মুক্তির মিছিলে by কুন্তল বিশ্বাস

মাদের দেশে কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ জন্মেছেন, যারা সমাজের সুস্বাস্থ্যের ধারা বজায় রাখতে আজীবন সংগ্রাম করে চলেছেন। এমনই একজন আজিজুল ইসলাম খান, নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার যশমাধব গ্রামে ১৯২৭ সালের ৩০ অক্টোবর এক বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিশোর বয়সেই তার মধ্যে দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে। ছাত্রজীবনেই যোগ দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে।


১৯৪৫ সালে তিনি স্কুলের ছাত্র থাকাকালে ঝাঁপিয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনে। সে বছর নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন। সম্মেলনের মূল দায়িত্বে ছিলেন টংক আন্দোলনখ্যাত কমরেড মণি সিংহ। আজিজুল ইসলাম ছিলেন দায়িত্বশীল ভলান্টিয়ার। ভাষা-আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে কুখ্যাত ৯২(ক) ধারা জারি হলে অন্য নেতাদের সঙ্গে আজিজুল ইসলাম খানও গ্রেফতার হন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে আজিজুল ইসলাম গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে গোপনে বিভিন্ন আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৬২ সালে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। ছয় মাস কারাবাসের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। তখন তার ওপর 'ইলেকটেড বডি ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার' (এবডো) জারি করা হয়। কিন্তু তিনি দমার পাত্র নন। ১৯৬৪ সালে আবার তিনি গ্রেফতার হন। বৎসরকাল কারাবাসের পর ১৯৬৫ সালের শেষদিকে তিনি মুক্তি পান।
১৯৬৭ সালে আজিজুল ইসলাম খান ময়মনসিংহ জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে জেলা নেতৃত্বে ছিলেন আজিজুল ইসলাম খান। ১৯৬৯ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। মাসাধিককাল তাকে লৌহকপাটের অন্তরালে কাটাতে হয়।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ময়মনসিংহে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যে যৌথ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে ওঠে তার আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মানুষের দুর্দশা ওঠে চরমে। আজিজুল ইসলাম বুভুক্ষু জনগণকে বাঁচাতে জেলাব্যাপী ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে সুস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ঘটে যায় আরেক বিপর্যয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। হত্যা করা হয় জেলবন্দি চার জাতীয় নেতাকেও। দেশে দেখা দেয় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। বাদ গেলেন না আজিজুল ইসলামও। সে সময় তাকে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে কাটাতে হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আসেন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ। তার সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। সে আন্দোলনে আজিজুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৩ সালে সেই আন্দোলনের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার সময় অন্য নেতাদের সঙ্গে আজিজুল ইসলামও ড. কামাল হোসেনের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন এবং চোখ বেঁধে তাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও খুলনা কারাগার হয়ে অবশেষে মুক্তি পান।
১৯৮৬ সালে হারুন-পংকজের ন্যাপ, একতা পার্টি ও মোজাফ্ফর ন্যাপের একাংশকে নিয়ে ঐক্য ন্যাপ গঠন প্রক্রিয়ায় আজিজুল ইসলাম খান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৯ সালে ঐক্য ন্যাপ সম্মেলনে সৈয়দ আলতাফ হোসেন সভাপতি ও আজিজুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে ঐক্য ন্যাপের নাম পরিবর্তন করে করা হয় গণতন্ত্রী পার্টি, তাতে আহমেদুল কবিরসহ আরও কয়েক নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নবগঠিত পার্টিতেও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে আজিজুল ইসলাম অপরিহার্যভাবে রয়ে গেলেন।
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে
বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে দেশে দুঃশাসন চালায়। উগ্রপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। জোট সরকারের অপসারণ এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ মিলে ১৪ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। সেই জোট গঠনেও আজিজুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৪ দল সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কার পদ্ধতি ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য নির্বাচন কমিশন সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়। সেই জোট গঠন ও নির্বাচন পরিচালনায় আজিজুল ইসলামের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজিজুল ইসলাম খান বিভিন্ন সময়ে ন্যাপের সহ-সভাপতি, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক, কার্যকরী সভাপতি, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর চেয়ারম্যান পদে বহাল আছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। আমরা তার রোগমুক্তি কামনা করছি।
 

No comments

Powered by Blogger.