সড়ক কেন মৃত্যুফাঁদ? by ডা. মো. ফজলুল হক
প্রায় ৩০ বছর আগে এক পাকিস্তানি ট্রাক ড্রাইভার, যিনি ৪০ বছর গাড়ি চালানোর জীবনে একটিও দুর্ঘটনার কবলে পড়েননি। এমন একজন দক্ষ ড্রাইভারকে কোনো এক পত্রিকার পাতায় প্রশ্ন করা হয়েছিল_সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর ক্ষেত্রে আপনার মতামত কী? উত্তরে বলেন, 'বিপরীত দিক থেকে আসা প্রতিটি গাড়ির ড্রাইভারকে ভাবতে হবে আমি ছাড়া সব ড্রাইভার অনভিজ্ঞ ও পাগল। সুতরাং ওই বোকা ড্রাইভারদের হাত থেকে আমাকে সতর্ক থেকে গাড়ি চালাতে হবে।
তবেই দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে। এ থেকে সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। বর্তমানে আকস্মিক আশ্চর্যজনক ঘটনাবলির মধ্যে উল্লেখ করার মতো হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনা। অপ্রত্যাশিতভাবে বিদায় নিতে হয়েছে অনেক ব্যক্তিত্বকে, যাদের স্থান পূরণ করার বিকল্প অনেক ক্ষেত্রেই নেই। এ মাসে উল্লেখযোগ্য হলো, গত ১৩ আগস্টের মানিকগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনা। এতে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের চিফ এঙ্িিকউটিভ অফিসার (সিইও) সাংবাদিক আশফাক মুনীর মিশুকসহ পাঁচজন নিহত হন। সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা বাসস্ট্যান্ডের কাছে চুয়াডাঙ্গাগামী ডিলাঙ্ এবং ঢাকামুখী মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। অস্বাভাবিক মৃত্যু যা কারো কাম্য নয় এবং সহ্য করার মতো কোনো ব্যাপারও নয়। এ মৃত্যু পুরো জাতিকে ব্যথিত করেছে, বিশেষভাবে মর্মাহত হয়েছেন টিভি দর্শকরা। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি নিয়মিত ব্যাপার। যেসব রাস্তায় দুর্ঘটনা বেশি হয়, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রাস্তায় মোড় রয়েছে ১০০টির বেশি, কালভার্ট ও বাজার রয়েছে আরো বেশি। আঁকাবাঁকা মোড়বিশিষ্ট রাস্তার কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা হয় বেশি।
মিরসরাইয়ে ট্রাক দুর্ঘটনায় ৪৪ কিশোর শিক্ষার্থীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর রেশ না কাটতেই আরো অনেক সড়ক দুর্ঘটনাসহ ঘটে গেল এ যাবৎকালের উল্লেখযোগ্য ১৩ আগস্টের ঘটনাটি। এ দুর্ঘটনাটি মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। এ ব্যাপারে আমরা সবাই মর্মাহত। এমনিভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ অকালে ঝরে যাচ্ছে শুধু ড্রাইভারের ভুল ও খামখেয়ালির কারণে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। ২০১০ সালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কয়েকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় থাই ডেপুটি এম্বাসাডর মিস পনি্ন লিকানা জুলিসহ প্রায় ১০০ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে এবং আহত হন দুই শতাধিক। গত ২০০৯ সালের বিবিসির তথ্যানুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ১২ হাজার এবং প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার জন। এক জরিপে জানা যায়, দুর্ঘটনার জন্য প্রায় ৯৯ ভাগ দায়ী চালক নিজেই। এ ক্ষেত্রে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের সহজপ্রাপ্যতাও একটি কারণ। আমার ধারণা মতে, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর চেয়ে কোনো অংশেই কম মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশিও বটে। প্রতিবছরই আমদানিতে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে যানজট। তেমনি বাড়ছে ড্রাইভারের চাহিদা। ফলে অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় আছে কি? নেই। কঠোর আইন ও এর সঠিক বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। দুর্ঘটনার মূল কারণের মধ্যে রয়েছে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ড্রাইভারের অদক্ষতা ও অসাবধানতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করা। চালকের সঙ্গে সাইড টক করা এবং মাদকাসক্ত ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মাল বোঝাই ইত্যাদি দুর্ঘটনার মূল কারণ। অন্যদিকে অপ্রশস্ত রাস্তা ও কালভার্ট, ট্রাফিক আইন মেনে না চলা। জনসাধারণের ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করা। কালভার্টগুলোর বেশির ভাগই রাস্তার চেয়েও চাপা, যেখানে দুটি গাড়ি পাশাপাশি অবস্থান করলে একটুও জায়গা থাকে না চলাচলের জন্য। বর্তমানে চার লেনবিশিষ্ট রাস্তা হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে। প্রতিদিন গড়ে দুই-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নিহত হচ্ছে বছরে গড়ে পাঁচ-ছয় হাজার, আহত হচ্ছে প্রায় চার-পাঁচ গুণ। এ থেকে নিস্তারের উপায় কী?
