সময়ের প্রতিধ্বনি-মনমোহনের ঢাকা সফর : কী পেল বাংলাদেশ by মোস্তফা কামাল

লেখার শুরুতেই মনে পড়ছে ভারতের বর্ষীয়ান জননেতা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর কথা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এর আগে বিএনপির শাসনামলে ভারতের সঙ্গে খুবই বৈরী সম্পর্ক চলছিল। সেই বৈরিতা কাটিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে দুই পক্ষই বেশ উন্মুখ ছিল। ভারতে তখন বামপন্থী এইচ ডি দেবে গৌড়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনে জ্যোতি বসুর অবদান ছিল। সংগত কারণেই কেন্দ্রে জ্যোতি বসুর একটা প্রভাবও ছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরই ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিল। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি এবং চাকমা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে জোর পদক্ষেপ নেওয়া হলো। তখন আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে ভারতের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন বামপন্থী সরকারের কাছে। শুরু হলো ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। লক্ষ্য_গঙ্গার দীর্ঘমেয়াদি পানিবণ্টন চুক্তি এবং চাকমা শরণার্থী সমস্যার সমাধান।
ভারতের বামপন্থী সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে জ্যোতি বসুসহ বেশ কয়েকজন নেতা সক্রিয় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী দেবে গৌড়া এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আই কে গুজরালও বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। ভারতের গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের মধ্যেই বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখেছি। দৈনিক সংবাদের কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে আমি তখন এসব বিষয়ে লেখালেখি করেছি। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতা ও কূটনীতিকদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ দেখে মনে হয়েছিল, কিছু একটা হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আই কে গুজরাল। ঢাকা সফরে এসে তিনি বললেন, বাংলাদেশের জন্য তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। ঠিক একই কথা শোনা গেল জ্যোতি বসুর মুখেও। তিনিও ঢাকা বিমানবন্দরে আমাদের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, শেখ হাসিনার জন্য কিছু একটা করতে হবে। তারপর প্রয়াত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা ছুটে গেলেন ভারতীয় নেতাদের কাছে। সহযোগিতা চাইলেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি করেন। ওই চুক্তি সইয়ের জন্য জ্যোতি বসুর আন্তরিক সহযোগিতার কথা আজ মনে পড়ছে। তিনি সহযোগিতা না করলে বাংলাদেশ তখন পানিবণ্টন চুক্তি সই করতে পারত কি না সন্দেহ। এর পরের বছরই ভারত সরকারের সহযোগিতায় চাকমা শরণার্থী সমস্যার সমাধানও হলো। এ দুটি ঐতিহাসিক কাজের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপকভাবে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়।
২০০৮ সালেও আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর শেখ হাসিনা দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায়।
আমরা সবাই জানি, ভারতের গান্ধী পরিবার এবং বাংলাদেশের শেখ পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সেই সম্পর্ক দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই নাজুক ছিল। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই দেশের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এর নেপথ্যে দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরই ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যার সমাধানে আন্তরিক সহযোগিতা দেন। আর ভারত এই সমস্যাটি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। শুধু তা-ই নয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সমস্যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। সেই সমস্যাটির অনেকটাই সমাধান হয়েছে শেখ হাসিনার সহযোগিতায়। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভারতের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, এমনকি সাধারণ মানুষও শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে।
সম্ভবত এ কারণেই ভারতের গণমাধ্যম অনেক দিন ধরেই বলে আসছে, 'ভারতকে বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে। এখন ভারতের দেওয়ার পালা। দুই হাত ভরে বাংলাদেশকে দিতে হবে।' ভারতের লেখক, সমাজকর্মী, কূটনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা_সবাই নানাভাবে তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করে আসছেন। ভারত সরকারও বিষয়টি উপলব্ধি করছে। সেই উপলব্ধি থেকেই গত বছর জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের সময়ই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বলা হয়, তিস্তা নিয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। তখন এও বলা হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে আসবেন এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ছাড়াও সীমানা চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমি হস্তান্তরসহ ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
৬ সেপ্টেম্বর দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এলেন ড. মনমোহন সিং। তাঁর সফর নিয়ে দুই দেশই মানুষকে ব্যাপক উচ্চাশা দিয়েছিল। দুই দেশের গণমাধ্যমও বেশ সরব ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অঘটন ঘটালেন মমতা বন্দ্যোপাধায়।
আমরা বরাবরই জেনে আসছি, মমতা বন্দ্যোপাধায় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁর সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মমতা এই লেখককেও বলেছেন, শেখ হাসিনাকে তিনি বড় বোন মনে করেন। মমতা চেয়েছেন বলেই শেখ হাসিনা কয়েক দিন আগেও ১০০ টন ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এর পরও তিনি শেষ মুহূর্তে কেন বেঁকে বসলেন, বুঝতে পারলাম না। তিনি কি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এমন আচরণ করলেন? নাকি এর নেপথ্যে অন্য কিছু আছে?
