জননী সাহসিকা-কখনো বিচলিত হননি তিনি

প্রতি আমার মা... ...অকালে পিতৃহারা হওয়ার পর আমাদের আট ভাইকে মানুষ করতে গিয়ে অল্প বয়সে বৈধব্যের করুণ জ্বালাযন্ত্রণাকে বুকের গভীরে অবরুদ্ধ রেখে আমাদের অপত্য স্নেহ-আদর ভালবাসা দিয়ে আগলে রেখে যিনি বড় করেছেন, তার ঋণ শোধ হবার নয়। আমার এই বইটি সেই মহীয়সী নারী, আমার পরম শ্রদ্ধেয় মা নূরজাহান সিরাজীকে উৎসর্গ করলাম...


ফাহীম রেজা নূর এভাবে তাঁর মায়ের উদ্দেশে ভালোবাসা প্রকাশ করেন তাঁর রচিত একটি বইয়ে। ফাহীম নূর বলছেন, ‘নিজের দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর গোপন রেখে আমাদের কষ্ট মোছাতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থেকেছেন মা। দেড় বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন তিনি। আর বিয়ের পরে যে মানুষটি তাঁকে স্নেহ আর ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলেন, সেই মানুষটিকে হারান একাত্তর সালে।’
মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় ১৮ বছরের যুবক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে। সিরাজুদ্দীন হোসেনও সাড়ে তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান। এই দুজন মানুষ যখন এক হলেন তখন যেন তাঁরা হয়ে উঠলেন একে অপরের অবলম্বন। কিন্তু খুব বেশিদিন তা সইল না। ২০ বছরের সংসারজীবন শেষ হয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী এবং বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
‘একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর। আমরা তখন চামেলীবাগের বাসায় থাকি।’ বলছিলেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফাহীম রেজা। মায়ের ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে দেশে এসেছেন। তখন তিনি স্কুলপড়ুয়া এক কিশোর। ‘বেশ কদিন ধরেই এ আবাস ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আব্বার অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথাবার্তা চলছে। শেষ পর্যন্ত ৯ ডিসেম্বর তিনি যাবেন এমন কিছু একটা ঠিক হলো। কিন্তু ৯ তারিখ মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে নিয়ে যেতে এলে তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে চাইলেন। এরপর ঠিক হলো পরদিন ১০ তারিখ সবাই একসাথে যাওয়া হবে। কিন্তু ১০ তারিখ সব শেষ। রাত তিনটায় ঘাতকেরা ঢুকে পড়ে বাড়িতে। চিৎকার করে জানতে চায়, সিরাজুদ্দীন কৌন হ্যায়? আব্বা তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আমিই সিরাজুদ্দীন হোসেন। এরপর মুখে মাফলার পেঁচানো ঘাতকেরা ধরে নিয়ে যায় আব্বাকে।’ একনাগাড়ে বলতে বলতে থেমে যান ফাহীম।
একটু থেমে আবার বলেন, ‘আসলে আব্বা কখনো আমাদের ছেড়ে থাকতে চাইতেন না। নিজে তো এতিম হয়েছেন অল্প বয়সে। তাই নিজের ছেলেদের সারাক্ষণ আগলে রাখতে চাইতেন।’
‘জানেন, আমাদের বাসাটা ছিল একটা হাটের মতো। সব সময় মানুষ থাকত। আম্মা সবার জন্য সারা দিন রান্নাবাড়ায় ব্যস্ত থাকতেন। দাওয়াত ছাড়াই বাসায় প্রায়ই ১৫-২০ জনের রান্না হতো। আব্বার বেতনের বেশির ভাগ মানুষের সাহায্যে দান-খয়রাতে চলে যেত। আম্মাকে কোনো দিন দেখিনি বিরক্ত হতে। বরং হাসিমুখে এসব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কারণ এসবেই তাঁর স্বামীর শান্তি যে!’—বলেন ফাহীম নূর। কিন্তু সেই মানুষটা, যাকে ঘিরে থাকত অসংখ্য মানুষ, আব্বার এই আকস্মিক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন কয়েকটি শিশু নিয়ে তিনি ভীষণ একলা হয়ে গেছেন। কলেজপড়ুয়া বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধে। পরের ছেলেটিও সবে জগন্নাথ কলেজে পড়ছে। ফাহীম নূর স্কুলে যান।
‘৩২ বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পরে আমার মা আসলে আট ছেলে নিয়ে সংসারের এতটাই টানাপোড়েনে ছিলেন যে তাঁর ভেতরের কষ্টটা কেউ কোনো দিন প্রকাশ্যে দেখেনি। প্রচণ্ড কষ্ট আর মনোযাতনা নিয়ে এক একটা দিন পার করেছেন, কিন্তু কখনো ভাবাবেগে কিছুই ভেসে যেতে দেননি।’
এরপর বড় ছেলে শামীম, মেজ ছেলে শাহীন মায়ের পাশে দাঁড়ান। তাঁরা দুজনেই বড় এই সংসারে উপার্জনক্ষম মানুষ। শামীম একটি দোকান দিলেন বায়তুল মোকাররমে। শাহীন ইত্তেফাকে সাব-এডিটরের কাজ নিলেন। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের একটি বাসা ছিল, যেটি ভাড়া দিয়ে মাসে ৩৩০ টাকা পাওয়া যেত। এই দিয়ে এতবড় সংসার চালানো।
সেই বড় ছেলে এখন আমেরিকাতে। আরও দুই ছেলেও সেখানে। এক ছেলে ভারতে পিএইচডি করছেন। দুজন বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করছেন। প্রকৌশলী দুই ছেলের একজন একটি রিয়েল এস্টেট ফার্মে কাজ করছেন, অন্যজন দেখছেন একটি ফাস্ট ফুডের দোকান। এই হলো তাঁর আট ছেলের বর্তমান অবস্থা।
‘একদিকে চরম অর্থসংকট, অন্যদিকে মানসিক সহযোগিতা-সহমর্মিতার অভাব। তবুও নিজের ছেলেমেয়েদের যেন কোনো কষ্ট না হয় সব সময় সেদিকে সতর্ক থাকতেন আম্মা। তিনি নিজের দিকে কোনো দিন তাকাননি। তিনি শুধু মা নন, তিনি আমাদের বাবাও হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর একটি ছেলেও বিপথে চলে যায়নি। কী না দেখেছেন তাঁর একাত্তর বছরের জীবনে। সরকারের তরফ থেকে বাহাত্তরে দেওয়া বাড়িটি পরে একাশি সালে কেড়ে নেওয়া হলে একদিনের নোটিশে ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁকে নেমে যেতে হয়। তবু কখনো তিনি বিচলিত হননি। তাঁর এই অবিচল ব্যক্তিত্বের শক্তি যে তিনি কোথায় পেয়েছিলেন তা-ই ভাবি।’ বলেন পুত্র ফাহীম। তবে একটি বিষয়ে তিনি বিচলিত হন। তাঁর সেই ভরা হাটের মতো সব সময় সরগরম থাকা বাড়িটি এখন প্রায়ই ফাঁকা থাকে। ছেলেরা কর্ম ও প্রয়োজনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন দেশে ও দেশের বাইরে। তাঁরা, নাতি-নাতনিরা মাঝে-সাঝে এসে হইচই করেন বটে। তবে তাঁরা চলে যাওয়ারে পর যে নীরব-নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে তখন তাঁর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এই শূন্যতা তিনি নিতে পারেন না। পথ চেয়ে বসে থাকেন...যেভাবে একসময় বসে থাকতেন স্বামীর অপেক্ষায়...
শায়লা রুখসানা

No comments

Powered by Blogger.