ভিন্নমত-কেন বিনিয়োগ হচ্ছে না ভেবে দেখুন by আবু আহমেদ
আমাদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত এক যুগের মধ্যে এই বিনিয়োগ বোধ করি জিডিপির শতাংশের হিসাবে সর্বনিম্নে। বিনিয়োগের জন্য অর্থপ্রাপ্তিকে কঠিন করে তোলা হয়েছে। অনবরত সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন খাতে সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফল হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি।
অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক দেড় বছর ধরে একটি যুক্তিতেই সঙ্কোচনশীল বা কন্ট্রাকশনারি মুদ্রানীতি অনুসরণ করে আসছে যে এতে মূল্যস্ফীতি কমবে। এতে যে মূল্যস্ফীতি কমবে না তা আমরা সেই দেড় বছর আগে থেকেই বলে আসছিলাম। এতে যে বিনিয়োগ নিরুৎসাহ হবে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে, সেসব ব্যাপারে আমাদের যুক্তি ছিল অতি পরিষ্কার। বাস্তবে হয়েছে তো তা-ই। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে গত দুই দশকের মধ্যে এই প্রথমবার মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক পার হলো।
এই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে হ্যাঁ, এটা কমতে বাধ্য হবে, যদি বাংলাদেশ বাজার থেকে আরো অনেক মুদ্রা তুলে নেয়। আর সে অবস্থায় সুদের হার আরো বাড়বে। না বাড়লেও ঋণের জন্য কোনো চাহিদা থাকবে না। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত স্তরে হবে না, রপ্তানি কমে যাবে। এক কথায়, অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মুদ্রানীতিই যথেষ্ট। মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ করা হয় দুটি শর্ত বিরাজমান থাকলে। সেই শর্ত বা অবস্থা দুটি হলো_অর্থনীতি যখন পূর্ণ নিয়োগ স্তরে (fully employed level) পৌঁছে যায়, তখন মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
ওই অবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি আর মূল্যস্ফীতি সমার্থক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে, সে বিকাশকে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি বা মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে এবং সুদের হার কমিয়ে সাহায্য করতে হয়। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে পলিসি মেকিং লেভেলে যা ঘটানো হচ্ছে, তার সবই অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক স্বেচ্ছায় অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরছে। দ্বিতীয় যে অবস্থায় মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির দৌড় থামানো হয়, তা হলো অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পথে অতি উত্তপ্ত (over heated) হয়ে যায়। সেই উত্তপ্ততা ঘটে সাধারণ অর্থনীতি যদি একটানা অনেক বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কখনো ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।
চীন ও ভারতের অর্থনীতি এক যুগ ৯-১১ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তখন তারা কিছু মুদ্রা ও আর্থিক নীতির পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতিকে রোধ করতে চেয়েছিল। আর বাংলাদেশ এমন অবস্থায় পেঁৗছার আগে মূল্যস্ফীতির উৎস ও কারণগুলোকে ভুলভাবে পাঠ করে একটা বিনিয়োগবিরোধী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে চলেছে। আমার মনে হয়, আমরা অর্থনীতির পাঠগুলো ঠিকমতো পড়তে জানিনি। জানলে বর্তমান অবস্থায় মূল্যস্ফীতি রোধ করার নামে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবিরোধী একটা নীতি অনুসরণ করতে পারত না। আরেকটা কথা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শোনা যায়, তা হলো মুদ্রার প্রাপ্তিকে কমিয়ে ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক রাখা। এটাও ভালো যুক্তি নয়। টাকার প্রাপ্তি কঠিন করা হলো, ডলারের বিনিময় হার শুধু চাহিদার পতনের কারণে নিম্ন অবস্থানে রইল সেই অবস্থা কি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো? বরং উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে, সরবরাহ কমলে রপ্তানিও কমবে। তখন ডলার সরবরাহ কমবে এবং এক্সচেঞ্জ বাজারে ডলারের মূল্য বাড়তে বাধ্য।
দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থপ্রাপ্তিকে কঠিন করেছে, তাতে কি টাকা-ডলারের বিনিময় হার আমাদের পক্ষে আছে? বরং অবস্থা এমনই স্পষ্ট হয়েছে যে আজকে যেন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ডলারের আসা-যাওয়া অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে। কেন রেমিট্যান্স-প্রবাহে প্রবৃদ্ধি কমল? এরও উত্তর হলো, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকট। সামনে এ সংকট বাড়তে পারে। সব ডলার কি বাংলাদেশ আমদানি ও অনুমোদিত কাজে ব্যবহার করছে? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডলার-প্রবাহ অনেক বেশি হচ্ছে। কিন্তু সত্য হলো, ওইসব ডলারের একটা অংশ হিসাবের বাইরে আসছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্য কথা হলো, ডলারের বাজারে বর্তমানের ক্রাইসিস চলতে থাকলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে বসেই গ্রাহকদের কাছে অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যে ডলার বেচে দেবে। সেসব ডলারের গন্তব্যস্থল হবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, যেসব দেশে বাংলাদেশি ধনীরা তাঁদের অর্থ-কড়ি রাখতে নিরাপদ মনে করেন। যারা সমস্যায় পড়েছে এবং আরো পড়ার আশঙ্কা বেশি তারা হলো, এই দেশের দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাদের চলার কোনো উপায় নেই। বিকল্প সম্পদ ধারণ করার মতো তাদের বাড়তি অর্থ নেই। ফলে মূল্যস্ফীতির ষোল আনা মূল্য তাদেরই দিতে হচ্ছে।
কেন অর্থনীতিতে এত ক্রাইসিস তৈরি হলো? এ ক্ষেত্রে বড় উপাদান হিসেবে কাজ করছে রাজনৈতিক সংঘাত। রাজনৈতিক সংঘাত যত বাড়বে, অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ততই পেছনে চলে যাবে। বাংলাদেশ থেকে বড় আকারের ক্যাপিটাল ফ্লাইট (Capital flight) চলতে থাকবে। আর এই সম্ভাবনার বাংলাদেশ শুধু দরিদ্রই হতে থাকবে বা দরিদ্র হয়ে পড়ে থাকবে। আমাদের সরকার কি রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের জন্য একটি অর্থবহ উদ্যোগ নিতে পারে না?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই মূল্যস্ফীতি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে হ্যাঁ, এটা কমতে বাধ্য হবে, যদি বাংলাদেশ বাজার থেকে আরো অনেক মুদ্রা তুলে নেয়। আর সে অবস্থায় সুদের হার আরো বাড়বে। না বাড়লেও ঋণের জন্য কোনো চাহিদা থাকবে না। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত স্তরে হবে না, রপ্তানি কমে যাবে। এক কথায়, অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান মুদ্রানীতিই যথেষ্ট। মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ করা হয় দুটি শর্ত বিরাজমান থাকলে। সেই শর্ত বা অবস্থা দুটি হলো_অর্থনীতি যখন পূর্ণ নিয়োগ স্তরে (fully employed level) পৌঁছে যায়, তখন মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়।
ওই অবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি আর মূল্যস্ফীতি সমার্থক। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত অর্থনীতির সম্ভাবনাগুলো বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকে, সে বিকাশকে সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি বা মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে এবং সুদের হার কমিয়ে সাহায্য করতে হয়। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে পলিসি মেকিং লেভেলে যা ঘটানো হচ্ছে, তার সবই অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক স্বেচ্ছায় অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরছে। দ্বিতীয় যে অবস্থায় মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির দৌড় থামানো হয়, তা হলো অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পথে অতি উত্তপ্ত (over heated) হয়ে যায়। সেই উত্তপ্ততা ঘটে সাধারণ অর্থনীতি যদি একটানা অনেক বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কখনো ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি।