মমতার নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, এমনকি সাধারণ মানুষও এক ধরনের নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। সবার ধারণা ছিল, নিকট প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে থাকলে ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছুই আদায় করা সহজ হবে। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের চার হাজার ২০০ কিলোমিটার সীমান্তের বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে শুধু ভাষার মিলই নয়, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং আচার-অনুষ্ঠানেরও মিল রয়েছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মানুষ মমতার ইতিবাচক ভূমিকা আশা করেছিল। আশা করেছিল, তিনিও জ্যোতি বসুর মতোই বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু একটা করবেন। কিন্তু মমতা কেবল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখেই চুনকালি দেননি, বাংলাদেশের সঙ্গে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাতেও কালিমা লেপন করেছেন।
তবে এটাও ঠিক, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও ভুল ছিল। ভারতের কংগ্রেস জোটের অন্যতম শরিক দল মমতার তৃণমূল। মমতা যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তার পেছনেও কংগ্রেসের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এর পরও মমতা যে এমন আচরণ করতেই পারেন, তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা বিবেচনায় না নেওয়ায় বিশ্ববাসী জানল, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের আস্থার সম্পর্ক না থাকায় এমনটি হয়েছে।
ভারতের গণমাধ্যমও মমতার আচরণে ক্ষুব্ধ। প্রায় সব টিভি ও পত্রিকা তাঁর তুখোড় সমালোচনা করেছে। নিশ্চয়ই ভারত সরকারও এতে বিব্রত হয়েছে। এর পরও দুই দেশ উন্নয়ন সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি এবং স্থল সীমানা-সংক্রান্ত '৭৪-এর চুক্তি বাস্তবায়নে প্রটোকল সই করেছে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে ট্রানজিট শুল্ক, বাঘ সংরক্ষণ, ঢাকা ও নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা, বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে সহযোগিতা প্রভৃতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর পরও খুশি হয়নি বাংলাদেশ। বরং হতাশ হয়েছে। সংগত কারণেই ট্রানজিট ইস্যুটিও ঝুলে গেছে।
এখান থেকেই উভয় দেশকে শিক্ষা নিতে হবে। বাংলাদেশের যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে দুই উপদেষ্টাকে দিয়ে সব কিছু করানোর চেষ্টাটি ভুল ছিল। কারণ, দুই উপদেষ্টার কারোই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এ ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিরও কোনো অভিজ্ঞতা নেই। সংগত কারণেই সরকারের উচিত ছিল সাবেক দক্ষ কূটনীতিকদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা। যাঁরা অতীতে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন এবং পরবর্তীকালে পররাষ্ট্র সচিব হয়ে ভারতের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদেরও কাজে লাগানো যেত।
বাংলাদেশের যে অভিজ্ঞতার অভাব ছিল, তা স্পষ্ট হয়েছে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে। একইভাবে বিজ্ঞ ভারত সরকারের অভিজ্ঞতার ঘাটতিও স্পষ্ট হয়েছে। কারণ বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন ঢাকায় এসে কিছু না দিয়ে ফিরে যাবেন, এটা হয় না। বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট রাখা। একই সঙ্গে ভারতের উন্নয়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার নীতি ভারতকেই নিতে হবে। তাতে ভারতই লাভবান হবে। যদিও গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাকালে ড. মনমোহন বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা আশা করছি; শিগগিরই ভারত তিস্তা চুক্তি সইয়ের উদ্যোগ নেবে।
ভারত যদি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হতে চায়, তখন কিন্তু নিকট প্রতিবেশীদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাগবে। তা ছাড়া প্রতিবেশীদের বাদ দিয়ে ভারত একা বড় হতে পারবে না। এমন কিছু করতে হবে, যাতে ভারত সম্পর্কে এ দেশের জনগণের মনেও ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। আর এখানে যারা রাজনৈতিক কারণে ভারতবিরোধিতা করছে, তাদের রাজনীতি বন্ধ করতেও ভারতকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.