থানার দারোগাই নেপথ্যনায়ক ও প্রধান ছায়া! by শামসুল আরেফিন খান
নরসিংদীর মনোহরদী এলাকার প্রধান শিক্ষক সিরাজ উদ্দিনকে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যার পেছনে শুধু বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে ট্রাক্টর চালাতে বাধা দেওয়াই কারণ নয়, গ্রামের পঞ্চায়েতের প্রধান হওয়ায় একটি ক্ষমতাবান প্রভাবশালী পরিবার তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণেও প্রধান শিক্ষককে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে_এ কথা বলেছেন মৃতের বড় ছেলে সালাউদ্দিন।
১১ আগস্ট ২০১১, বিকেলে মনোহরদীর চালাকচর ইউনিয়নের চরপাড়া এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিনকে প্রকাশ্যে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এটা দেশে বিরাজমান অরাজক পরিস্থিতির একটি হাল-নমুনা। এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির জনক শুধু যে একশ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল নাগরিক, যারা অহরহ আইন হাতে তুলে নেয়; যারা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত বা মাদকাসক্ত কিংবা যারা সব আমলে সরকারের খাস লোকের মুখোশ পরে দক্ষযজ্ঞে লিপ্ত হয়, তা নয়, ইউনিফর্মধারী পুলিশও। যাদের হওয়ার কথা জনগণের সেবক, যাদের পূর্বসূরি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কাতারের শহীদ, কষ্টার্জিত দেশের গরিব মানুষের মুখের খোরাক কেড়ে নিয়ে যাদের প্রতিপালন করা হয়, সেই পুলিশ রক্ষক না হয়ে ভক্ষকে পরিণত হলে, সেই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রের পায়ে চাপাতির ধার পরীক্ষা করলে, নিরীহ তরুণকে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঢালাও হুকুম দিলে দেশের মুখচিত্র যা হওয়া উচিত, তাই পরিস্ফুট হয়েছে এসব দৃশ্যে।
একাত্তরে পাকিস্তানি দস্যুরা বহু নাদান শিশুকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলের মতো উপরে ছুড়ে দিয়ে বন্দুকের নিশানা পরীক্ষা করেছিল। মা-বাবার চোখের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছিল। বাবার সামনে সন্তানকে, সন্তানের সামনে মা-বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে বর্বরতা ও নৃশংসতার লোমহর্ষক রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল এই বাংলার নরম মাটিতে।
ছদ্মবেশী পাকিস্তানি কুইসলিং তথা অনুচররা ১৫ আগস্ট '৭৫ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করল। খুন হলেন বেগম মুজিব, শিশু রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা কামাল, শেখ জামাল, বঙ্গপিতার দুই পুত্রবধূ, ভাই শেখ নাসের, ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ মণি ও ব্রিগেডিয়ার জামিলসহ আরো অনেকে। ৩ নভেম্বর '৭৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে খুন হলেন চার জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। ইতিহাসের ট্রোজান হর্সে লুকিয়ে থাকা ২১ বিশ্বাসঘাতক ও তাদের খলনায়ক রাষ্ট্রপিতার রক্তাক্ত লাশ অবহেলায় অনাচ্ছাদিত রেখে, জানাজা না পড়ে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করে, মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শপথ বাক্য পাঠ করল। প্রধান সেনাপতি নির্বিকার ছিলেন ১৫ আগস্ট। রাষ্ট্রপ্রধানকে বাঁচানোর জন্য ব্রিগেডিয়ার জামিলের মতো ছুটে আসেননি। নিজের তুচ্ছ প্রাণ বাঁচিয়েছেন। উপপ্রধান সেনাপতি, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, ক্ষৌর কাজ না থামিয়ে ভগ্ন দূতকে বলেছিলেন (সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারাহাসের বিবরণে) "চৎবংরফবহঃ রং করষষবফ, ঝড় যিধঃ, ঠরপব চৎবংরফবহঃ রং ঃযবৎব!" পাথরের মতো নিথর সেই নির্বিকার মানুষটির ভক্ত-অনুসারীরা এখন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে তিনি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করতেন বলেই অমন উক্তি করেছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ছিল ব্যাপক ও সর্বাত্মক অংশগ্রহণ। দুর্বিনীত ছাত্ররা গেরিলা