যুদ্ধাপরাধ-বিএনপি নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক by শেখ হাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার বন্ধ করতে বলেছে। গত ৩ ডিসেম্বর দলের দাবিগুলো পড়ে শোনান সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা মওদুদ আহমদ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতিতে ব্যারিস্টার মওদুদ বিএনপির যে বক্তব্য তুলে ধরেন এবং এর সারমর্ম হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবৈধ ও অসাংবিধানিক।
এটি হচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কূটকৌশল। তাই এটি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিএনপির দাবিগুলো সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ প্রজন্ম ও সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক উষ্মা, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির দাবিগুলো যদি যৌক্তিক হতো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সুষ্ঠু ও নিখুঁত করার জন্য যদি বিএনপি গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসত, তাহলে তা আমাদের এত দিনের ব্যর্থতার যেমন ক্ষতিপূরণ করত, তেমনই তা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করত। কিন্তু বিএনপি তা না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি করে নিজের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব উন্মোচিত করেছে। তবুও বিএনপির অভিযোগের সত্যতা এবং দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা কতটা মজবুত তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
বিএনপির প্রথম দাবি হচ্ছে, এই ট্রাইব্যুনালের আইনি কাঠামো ও বিচার কার্যক্রমের ওপর বিএনপির কোনো আস্থা নেই। কারণ বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ট্রাইব্যুনাল একটি আজ্ঞাবাহী রাবার স্ট্যাম্প সংগঠন ছাড়া কিছুই নয়। এই ট্রাইব্যুনাল প্রহসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের জন্য গঠন করা হয়েছে। তাই এর বেআইনি ও অসাংবিধানিক কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী। তাহলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কী করে বেআইনি হলো? এ ট্রাইব্যুনাল সংবিধানের সঙ্গে কীভাবে এবং কতটা সাংঘর্ষিক, তাও বিএনপি স্পষ্ট করেনি। দেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো মানবাধিকার সংগঠনও বলেনি যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবৈধ ও অসাংবিধানিক। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রথম থেকেই অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের দাবিগুলো উত্থাপন করে কি বুঝিয়ে দিল যে রাজনৈতিকভাবে দলটি কতটা দেউলিয়া?
জামায়াত, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রথম থেকেই বলে আসছে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি কৌশল। এখানে একটি রাজনীতি আছে বটে, সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি ও বিপক্ষের রাজনীতি। জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও জামায়াত তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-বিরোধিতার দায় তো ট্রাইব্যুনালের নয়। আর পক্ষ-প্রতিপক্ষের কথাই যদি আসে, তাহলে বলতে হয়, ন্যায়বিচারেও দুটি পক্ষ থাকে—একটি ন্যায়, আরেকটি অন্যায়। সারা বিশ্বে এবং সমগ্র বাঙালির কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে জামায়াত ও তার সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন অনেক কাজ করেছেন যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। বিএনপি কি ঠিক করেছে যে তারা অন্যায়কারীর পক্ষে অবস্থান নেবে এবং অন্যায়কারীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে?
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপকে উদ্ধৃত করে র্যাপের কিছু সুপারিশমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মানবাধিকারবিষয়ক পণ্ডিত ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে করার আহ্বান জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম এ বছরের মার্চ মাসে ডেইলি স্টার-এর আইন পাতায় ‘১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন এবং এর আন্তর্জাতিক মান’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের করা ন্যুরেমবার্গ নীতিমালা, ১৯৯৩ সালের সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধি এবং ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডাবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা, অপরাধের দায়, বিচারের কার্যক্রম, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার, অপরাধের শিকার ও সাক্ষীদের অধিকার এবং ট্রাইব্যুনালের রায় বিষয়ে অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধভাবে তুলনামূলক আলোচনা করেন। তিনি দেখান, ১৯৭৩ সালের আইনটি ন্যুরেমবার্গ নীতিমালা, ১৯৯৩ সালের সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডাবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ওই প্রবন্ধের উপসংহারে যেমনটি বলেছেন, ড. শাহ্দীন মালিকও তাঁর সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে একই কথা বলেছেন। দুজনের কথার সারমর্ম হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে ১৯৭৩ সালের আইনটি একদম নিখুঁত নয়। তবে সে ত্রুটি এতই সামান্য যে তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য কোনো বাধা হতে পারে না। তাহলে আন্তর্জাতিক মান, স্বচ্ছতা ইত্যাদির অজুহাত তুলে বিচার বন্ধের জন্য বিএনপির দাবির কি ভিত্তি থাকছে?
