ড. মনমোহনের সফর নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর নিয়ে দুটি দেশেই সাড়া পড়েছে। ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যের পত্রপত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ায় এ সফর নিয়ে আলোচনা, রিপোর্ট ও নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে, পাচ্ছে। তার মধ্য থেকে কালের কণ্ঠের পাঠকদের জন্য কয়েকটি নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের অংশবিশেষ ভাষান্তর করা হলো।


ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব
প্রণয় শর্মা, আউটলুক
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তিক্ততা ও অবিশ্বাসের সম্পর্কের পরিবেশের মধ্যে একটি ভালো খবর আছে। ৬ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে একটি ভালো প্রতিবেশীসুলভ এবং পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মানবিক পদক্ষেপ শুরু হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ৬৪ বছরের সংশয় কাটিয়ে ভারতের ১১১টি এবং বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ এবার জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের এই ১৬২টি ছিটমহল নিয়ে নানা মজার কাহিনী প্রচলিত আছে। একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে ভারতের কুচবিহারের মহারাজা এবং বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরের সুবেদারের দাবা খেলায় এই ছিটমহল নিয়ে বাজি ধরা হয়েছিল। সুবেদার সে খেলায় হেরে যান। অন্য একটি বিশ্বাস চালু আছে যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কুচবিহার এবং মোগলদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এই ছিটমহলগুলোর সৃষ্টি হয়।
এর পর অনেক ভয়াবহ ঘটনা ও সংশয়ের মধ্য দিয়ে দেশ ভাগ হয়। ভারত ও পাকিস্তান বুঝতে পারে যে মানচিত্র প্রণয়নকারীরা অতীতের এ বিষয়টিকে মাথায় রাখেননি। ফলে এমন অংশ দুই দেশেরই নিজেদের অংশের ভেতর চলে আসে, যা কৌশলগতভাবে তাদের নয়। ফলে এই ছিটমহল বিনিময় দুটি দেশেরই শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্কের মতো আটকে থাকে। বাংলাদেশের জন্মের পর আবার আশা জেগে ওঠে। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির মধ্য দিয়ে অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিতকরণসহ ছিটমহল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে প্রচেষ্টা অসফল হয়ে থাকে।
ছিটমহল বিনিময় ছাড়াও দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একগুচ্ছ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের টেঙ্টাইল এবং পণ্যকে ভারতের বাজারে আরো অবাধ প্রবেশাধিকার প্রদান, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ, ট্রানজিট সুবিধা; শুধু চট্টগ্রাম বন্দরেই নয়, সেই সঙ্গে উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে যাওয়ার পথকে সহজতর করা।
শিলা ভাট, রেডিফ
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার বীণা সিক্রি বলেছেন, এ এক বিশাল ব্যাপার, ঐতিহাসিক! আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর এক বিশাল মাত্রার এবং গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে।
ড. সিংয়ের ৬ ও ৭ তারিখের সফর ঐতিহাসিক বলে প্রশংসিত হচ্ছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, ১৯৭৪ সাল থেকে স্থবির হয়ে থাকা দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর এবার সমাধান হবে। কিছু বিষয় আছে, যা তারও আগে, ১৯৪৭ সাল থেকে আটকে আছে, যখন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন ২০০৮ সালে। তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সহায়তায় তৎপর ভারতের ইনসার্জেন্টদের দমন করতে।
ভারতের এখন ধারণা যে বর্তমান বাংলাদেশে আইএসআইয়ের উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক কম। ভারতবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ পদক্ষেপ ভারতকে উদ্বুদ্ধ করেছে অন্য বেশ কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে বাণিজ্য-পানি এসব বিষয়ে কিছু ছাড় দিতে, যা ১৯৭৩ সাল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের হাতে কিছু ন্যায্য অভিযোগ আছে। কারণ, বাণিজ্য ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এখনো ভারত অধিক সুবিধা ভোগ করছে।
কুমি কাপুর, ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে গত সপ্তাহে রাজনীতি বিষয়ে কেবিনেট কমিটিতে এক আলোচনা হয়। সেখানে তৃণমূলের মন্ত্রী দিনেশ ত্রিবেদী এক চাতুরি ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর দল বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তিতে স্বাক্ষর দিতে রাজি নয়। ত্রিবেদী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁর দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন দ্রুত কলকাতা ছুটে গেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে। মমতা ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি চুক্তিবিরোধী নন এবং তিনি শেখ হাসিনা ও তাঁর দেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু; কিন্তু উত্তরবঙ্গের (পশ্চিমবাংলার উত্তরবঙ্গ) স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
রাজিব শর্মা, আইএসএন
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রথম বাংলাদেশ সফরে দুটি দীর্ঘকাল ঝুলে থাকা বিষয়ে ঐকমত্য হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। একটি হলো সীমান্ত এবং অন্যটি তিস্তার পানিবণ্টন, যে নদীটি দুই দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি বড় নদী। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার চারটি জাতি নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক গ্রুপ তৈরির কথা চিন্তা করা হচ্ছে, যেখানে নেপাল ও ভুটান থাকবে। এ দেশগুলো পানি সংযোগ ও বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি শুধু ভারতের মানচিত্রকেই পরিবর্তন করবে না, এটিই হবে ভারতের প্রথম কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্তবিতর্কের সমাধান।
ব্রিটিশদের ফেলে যাওয়া ১৯৪৭ সাল থেকে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোতে যে দুঃখজনক অবস্থা বিরাজ করছে, তাদের জন্য কোনো অঞ্চল বা জনগণকে ট্রান্সফার করা হবে না। প্রথমবারের মতো গণনা করা এ অঞ্চলের ৫৩ হাজার মানুষ যে যে রাষ্ট্রে বসবাস করছে, সে সেই রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করবে। যদি তারা পরে কেউ পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে তাকে নরমাল চ্যানেল দিয়ে যেতে হবে।
এ সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে নতুন দিলি্ল, ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গের, যাদের রাজনৈতিক পরিবেশ রয়েছে সহায়তামূলক মনোভাবের।
প্রধানমন্ত্রীর এ সফর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতাকে বিস্তৃত করতে পারে। বাংলাদেশ চায় ঢাকা-কলকাতা ট্রেনপথকে বিস্তৃত করে দিলি্ল ও আজমিরসহ ভারতের বিভিন্ন শহর পর্যন্ত নিয়ে যেতে। দিলি্ল ও আজমিরে রয়েছে সুফি-সাধকদের সমাধি, যার প্রতি রয়েছে অধিকাংশ বাংলাদেশির অশেষ শ্রদ্ধা। বাংলাদেশ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নয়; বরং গোটা ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায়। কিন্তু স্থলসীমান্তই হোক আর রেলপথই হোক, সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ। তাই পশ্চিমবঙ্গের সহযোগিতার ওপর ভরসা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.