চার লেনবিশিষ্ট রাস্তার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত ড্রাইভারকে লাইসেন্স প্রদান সাপেক্ষে গাড়ি চালাতে দেওয়া। ড্রাইভারকে ধূমপানসহ মাদক থেকে বিরত থাকা। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ড্রাইভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। দূরপাল্লার প্রতিটি গাড়িতে দুই জন অভিজ্ঞ ড্রাইভার রাখার বিধান থাকা। ড্রাইভার ও হেলপারের জন্য নির্ধারিত ড্রেস ব্যবহার করার বিধান রাখা, যাতে ড্রাইভারের আসনে হেলপার বসতে না পারে। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার স্থাপন করা এবং ডিভাইডারের মধ্যে গাছ লাগানো, যাতে রাতে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির লাইট চোখে না লাগে। যাত্রী ওঠানামার জন্য রাস্তার নির্ধারিত স্থানে ডাইভারশন স্পেস রাখা। তেলের পাম্পের ক্ষেত্রে প্রবেশ ও বহিরাগমন পথ ক্রমান্বয়ে বড় রাস্তার সঙ্গে মিলিত হওয়া। বিশ্বরোড থেকে কমপক্ষে ১০০ গজ দূরে হাট-বাজারের অবস্থান হওয়া। বাস বা ট্রাকে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই না করা। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা রাখা। বিশ্বরোডের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকের মালের ওজন নির্ধারণী যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা। রিকশা, ভ্যান অপসারণ করে চালকদের অন্য কাজের সংস্থান করা। বিশ্বরোডে নছিমন ও যন্ত্রচালিত যাত্রীবাহী ভ্যান চালানো নিষিদ্ধকরণ (এ রোডের বেশির ভাগ ড্রাইভারই রাতে হেডলাইট ব্যবহার করেন না)। মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনায় শুধু যাত্রীই ক্ষতি হয় না_ড্রাইভার, হেলপার, সুপারভাইজারেরও ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মালিক। অভাবের ঘানি টানতে হয় অন্য সদস্যদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিঙ্ বিভাগ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
মিরসরাইয়ে ট্রাক দুর্ঘটনায় ৪৪ কিশোর শিক্ষার্থীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর রেশ না কাটতেই আরো অনেক সড়ক দুর্ঘটনাসহ ঘটে গেল এ যাবৎকালের উল্লেখযোগ্য ১৩ আগস্টের ঘটনাটি। এ দুর্ঘটনাটি মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। এ ব্যাপারে আমরা সবাই মর্মাহত। এমনিভাবে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ অকালে ঝরে যাচ্ছে শুধু ড্রাইভারের ভুল ও খামখেয়ালির কারণে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। ২০১০ সালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কয়েকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় থাই ডেপুটি এম্বাসাডর মিস পনি্ন লিকানা জুলিসহ প্রায় ১০০ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে এবং আহত হন দুই শতাধিক। গত ২০০৯ সালের বিবিসির তথ্যানুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় ১২ হাজার এবং প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার জন। এক জরিপে জানা যায়, দুর্ঘটনার জন্য প্রায় ৯৯ ভাগ দায়ী চালক নিজেই। এ ক্ষেত্রে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সের সহজপ্রাপ্যতাও একটি কারণ। আমার ধারণা মতে, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর চেয়ে কোনো অংশেই কম মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশিও বটে। প্রতিবছরই