যুদ্ধে অতুলনীয় ও অনন্যভূমিকা রেখেছিল। যুবসমাজ, তরুণ, কৃষক-শ্রমিক ছিল তাদের যোগ্য দোসর। লন্ডনের দি অবজারভার পত্রিকার ঢাকাস্থ সংবাদদাতার ভাষ্য অনুযায়ী ১ মার্চ ১৯৭১ বেসামরিক জনতার প্রাণ আহূতির সংখ্যা ছিল দুই হাজার। পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষের নিজেদের স্বীকৃতিতেই রয়েছে ১৭২ জনের প্রাণহানির কথা। ৩ মার্চ ঢাকাবাসী কারফিউ ভেঙে অগণিত প্রাণ উৎসর্গ করল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে থৈ থৈ জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আগ্রাসী পাঞ্জাবি সৈন্যদের মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল সম্পন্ন করল। 'বাঙালি সৈনিকদের অস্ত্রচ্যুত করা হয়েছে' বলে আমার সংগৃহীত সরেজমিন বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন সংবাদ সংস্থা 'এনা' প্রচার করল দেশে-বিদেশে। রেডিও পাকিস্তান একনাগাড়ে ২৪ ঘণ্টা প্রতিবাদ জানাল। 'ইয়ে সারাসার ঝুট হ্যায়_বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট'। আমি পড়লাম হুলিয়ার মুখে। প্রাণরক্ষায় সপরিবারে দেশত্যাগ করে যথাসময় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হলাম।
২৫ মার্চ মধ্যযামিনী অতিক্রান্ত হওয়া মাত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খ্যাত এম-২৪ মার্কিন ট্যাংক সজ্জিত হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সশস্ত্র প্রতিরোধ প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার আগেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর।
৩০ মার্চ লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখল CAUGHT COMPLETELY BY SURPRISE SOME 200 STUDENTS WERE KILLED IN IQBAL HALL, HEAD QTS. OF THE MILITANTLY ANTI GOVT. STUDENTS UNION, AS SHELLS SLAMMED INTO THE BUILDING AND THEIR ROOMS WERE SPRAYED WITH MACHINE GUN FIRE.. কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলিবৃষ্টিতে সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্রদের প্রধান ঘাঁটি ইকবাল হল বিধ্বস্ত হলো। ২০০ ছাত্র সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রাণ হারালো। এরপর যুদ্ধ শুরু হওয়ার কি কিছু বাকি থাকে? নাকি কোনো বংশীবাদকের অপেক্ষায় থাকতে হয়? বলুন পাঠক। মুক্তিযুদ্ধ সূচনাকারী কে বা কারা তা নিয়ে গবেষণা করে সন্দর্ভ ফাঁদার কোনো অবকাশ থাকে কি?
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা অস্বীকার করা মতো মূর্খতা বা শঠতাও আর কিছু হতে পারে না। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর এককালীন চৌকস অফিসার মেজর জিয়ার খ্যাতি ছিল ১৯৬৫ যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে বীরত্বের। তখন তিনি ক্যাপ্টেন। ২৫ মার্চ রাতের প্রথমাংশে মেজর জিয়া যাচ্ছিলেন সোয়াত জাহাজ থেকে গণহত্যার অস্ত্র খালাস করতে। পথিমধ্যে গোপন মেসেজ পেয়ে প্রস্থান করেন। সে সময় তিনি ছিলেন কর্নেল জানজুয়ারের সেকেন্ড ইন কমান্ড। খ্যাতিমান বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রামে অবাঙালি হত্যার অনভিপ্রেত এক আকস্মিক ঘটনার জের ধরে প্রত্যাহার করা হয়। কর্নেল জানজুয়ার তার স্থলে কমান্ডিং অফিসার এবং মেজর জিয়া সেকেন্ড ইন কমান্ড নিযুক্ত হন। মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পুনঃ প্রচারে কণ্ঠ দিয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য ইতিহাসের সালাম পেয়েছেন। তিনি নিজে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত অনুসারীরা ফুটন্ত পানিতে ভেজে ঘিয়ে ভাজা জিলাপির স্বাদ নিতে চান। সে কারণেই তাঁদের এত গবেষণা, এত সন্দর্ভ রচনার কসরত। জনতা জাগতে শুরু করেছে। তারা রংপুরে গোপন হত্যার শিকার জনৈক লুৎফর রহমানের লাশ বিদ্যুতের খাম্বায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছে। সন্ধানে জেনেছে, থানার একজন কর্তব্যরত দারোগাই এই খুনের নেপথ্য নায়ক এবং 'মূল ছায়া'। তদন্তে এসেছিল এক দারোগা এবং কয়েক সিপাই। রুদ্র জনতা দিয়েছে তাদের আচ্ছামতো গণধোলাই। এসবের মাজেজা