পরিবহন খাত-নতুন 'ইনডেমনিটি' আন্দোলন by শওগাত আলী সাগর
বিস্ময়ের ব্যাপার, বাংলাদেশে অশিক্ষিত গাড়িচালকদের আইনি কাঠামোর ঊধর্ে্ব রাখার জন্য রীতিমতো রাস্তার আন্দোলনে নেমে পড়েছেন প্রজাতন্ত্রের একজন মন্ত্রী। আশঙ্কার ব্যাপার হলো, তিনি যেহেতু শাসক দলের একজন মন্ত্রী এবং শাসক দল তার কর্মকাণ্ডকে নীরবে হলেও অনুমোদন দিচ্ছে মাইকেল জেমস ব্রায়ান্টের জন্য আজকের দিনটা সম্পূর্ণ অন্য রকম। জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনও বটে।
যুগল জীবনের ১২টি বছর পেরিয়ে আসার আনন্দ তাকে যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে রেখেছে। স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে তাই ছুটেছেন নৈশভোজে, ১২তম বিবাহবার্ষিকী সেলিব্রেট করতে। মুহূর্তেই যেন সব উলটপালট হয়ে যায়। কিছু একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে_ টের পান ব্রায়ান্ট। পাথরের মতো বসে থাকেন গাড়িতে। চারদিকে পুলিশ, মিডিয়া, টেলিভিশনের ক্যামেরার ফ্লাশলাইট। ব্রায়ান্ট ভাবেন_ তার জীবনে সম্ভবত ঘোর অন্ধকার একটি অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।
ততক্ষণে রেডিও-টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজে শিরোনাম হয়ে গেছেন জেমস ব্রায়ান্ট। আর হবেন না-ইবা কেন? তার মতো সেলিব্রেটি যখন খবরের উপাদান, তখন মিডিয়া সেই সুযোগটা হাতছাড়া করবে কেন?
কানাডার গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ অন্টারিওর সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলের (মূলত আইনমন্ত্রী) গাড়িতে চাপা পড়ে যখন কোনো সাইকেলচালকের মৃত্যু ঘটে তখন সেই সংবাদের গুরুত্ব এমনিতেই বেড়ে যায়; আবার গাড়িটি যখন স্বয়ং ব্রায়ান্টই চালাচ্ছিলেন। বিবাহবার্ষিকীর নৈশভোজের বদলে জেলখানায় যেতে হয় প্রদেশের সাবেক ক্যাবিনেট মিনিস্টার সেলিব্রেটি এই রাজনীতিককে, যিনি মাত্র কয়েক মাস আগে রজনীতি থেকে ইস্তফা দিয়ে 'ইনভেস্ট টরেন্টো' নামে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। এক রাত জেলখানায় কাটিয়ে পরের দিন আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পান তিনি।
কেউ আবার ভেবে বসবেন না যেন, ব্রায়ান্টের প্রতিপক্ষ কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় ছিল বলে ব্রায়ান্টকে জেলে যেতে হয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায় এখনকার মতো তখনও লিবারেল পার্টি। আর লিবারেল সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। হার্ভার্ডের ল গ্র্যাজুয়েট, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ৪৩ বছরের তরুণ এই ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিই যে ভবিষ্যতে অন্টারিওর প্রিমিয়ার হবেন_ সেটিও প্রায় নিশ্চিতভাবেই আলোচিত হচ্ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিকে বিবাহবার্ষিকীর রাতটা জেলে কাটাতে হয় সাইকেলচালককে গাড়িচাপা দেওয়ার অভিযোগে। ঘটনাটি ২০০৯ সালের। ব্রায়ান্ট জামিনে ছাড়া পেলেও ঘটনা থেমে থাকেনি। তোলপাড় চলতে থাকে মিডিয়ায়। চলতে থাকে পুলিশি তৎপরতাও। মিডিয়ার অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ৩৩ বছরের সাইকেল আরোহীটি বায়ান্টের গাড়ির সঙ্গে পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ হঠাৎ চলে যাচ্ছিল ব্রায়ান্টের গাড়ির সামনে। কখনও-বা তার পাশে গিয়ে নানা ধরনের কমেন্ট ছুড়ে দিচ্ছিল। মাতাল অবস্থায় বেপরোয়া সাইকেল চালাতে গিয়ে ব্রায়ান্টকে উত্ত্যক্ত করছিল সাইকেল আরোহী। এরই এক পর্যায়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে। কিন্তু পুলিশ তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। দুটি অভিযোগ আনে সাবেক এই আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। একটি 'ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স কজিং এ ডেথ', আরেকটি হচ্ছে বিপজ্জনক গাড়ি চালানো। অধিকাংশ মিডিয়ার খবরের তথ্য বিশ্লেষণে খুব সহজেই সাইকেলচালককে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা গেলেও পুলিশ কিন্তু ব্রায়ান্টের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক গাড়ি চালনা এবং অবহেলার অভিযোগ আনে, যার শাস্তি প্রথমটার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন (কানাডায় মৃত্যুদণ্ড প্রথা নেই) আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে নূ্যনতম ১৪ বছরের জেল।
শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে ব্রায়ান্টই জিতে যান। আদালত তাকে দায় থেকে অব্যাহতি দেন। ব্রায়ান্টের বিচারটি আদালতে উঠলে বিচার পরিচালনা নিয়ে সংকট দেখা দেয়। ব্রায়ান্ট যেহেতু তিন মাস আগেও অন্টারিওর অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন, ফলে তার বিচার পরিচালনা করতে গিয়ে বিচারকরা পক্ষপাতমূলক আচরণ করে ফেলতে পারেন_ এমন একটি আশঙ্কা প্রকাশ করে মিডিয়া। ফলে অন্য প্রদেশ থেকে সিনিয়র দু'জন বিচারপতিকে আনা হয় এই বিচারকাজ পরিচালনার জন্য। তারা তাকে নির্দোষ বলে রায় দেন।
ঢাকার মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন পরিবহন শ্রমিকদের সমাবেশ এবং শাজাহান খানের বক্তব্য পড়ে জেমস ব্রায়ান্টের ঘটনাটি মনে পড়ে গেল। সাবেক মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও একটি দুর্ঘটনা এবং তাতে একজনের মৃত্যুর জের ধরে জেমস ব্রায়ান্টকে এক রাতের জন্য হলেও জেলে যেতে হয়েছে। আর বাংলাদেশের এই মন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনার পর কোনো চালকের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা যাতে না করা হয়, সে জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। তিনি বলছেন, কেউ ইচ্ছা করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। মন্ত্রী হয়েও তিনি শ্রমিকদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন এবং সেখানে নিজে রাষ্ট্রের বিদ্যমান একটি আইনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেছেন। শাজাহান খান কতটা মন্ত্রী, কতটা পরিবহন শ্রমিক নেতা_ সেটা নিয়ে মাঝে মধ্যে আমরা সংশয়ে পড়ে যাই। কেননা তার আচরণ যতটা না মন্ত্রীর মতো, তার চেয়ে বেশি শ্রমিক নেতার মতো। সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তার কাছে গণমানুষের সুবিধা-অসুবিধা, নিরাপত্তা গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু তার কর্মতৎপরতায় এ বিষয়গুলো মোটেও প্রাধান্য পায় না। তিনি সোচ্চার পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষ, তাদের পরিবার নয়; চালকদের 'খুনের ইনডেমনিটি' নিশ্চিত করতে তিনি মরিয়া। এতে যে 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট'_ স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয় সেটি ভাবার মতো ফুরসত তার তো নেই-ই, সরকারের আছে বলেও মনে হয় না।
শাজাহান খানের ভূমিকা, কর্মকাণ্ড বরাবরই দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে। বিশ্বের উন্নত দেশে যেখানে শিক্ষিত, সচেতন লোকের সংখ্যা বেশি, সেসব দেশেও ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয় কঠিন সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সাপেক্ষে। গাড়িচালকদের জন্য রয়েছে কঠিন সব নিয়ম। মাতাল হওয়া দূরের কথা, মদপান করে স্বাভাবিক অবস্থায় গাড়ি চালানোও এখন বেআইনি। ধরা পড়লে লাইসেন্স খোয়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। আর দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে তো সেটি খুনের পর্যায়েই পড়ে। এত সব কঠিন বিধিনিষেধের পরও উন্নত বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। কিন্তু আইন এবং আইনের প্রয়োগ দুর্ঘটনার হারটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, বাংলাদেশে অশিক্ষিত গাড়িচালকদের আইনি কাঠামোর ঊধর্ে্ব রাখার জন্য রীতিমতো রাস্তার আন্দোলনে নেমে পড়েছেন প্রজাতন্ত্রের একজন মন্ত্রী। আশঙ্কার ব্যাপার হলো, তিনি যেহেতু শাসক দলের একজন মন্ত্রী এবং শাসক দল তার কর্মকাণ্ডকে নীরবে হলেও অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে রাস্তায় জননিরাপত্তা ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন যদি দেশের তাবৎ সন্ত্রাসী একজোট হয়ে দাবি তোলে, সন্ত্রাস করতে গিয়ে খুনখারাবি হয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা যাবে না। কারণ সন্ত্রাসীরা ইচ্ছা করে খুন করে না, পরিস্থিতির কারণে খুন করতে বাধ্য হয়_ তখন কী হবে? শাজাহান খান কি সেই দাবিকেও সমর্থন করবেন? কে জানে, হয়তো-বা। কেননা পরিবহন শ্রমিকদের খুনের ইনডেমনিটি আদায়ে তিনি যে আন্দোলনে নেমেছেন, তার সঙ্গে এর তফাত কী?
শওগাত আলী সাগর : টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক
shaugat@gmail.com
No comments