তৃতীয়ত, বিএনপি বলেছে, দলটি সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে সে বিচার হতে হবে দেশের প্রচলিত আইনে। বিএনপির নেতারা কি দয়া করে বলবেন, কারা ‘সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধী’? ১৯৭৫ সালের পর বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা ‘সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের’ কেন বিচার করেনি? বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রচলিত আইনে করার কথা কোন যুক্তিতে বলছে? পৃথিবীর কোন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রচলিত আইনে হয়েছে—এর কোনো নজির বিএনপির নেতারা দেখাতে পারবেন কি?
বিএনপির চতুর্থ দাবি হচ্ছে, সরকার যদি বিচার শুরুর আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, তাহলে তা হবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শামিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেক বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধীদের দেওয়া হয়নি। ড. মিজানুর রহমান ডেইলি স্টার-এ তাঁর সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যতটা অধিকার দেওয়া হয়েছে, যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ন্যুরেমবার্গ, টোকিও, কম্বোডিয়া ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল কি যুদ্ধাপরাধীদের এতটা অধিকার দিয়েছিল? ইতিহাস ও আইনের এ এক মহা পরিহাস, যারা লাখো বাঙালিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, যারা হাজার হাজার বাঙালিকে জবাই করে রঞ্জিত করেছিল বাংলার মাটি ও নদী, যারা শত শত নারীর সম্ভ্রম লুটে নিয়েছিল বা তাঁদের তুলে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, আজ তাদের বিচারের জন্য স্বচ্ছতার কথা বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের কথা বলা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা ৭১ সালে ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে দিল, হত্যা করল শিশু, যুবক ও বৃদ্ধকে। এখন ওই হত্যাকারীদের বিচারের সময় বিএনপির নেতাদের মানবতাবোধ উথলে উঠল! ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর মানবাধিকারের কোনো মূল্যই তাদের কাছে নেই! বিএনপির নেতাদের যত দরদ ওই নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকা চৌধুরীদের জন্য? কামনা করি, তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। ৩০ লাখ শহীদের যন্ত্রণা যেন বাংলা মায়ের আত্মাকে আর ক্ষতবিক্ষত না করে।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিএনপির দাবিগুলো সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ প্রজন্ম ও সচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক উষ্মা, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিএনপির দাবিগুলো যদি যৌক্তিক হতো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সুষ্ঠু ও নিখুঁত করার জন্য যদি বিএনপি গঠনমূলক প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসত, তাহলে তা আমাদের এত দিনের ব্যর্থতার যেমন ক্ষতিপূরণ করত, তেমনই তা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করত। কিন্তু বিএনপি তা না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি করে নিজের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব উন্মোচিত করেছে। তবুও বিএনপির অভিযোগের সত্যতা এবং দাবিদাওয়ার যৌক্তিকতা কতটা মজবুত তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
বিএনপির প্রথম দাবি হচ্ছে, এই ট্রাইব্যুনালের আইনি কাঠামো ও বিচার কার্যক্রমের ওপর বিএনপির কোনো আস্থা নেই। কারণ বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ট্রাইব্যুনাল একটি আজ্ঞাবাহী রাবার স্ট্যাম্প সংগঠন ছাড়া কিছুই নয়। এই ট্রাইব্যুনাল প্রহসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের জন্য গঠন করা হয়েছে। তাই এর বেআইনি ও অসাংবিধানিক কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন অনুযায়ী। তাহলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কী করে বেআইনি হলো? এ ট্রাইব্যুনাল সংবিধানের সঙ্গে কীভাবে এবং কতটা সাংঘর্ষিক, তাও বিএনপি স্পষ্ট করেনি। দেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো মানবাধিকার সংগঠনও বলেনি যে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবৈধ ও অসাংবিধানিক। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালকে প্রথম থেকেই অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলেছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে জামায়াতের দাবিগুলো উত্থাপন করে কি বুঝিয়ে দিল যে রাজনৈতিকভাবে দলটি কতটা দেউলিয়া?
জামায়াত, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রথম থেকেই বলে আসছে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটি কৌশল। এখানে একটি রাজনীতি আছে বটে, সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতি ও বিপক্ষের রাজনীতি। জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও জামায়াত তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-বিরোধিতার দায় তো ট্রাইব্যুনালের নয়। আর পক্ষ-প্রতিপক্ষের কথাই যদি আসে, তাহলে বলতে হয়, ন্যায়বিচারেও দুটি পক্ষ থাকে—একটি ন্যায়, আরেকটি অন্যায়। সারা বিশ্বে এবং সমগ্র বাঙালির কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে জামায়াত ও তার সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এমন অনেক কাজ করেছেন যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। বিএনপি কি ঠিক করেছে যে তারা অন্যায়কারীর পক্ষে অবস্থান নেবে এবং অন্যায়কারীদের বিচার ভণ্ডুল করার জন্য ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে?