বুঝলাম। কিন্তু বুঝলাম না মহাজোট সরকারের দুই প্রবীণ ও আধা প্রবীণ বেসামরিক ও সামরিক আমলামন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত 'আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে' কিংবা 'রুটি নেই তাতে কি, ক্ষুধার্ত মানুষ কেক খায় না কেন?' জাতীয় বিভ্রান্ত দিশেহারা ঐতিহাসিক সংলাপের শানেনুজুল। সড়ক দুর্ঘটনায় একাত্তরের ঘাতক দালালদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার দুই প্রধান সাক্ষী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও শহীদ-তনয় আশফাক মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জনগণ এখন বলতে শুরু করেছে, এরপর যোগাযোগমন্ত্রী কী বলবেন, আপনারা রাস্তায় বের হন কেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
একাত্তরে পাকিস্তানি দস্যুরা বহু নাদান শিশুকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলের মতো উপরে ছুড়ে দিয়ে বন্দুকের নিশানা পরীক্ষা করেছিল। মা-বাবার চোখের সামনে মেয়েকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছিল। বাবার সামনে সন্তানকে, সন্তানের সামনে মা-বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে বর্বরতা ও নৃশংসতার লোমহর্ষক রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল এই বাংলার নরম মাটিতে।
ছদ্মবেশী পাকিস্তানি কুইসলিং তথা অনুচররা ১৫ আগস্ট '৭৫ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করল। খুন হলেন বেগম মুজিব, শিশু রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা কামাল, শেখ জামাল, বঙ্গপিতার দুই পুত্রবধূ, ভাই শেখ নাসের, ভগি্নপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ মণি ও ব্রিগেডিয়ার জামিলসহ আরো অনেকে। ৩ নভেম্বর '৭৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে খুন হলেন চার জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। ইতিহাসের ট্রোজান হর্সে লুকিয়ে থাকা ২১ বিশ্বাসঘাতক ও তাদের খলনায়ক রাষ্ট্রপিতার রক্তাক্ত লাশ অবহেলায় অনাচ্ছাদিত রেখে, জানাজা না পড়ে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করে, মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শপথ বাক্য পাঠ করল। প্রধান সেনাপতি নির্বিকার ছিলেন ১৫ আগস্ট। রাষ্ট্রপ্রধানকে বাঁচানোর জন্য ব্রিগেডিয়ার জামিলের মতো ছুটে আসেননি। নিজের তুচ্ছ প্রাণ বাঁচিয়েছেন। উপপ্রধান সেনাপতি, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার, ক্ষৌর কাজ না থামিয়ে ভগ্ন দূতকে বলেছিলেন (সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারাহাসের বিবরণে) "চৎবংরফবহঃ রং করষষবফ, ঝড় যিধঃ, ঠরপব চৎবংরফবহঃ রং ঃযবৎব!" পাথরের মতো নিথর সেই নির্বিকার মানুষটির ভক্ত-অনুসারীরা এখন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে তিনি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করতেন বলেই অমন উক্তি করেছিলেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ছিল ব্যাপক ও সর্বাত্মক অংশগ্রহণ। দুর্বিনীত ছাত্ররা গেরিলা যুদ্ধে অতুলনীয় ও অনন্যভূমিকা রেখেছিল। যুবসমাজ, তরুণ, কৃষক-শ্রমিক ছিল তাদের যোগ্য দোসর। লন্ডনের দি অবজারভার পত্রিকার ঢাকাস্থ সংবাদদাতার ভাষ্য অনুযায়ী ১ মার্চ ১৯৭১ বেসামরিক জনতার প্রাণ আহূতির সংখ্যা ছিল দুই হাজার। পাকিস্তান সেনা কর্তৃপক্ষের নিজেদের স্বীকৃতিতেই রয়েছে ১৭২ জনের প্রাণহানির কথা। ৩ মার্চ ঢাকাবাসী কারফিউ ভেঙে অগণিত প্রাণ উৎসর্গ করল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে থৈ থৈ জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বললেন, 'ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল... এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।' ১৯ মার্চ জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টের বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আগ্রাসী পাঞ্জাবি সৈন্যদের মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল সম্পন্ন করল। 'বাঙালি সৈনিকদের অস্ত্রচ্যুত করা হয়েছে' বলে আমার সংগৃহীত সরেজমিন বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন সংবাদ সংস্থা 'এনা' প্রচার করল দেশে-বিদেশে। রেডিও পাকিস্তান একনাগাড়ে ২৪ ঘণ্টা প্রতিবাদ জানাল। 'ইয়ে সারাসার ঝুট হ্যায়_বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট'। আমি পড়লাম হুলিয়ার মুখে। প্রাণরক্ষায় সপরিবারে দেশত্যাগ করে যথাসময় মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হলাম।