চীন ও ভারতের অর্থনীতি এক যুগ ৯-১১ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তখন তারা কিছু মুদ্রা ও আর্থিক নীতির পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতিকে রোধ করতে চেয়েছিল। আর বাংলাদেশ এমন অবস্থায় পেঁৗছার আগে মূল্যস্ফীতির উৎস ও কারণগুলোকে ভুলভাবে পাঠ করে একটা বিনিয়োগবিরোধী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে চলেছে। আমার মনে হয়, আমরা অর্থনীতির পাঠগুলো ঠিকমতো পড়তে জানিনি। জানলে বর্তমান অবস্থায় মূল্যস্ফীতি রোধ করার নামে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবিরোধী একটা নীতি অনুসরণ করতে পারত না। আরেকটা কথা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শোনা যায়, তা হলো মুদ্রার প্রাপ্তিকে কমিয়ে ডলার-টাকার বিনিময় হার ঠিক রাখা। এটাও ভালো যুক্তি নয়। টাকার প্রাপ্তি কঠিন করা হলো, ডলারের বিনিময় হার শুধু চাহিদার পতনের কারণে নিম্ন অবস্থানে রইল সেই অবস্থা কি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো? বরং উৎপাদনের ব্যয় বাড়লে, সরবরাহ কমলে রপ্তানিও কমবে। তখন ডলার সরবরাহ কমবে এবং এক্সচেঞ্জ বাজারে ডলারের মূল্য বাড়তে বাধ্য।
দেড় বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থপ্রাপ্তিকে কঠিন করেছে, তাতে কি টাকা-ডলারের বিনিময় হার আমাদের পক্ষে আছে? বরং অবস্থা এমনই স্পষ্ট হয়েছে যে আজকে যেন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ডলারের আসা-যাওয়া অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাচ্ছে। কেন রেমিট্যান্স-প্রবাহে প্রবৃদ্ধি কমল? এরও উত্তর হলো, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকট। সামনে এ সংকট বাড়তে পারে। সব ডলার কি বাংলাদেশ আমদানি ও অনুমোদিত কাজে ব্যবহার করছে? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ডলার-প্রবাহ অনেক বেশি হচ্ছে। কিন্তু সত্য হলো, ওইসব ডলারের একটা অংশ হিসাবের বাইরে আসছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্য কথা হলো, ডলারের বাজারে বর্তমানের ক্রাইসিস চলতে থাকলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিদেশে বসেই গ্রাহকদের কাছে অপেক্ষাকৃত উচ্চমূল্যে ডলার বেচে দেবে। সেসব ডলারের গন্তব্যস্থল হবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, যেসব দেশে বাংলাদেশি ধনীরা তাঁদের অর্থ-কড়ি রাখতে নিরাপদ মনে করেন। যারা সমস্যায় পড়েছে এবং আরো পড়ার আশঙ্কা বেশি তারা হলো, এই দেশের দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাদের চলার কোনো উপায় নেই। বিকল্প সম্পদ ধারণ করার মতো তাদের বাড়তি অর্থ নেই। ফলে মূল্যস্ফীতির ষোল আনা মূল্য তাদেরই দিতে হচ্ছে।
কেন অর্থনীতিতে এত ক্রাইসিস তৈরি হলো? এ ক্ষেত্রে বড় উপাদান হিসেবে কাজ করছে রাজনৈতিক সংঘাত। রাজনৈতিক সংঘাত যত বাড়বে, অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ততই পেছনে চলে যাবে। বাংলাদেশ থেকে বড় আকারের ক্যাপিটাল ফ্লাইট (Capital flight) চলতে থাকবে। আর এই সম্ভাবনার বাংলাদেশ শুধু দরিদ্রই হতে থাকবে বা দরিদ্র হয়ে পড়ে থাকবে। আমাদের সরকার কি রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের জন্য একটি অর্থবহ উদ্যোগ নিতে পারে না?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments