিয়ানমারের শাসকেরা এখন বাইরের জন্য সিভিল ইমেজ ঝোলালেও স্বদেশিদের জন্য বরাদ্দ ৫০ বছর পুরোনো সেনাশাসন, যদিও তা এখন কমজোরি এবং কিছুটা আপসপন্থী।
পোশাকের বদলটা তবু ফেলনা নয়। গত এক সপ্তাহের মিয়ানমারের হালচাল দেখে আনাড়ি লোকেরও তা বোঝার কথা। অভ্যর্থনা জানানোর বিউগল আর ড্রাম বাজাতে বাজাতে দেশটির সামরিক ব্যান্ড দল হয়রান। প্রথমে এলেন বেলারুশের প্রধানমন্ত্রী, তারপর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। তৃতীয় অতিথি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৪ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পর এটাই প্রথম কোনো বাংলাদেশি সরকারপ্রধানের মিয়ানমার সফর। ভৌগোলিকভাবে এত কাছের দেশ, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী সপ্তম রাষ্ট্র হয়েও মিয়ানমার কত দূরের। মাঝখানে সড়ক নেই, সেতু নেই, বিমান নেই, জাহাজ নেই; বাণিজ্যিক লেনদেনও অতি সামান্য। অথচ মধ্যযুগের আরাকান রাজসভায় বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল। আরাকানের কিছু অঞ্চল বাংলা অঞ্চলের অংশ বলেই সে সময় গণ্য হতো। একসময় রেঙ্গুন (এখনকার ইয়াঙ্গুন) ছিল অজস্র বাঙালির আত্ম প্রতিষ্ঠার শহর, কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ও তাঁদের একজন।
কেন হঠাৎ মিয়ানমার এত আগ্রহ কাড়ল? স্বৈরশাসন-বিরোধী আরব জাগরণ মিয়ানমারের একনায়কদের ভীত করে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওবামা প্রশাসন চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে এশিয়ায় আরও অবস্থান বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। তৃতীয়ত, ভারত-চীনের আঞ্চলিক পাল্লাপাল্লিও আগের তুলনায় বেড়েছে। চতুর্থত, মায়ানমারের নতুন সরকার একঘরে দশা কাটাতে চাইছে। অন্যরাও এই সুযোগটাই নিতে চাইছে। বাংলাদেশের জন্যও পুরোনো সমস্যা ও হাতছানি দেওয়া সম্ভাবনাগুলো বাজিয়ে দেখার এটাই সময়। শুভেচ্ছা সফর বলা হলেও, এই সফর তাই অনেক গুরুত্ববহ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, যে মিয়ানমারের শাসকেরা পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসন চালিয়ে আসছেন, যাঁরা অং সান সু চির নির্বাচনী বিজয় নস্যাৎ করে তাঁকে ১৫ বছর ধরে গৃহবন্দী রেখেছিলেন, অজস্র গণতান্ত্রিক কর্মীকে হত্যা করে, জাতিগত দমন-পীড়ন চালিয়ে এসেছে যারা, তাদের সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কটা ভালোবাসা বা ঘৃণার নয়, স্বার্থের সম্পর্ক। স্বার্থের লেনদেন ছাড়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক মানবতাবাদী রূপকথা মাত্র। রোহিঙ্গা সমস্যা মেটাতে হবে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিমি সীমান্তের স্থলভাগে কাঁটাতারের বেড়া, কিংবা বাংলাদেশের জলসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান করার মতো ঘটনাগুলোর সুরাহা যুদ্ধ করে হওয়ার নয়, তার জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ চাপ প্রয়োগই বেশি কার্যকর। মিয়ানমার আমেরিকার সমস্যা, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের এমন কিছু নেই, যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান অসম্ভব।
কিন্তু আমেরিকাও তো অবরোধ দিয়েও যোগাযোগ বন্ধ করেনি। দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্যও চলছে। যতক্ষণ সামরিক ও আর্থিক স্বার্থে ঘা না লাগে, ততক্ষণ পশ্চিমের মানবাধিকার অস্ত্র নীরব। তা না হলে গত দুই দশকে মায়ানমারে কত আরব জাগরণ, কত লিবীয় ‘বিদ্রোহ’ এল গেল, কত ছাত্র-ভিক্ষু আত্মাহুতি দিল, জাতিসংঘ বা ন্যাটো বিবৃতির বাইরে কিছু করল না।
মিয়ানমারের বিপুল গ্যাস-কাঠ-হীরাজহরত দরকার। দরকার মিয়ানমারে অস্ত্র বিক্রি করা। তাই মিয়ানমারকে লোকদেখানো শাসানির সময়ও ওবামার মনে থাকে, মার্কিন কোম্পানি শেভরন মিয়ানমারের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর বিরাট অংশের মালিক। ওই গ্যাস যে পাইপলাইনে রপ্তানি হয়, সেটাও বানিয়েছে মার্কিন হ্যালিবার্টন। ব্রিটিশ কাঠ ব্যবসায়ী অ্যাকুয়াটিক, মোটর নির্মাতা রোলস-রয়েস এবং পর্যটন কোম্পানি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ও আসিয়ান এক্সপ্লোরারের মতো অনেকের কারবার আছে মিয়ানমারে। ব্রিটেনের অস্ত্র বাণিজ্যের বাঁধা খরিদ্দার দেশটি। ফরাসি কোম্পানি টোটালও মিয়ানমারের গ্যাস সম্পদের অন্যতম ভাগিদার। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইসরায়েলও বাদ নেই। মিয়ানমারের কুখ্যাত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ তাদের হাত দিয়েই হয়।
তবে মিয়ানমারের প্রধান রক্ষক হলো চীন। চীন চায় মালাক্কা প্রণালি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার জ্বালানি সহজ পথে চীনে আনার জন্য মিয়ানমারের উপকূলে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌবন্দর। সেখানে তার বাজার আছে, রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃত্বও মোটামুটি একচেটিয়া। চীনের মদদ ছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিজ দেশকে এত দিন ধরে দখল করে রাখতে পারত না।