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপকে উদ্ধৃত করে র্যাপের কিছু সুপারিশমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মানবাধিকারবিষয়ক পণ্ডিত ৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে করার আহ্বান জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম এ বছরের মার্চ মাসে ডেইলি স্টার-এর আইন পাতায় ‘১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন এবং এর আন্তর্জাতিক মান’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের করা ন্যুরেমবার্গ নীতিমালা, ১৯৯৩ সালের সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধি এবং ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডাবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধির সঙ্গে বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধের সংজ্ঞা, অপরাধের দায়, বিচারের কার্যক্রম, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকার, অপরাধের শিকার ও সাক্ষীদের অধিকার এবং ট্রাইব্যুনালের রায় বিষয়ে অত্যন্ত প্রণালীবদ্ধভাবে তুলনামূলক আলোচনা করেন। তিনি দেখান, ১৯৭৩ সালের আইনটি ন্যুরেমবার্গ নীতিমালা, ১৯৯৩ সালের সাবেক যুগোস্লাভিয়াবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডাবিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংবিধির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ওই প্রবন্ধের উপসংহারে যেমনটি বলেছেন, ড. শাহ্দীন মালিকও তাঁর সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে একই কথা বলেছেন। দুজনের কথার সারমর্ম হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে ১৯৭৩ সালের আইনটি একদম নিখুঁত নয়। তবে সে ত্রুটি এতই সামান্য যে তা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য কোনো বাধা হতে পারে না। তাহলে আন্তর্জাতিক মান, স্বচ্ছতা ইত্যাদির অজুহাত তুলে বিচার বন্ধের জন্য বিএনপির দাবির কি ভিত্তি থাকছে?
তৃতীয়ত, বিএনপি বলেছে, দলটি সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। তবে সে বিচার হতে হবে দেশের প্রচলিত আইনে। বিএনপির নেতারা কি দয়া করে বলবেন, কারা ‘সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধী’? ১৯৭৫ সালের পর বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল। তখন তারা ‘সত্যিকারের যুদ্ধাপরাধীদের’ কেন বিচার করেনি? বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রচলিত আইনে করার কথা কোন যুক্তিতে বলছে? পৃথিবীর কোন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রচলিত আইনে হয়েছে—এর কোনো নজির বিএনপির নেতারা দেখাতে পারবেন কি?
বিএনপির চতুর্থ দাবি হচ্ছে, সরকার যদি বিচার শুরুর আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, তাহলে তা হবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শামিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেক বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে, যা অন্য কোনো দেশের যুদ্ধাপরাধীদের দেওয়া হয়নি। ড. মিজানুর রহমান ডেইলি স্টার-এ তাঁর সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখেছেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের যতটা অধিকার দেওয়া হয়েছে, যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ন্যুরেমবার্গ, টোকিও, কম্বোডিয়া ও সাবেক যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনাল কি যুদ্ধাপরাধীদের এতটা অধিকার দিয়েছিল? ইতিহাস ও আইনের এ এক মহা পরিহাস, যারা লাখো বাঙালিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, যারা হাজার হাজার বাঙালিকে জবাই করে রঞ্জিত করেছিল বাংলার মাটি ও নদী, যারা শত শত নারীর সম্ভ্রম লুটে নিয়েছিল বা তাঁদের তুলে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, আজ তাদের বিচারের জন্য স্বচ্ছতার কথা বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের কথা বলা হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা ৭১ সালে ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে দিল, হত্যা করল শিশু, যুবক ও বৃদ্ধকে। এখন ওই হত্যাকারীদের বিচারের সময় বিএনপির নেতাদের মানবতাবোধ উথলে উঠল! ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নারীর মানবাধিকারের কোনো মূল্যই তাদের কাছে নেই! বিএনপির নেতাদের যত দরদ ওই নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী ও সাকা চৌধুরীদের জন্য? কামনা করি, তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়। ৩০ লাখ শহীদের যন্ত্রণা যেন বাংলা মায়ের আত্মাকে আর ক্ষতবিক্ষত না করে।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com
No comments