আমদানিতে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে যানজট। তেমনি বাড়ছে ড্রাইভারের চাহিদা। ফলে অদক্ষ ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় আছে কি? নেই। কঠোর আইন ও এর সঠিক বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। দুর্ঘটনার মূল কারণের মধ্যে রয়েছে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ড্রাইভারের অদক্ষতা ও অসাবধানতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ব্যবহার করা। চালকের সঙ্গে সাইড টক করা এবং মাদকাসক্ত ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি চালানো, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মাল বোঝাই ইত্যাদি দুর্ঘটনার মূল কারণ। অন্যদিকে অপ্রশস্ত রাস্তা ও কালভার্ট, ট্রাফিক আইন মেনে না চলা। জনসাধারণের ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করা। কালভার্টগুলোর বেশির ভাগই রাস্তার চেয়েও চাপা, যেখানে দুটি গাড়ি পাশাপাশি অবস্থান করলে একটুও জায়গা থাকে না চলাচলের জন্য। বর্তমানে চার লেনবিশিষ্ট রাস্তা হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে। প্রতিদিন গড়ে দুই-তিনটি দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে নিহত হচ্ছে বছরে গড়ে পাঁচ-ছয় হাজার, আহত হচ্ছে প্রায় চার-পাঁচ গুণ। এ থেকে নিস্তারের উপায় কী?
চার লেনবিশিষ্ট রাস্তার ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত ড্রাইভারকে লাইসেন্স প্রদান সাপেক্ষে গাড়ি চালাতে দেওয়া। ড্রাইভারকে ধূমপানসহ মাদক থেকে বিরত থাকা। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ড্রাইভারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। দূরপাল্লার প্রতিটি গাড়িতে দুই জন অভিজ্ঞ ড্রাইভার রাখার বিধান থাকা। ড্রাইভার ও হেলপারের জন্য নির্ধারিত ড্রেস ব্যবহার করার বিধান রাখা, যাতে ড্রাইভারের আসনে হেলপার বসতে না পারে। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার স্থাপন করা এবং ডিভাইডারের মধ্যে গাছ লাগানো, যাতে রাতে বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির লাইট চোখে না লাগে। যাত্রী ওঠানামার জন্য রাস্তার নির্ধারিত স্থানে ডাইভারশন স্পেস রাখা। তেলের পাম্পের ক্ষেত্রে প্রবেশ ও বহিরাগমন পথ ক্রমান্বয়ে বড় রাস্তার সঙ্গে মিলিত হওয়া। বিশ্বরোড থেকে কমপক্ষে ১০০ গজ দূরে হাট-বাজারের অবস্থান হওয়া। বাস বা ট্রাকে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই না করা। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবস্থা রাখা। বিশ্বরোডের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকের মালের ওজন নির্ধারণী যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখা। রিকশা, ভ্যান অপসারণ করে চালকদের অন্য কাজের সংস্থান করা। বিশ্বরোডে নছিমন ও যন্ত্রচালিত যাত্রীবাহী ভ্যান চালানো নিষিদ্ধকরণ (এ রোডের বেশির ভাগ ড্রাইভারই রাতে হেডলাইট ব্যবহার করেন না)। মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনায় শুধু যাত্রীই ক্ষতি হয় না_ড্রাইভার, হেলপার, সুপারভাইজারেরও ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মালিক। অভাবের ঘানি টানতে হয় অন্য সদস্যদের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান, মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবস্টেট্রিঙ্ বিভাগ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
No comments