সম্প্রতি ভারতও সু চির প্রতি সমর্থন ছেড়ে সামরিক জান্তার সঙ্গে মিতালি পাতিয়েছে। জ্বালানি-ক্ষুধার্ত ভারত বাংলাদেশের গ্যাস না পেয়ে মিয়ানমারের দিকে ঝুঁকেছে। মিয়ানমারের গ্যাস বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পাইপলাইনে পাওয়ার ইচ্ছা তাদের। ভুললে চলবে না, ভারত ও চীনের মধ্যে বাফার হলো মিয়ানমার। এভাবে জনগণকে দারিদ্র্য ও অনাচারের গিট্টুতে বেঁধে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রকে খুশি রেখে চালিয়ে যাচ্ছেন মিয়ানমারের শাসকেরা। কিন্তু অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে, অচিরেই নির্বাচন দিতে হবে জান্তা সমর্থিত সরকারকে এবং সু চির ক্ষমতারোহণও বেশি দূরের ঘটনা নয়।
বাংলাদেশ ক্ষমতাবান নয়, কিন্তু বাংলাদেশেরও মিয়ানমারের কাছ থেকে পাওয়ার ও দেওয়ার আছে অনেক কিছু। দ্বিতীয়ত, ভারত-চীনের চাপের মধ্যে শ্বাস ফেলার একটা সুযোগ মিয়ানমারেরও দরকার। বাংলাদেশের ওষুধ, তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসহ হালকা শিল্পপণ্যের চাহিদা রয়েছে মিয়ানমারে। অন্যদিকে মিয়ানমার দিতে পারে চাল, গ্যাস ও জলবিদ্যুৎ। এসব ব্যাপারে শেখ হাসিনার সফরে আশ্বাস মিললেও সেগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়া দরকার। পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক টেনশন যত বাড়ছে, ততই আন্তর্জাতিক পাশা খেলায় আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গাদের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সম্পর্ক সাবলীল করার মাধ্যমে এই সমস্যারও আশু সমাধান জরুরি। সমুদ্রসীমা নিয়ে দ্বন্দ্বও দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক ভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা চালানো ছাড়া বিকল্প নেই। দুই দেশের বাণিজ্য-ঘাটতিও কম নয়। সেখান থেকে আসে প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ আমরা পাঠাই মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারের সামগ্রী।
এসবেরই সারমর্ম হলো, যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের দেখাদেখি পূর্বমুখী কূটনীতিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। সবাই বুঝে গেছে, সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বাড়বে। বিশ্ব অর্থনীতির অভিমুখ ইতিমধ্যে পূর্বমুখী হয়েছে। এ সময়ে বসে থাকার মানে হয় না।
২০০৪ সালে বিএনপির সরকার পূর্বমুখী কূটনীতি নিয়ে উচ্চবাচ্য করলেও কার্যত আলু বিক্রির বেশি কিছু হয়নি। ঝুলে পড়েছিল কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত এশীয় মহাসড়ক নির্মাণের বন্দোবস্ত। সেটা করা গেলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের মিয়ানমার হয়ে চীন তো বটেই, থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় যাতায়াত সুগম হবে।
সবই ভালো, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে গেলেন কিন্তু দেশটির অবিসংবাদী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে দেখা হল না! আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের বেলায় বিরোধী দলের সঙ্গেও বসা আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গ। আজ যিনি বিরোধী দলে, তিনি পরে সরকারে বসতে পারেন। বিরোধী দলের পক্ষেও থাকে দেশের অনেক মানুষ। এভাবে ক্ষমতার সব কেন্দ্রের সঙ্গেই কৌশলগত সম্পর্ক রাখা বুদ্ধিমান রাষ্ট্রনায়কের লক্ষণ। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সেনের চেয়ে সু চি কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নন। বর্তমান সরকার সামরিক বাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার। সু চি ও তাঁর দলই মিয়ানমারের ভবিষ্যতের প্রতিনিধি। তাঁর মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার বিষয়টি কেন সাধিত হলো না, সেই খেদ তাই রয়ে গেল।
পূর্বদিকে বাংলাদেশ সর্বদাই দ্বিধান্বিত থাকে কেন, সেটাও এক রহস্য। আরেকটি বিষয়ও শেখ হাসিনা খেয়াল করে থাকবেন, বৃহৎ প্রতিবেশী নিয়ে মিয়ানমারও পেরেশানির মধ্যে আছে। মিয়ানমারের প্রধান নদী ইরাবতিতে চীনের বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ক্রমবর্ধমান চীনা অভিবাসন, বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি ইত্যাদি কারণে মিয়ানমারের জনগণ চীনের প্রতি বিরূপ। জনমতের চাপে নতুন সরকার বিতর্কিত চীনা বাঁধ বাতিল ঘোষণা করেছে। এই ঘটনা থেকে আমাদেরও শেখার আছে অনেক কিছু।
বাংলাদেশের নতুন পূর্বযাত্রা শুভ হোক।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.