২৫ মার্চ মধ্যযামিনী অতিক্রান্ত হওয়া মাত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খ্যাত এম-২৪ মার্কিন ট্যাংক সজ্জিত হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সশস্ত্র প্রতিরোধ প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার আগেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর।
৩০ মার্চ লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখল CAUGHT COMPLETELY BY SURPRISE SOME 200 STUDENTS WERE KILLED IN IQBAL HALL, HEAD QTS. OF THE MILITANTLY ANTI GOVT. STUDENTS UNION, AS SHELLS SLAMMED INTO THE BUILDING AND THEIR ROOMS WERE SPRAYED WITH MACHINE GUN FIRE.. কামানের গোলা আর মেশিনগানের গুলিবৃষ্টিতে সরকারবিরোধী জঙ্গি ছাত্রদের প্রধান ঘাঁটি ইকবাল হল বিধ্বস্ত হলো। ২০০ ছাত্র সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় প্রাণ হারালো। এরপর যুদ্ধ শুরু হওয়ার কি কিছু বাকি থাকে? নাকি কোনো বংশীবাদকের অপেক্ষায় থাকতে হয়? বলুন পাঠক। মুক্তিযুদ্ধ সূচনাকারী কে বা কারা তা নিয়ে গবেষণা করে সন্দর্ভ ফাঁদার কোনো অবকাশ থাকে কি?
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা অস্বীকার করা মতো মূর্খতা বা শঠতাও আর কিছু হতে পারে না। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর এককালীন চৌকস অফিসার মেজর জিয়ার খ্যাতি ছিল ১৯৬৫ যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে বীরত্বের। তখন তিনি ক্যাপ্টেন। ২৫ মার্চ রাতের প্রথমাংশে মেজর জিয়া যাচ্ছিলেন সোয়াত জাহাজ থেকে গণহত্যার অস্ত্র খালাস করতে। পথিমধ্যে গোপন মেসেজ পেয়ে প্রস্থান করেন। সে সময় তিনি ছিলেন কর্নেল জানজুয়ারের সেকেন্ড ইন কমান্ড। খ্যাতিমান বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রামে অবাঙালি হত্যার অনভিপ্রেত এক আকস্মিক ঘটনার জের ধরে প্রত্যাহার করা হয়। কর্নেল জানজুয়ার তার স্থলে কমান্ডিং অফিসার এবং মেজর জিয়া সেকেন্ড ইন কমান্ড নিযুক্ত হন। মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পুনঃ প্রচারে কণ্ঠ দিয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য ইতিহাসের সালাম পেয়েছেন। তিনি নিজে তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত অনুসারীরা ফুটন্ত পানিতে ভেজে ঘিয়ে ভাজা জিলাপির স্বাদ নিতে চান। সে কারণেই তাঁদের এত গবেষণা, এত সন্দর্ভ রচনার কসরত। জনতা জাগতে শুরু করেছে। তারা রংপুরে গোপন হত্যার শিকার জনৈক লুৎফর রহমানের লাশ বিদ্যুতের খাম্বায় ঝুলিয়ে রাখতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়েছে। সন্ধানে জেনেছে, থানার একজন কর্তব্যরত দারোগাই এই খুনের নেপথ্য নায়ক এবং 'মূল ছায়া'। তদন্তে এসেছিল এক দারোগা এবং কয়েক সিপাই। রুদ্র জনতা দিয়েছে তাদের আচ্ছামতো গণধোলাই। এসবের মাজেজা বুঝলাম। কিন্তু বুঝলাম না মহাজোট সরকারের দুই প্রবীণ ও আধা প্রবীণ বেসামরিক ও সামরিক আমলামন্ত্রীর মুখে উচ্চারিত 'আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে' কিংবা 'রুটি নেই তাতে কি, ক্ষুধার্ত মানুষ কেক খায় না কেন?' জাতীয় বিভ্রান্ত দিশেহারা ঐতিহাসিক সংলাপের শানেনুজুল। সড়ক দুর্ঘটনায় একাত্তরের ঘাতক দালালদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার দুই প্রধান সাক্ষী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও শহীদ-তনয় আশফাক মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর জনগণ এখন বলতে শুরু করেছে, এরপর যোগাযোগমন্ত্রী কী বলবেন, আপনারা রাস্তায় বের হন কেন?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments