শিক্ষানীতির আলোকে সাক্ষরতা আন্দোলন by আ. ন. স. হাবীবুর রহমান
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ বাংলাদেশের সংসদে পাস হয়েছে। বরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী এবং প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমানের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ যথেষ্ট পরিশ্রম করে শিক্ষানীতির প্রতিপাদ্য চূড়ান্ত করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর শিক্ষানীতি একটি অন্যতম দলিল। বর্তমান নিবন্ধে শিক্ষানীতির বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
শিক্ষানীতির এই অধ্যায়ের প্রথম বাক্যটি হলো, 'বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক সকল নাগরিককে সাক্ষর করে তোলা।' হ্যাঁ, এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে যে ইশতেহার প্রকাশ করেছে, তাতে এই লক্ষ্যই বর্ণিত আছে। জনগণের রায় পাওয়া এই সরকার সাক্ষরতার ক্ষেত্রে যে বড় উদ্যোগ নেবে, তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা নিয়ে। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রায় আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বয়স্ক নিরক্ষরতার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের নিরক্ষরতা প্রায় ৪৮ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। এর অর্থ হলো, ২০১৫ সালে ১৫ ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাক্ষরতার হার হবে ৭৫ শতাংশেরও বেশি।
সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পর বাংলাদেশে সরকারিভাবে বয়স্ক সাক্ষরতা কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে আরো কয়েক বছর পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। এতে করে সরকার বয়স্ক শিক্ষার জন্য একটি জোরালো কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে পারবে বলে তাঁরা মনে করেন। আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিধ্বনি না করে শিক্ষানীতি পর্যালোচনা কমিটি এর বাস্তব দিকটি খতিয়ে দেখতে পারত। শিক্ষানীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুণীজনরা অবশ্যই জানেন যে অতীতে আমাদের দেশে বয়স্ক সাক্ষরতা নিয়ে সরকারিভাবে অনেক তেলেসমাতি হয়েছে। এখানে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একটি সাক্ষরতা অভিযান শুরু করেছিলেন। ওই অভিযানের অংশ হিসেবে 'বড়দের বই' নামে এক কোটি বই ছাপানো হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী প্রতি দুজন বয়স্ককে সাক্ষর করাসহ অনেক কার্যক্রমের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় প্রতিমাসে থানা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা ঢাকায় সাক্ষরতার প্রতিবেদন পাঠাতেন। এসব প্রতিবেদন একত্রিত করে এক বছরে প্রায় ৭৮ লাখ বয়স্ককে সাক্ষর করার যে দাবি করা হয়, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল ছিল না। ১৯৮১ সালে যে আদমশুমারি পরিচালিত হয় তাতেও সাক্ষরতা অভিযানের কোনো প্রতিফলন ছিল না। মূলত ওই সময় থেকে জনমনে বয়স্ক সাক্ষরতা পরিচালনার প্রতি একটি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। অন্যদিকে আশির দশকে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা অপরাপর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সমন্বিতভাবে বয়স্ক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করে দরিদ্র মানুষকে ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখায়। বয়স্ক সাক্ষরতার ধীর ও কার্যকর এই প্রক্রিয়া সমাজে গুণগত প্রভাব সৃষ্টি করে। এ রকম ধারাকে এগিয়ে নিয়ে সরকার দেশের উন্নয়নে দরিদ্র মানুষকে আরো সম্পৃক্ত করতে পারত।
অতীতের কার্যক্রমের মূল্যায়ন না করে ১৯৯৭ সাল থেকে জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে বিভিন্ন জেলায় সার্বিক সাক্ষরতা আন্দোলন (টিএলএম) শুরু করা হয়। বছর ঘুরতে একেকটি জেলাকে শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সাক্ষর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই আন্দোলনের নামে সাক্ষরতার পরিসংখ্যান স্ফীতিও এ দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। ২০০১ সালের আদমশুমারির সময় টিএলএম পরিচালিত জেলাগুলোতে সাক্ষরতার কোনো উন্নত চিত্র পরিলক্ষিত হয়নি। এ অবস্থায় সব প্রাপ্তবয়স্ক লোককে সাক্ষর করে তোলা এবং এর জন্য ২০১৪ সালকে নির্ধারণ করা নিয়ে পুনর্বার ভাবতে হবে।
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত এবং প্রাপ্ত বয়স্ক সবাইকে সাক্ষর করা পর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষার এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হবে। এটি একটি যুক্তিসংগত বক্তব্য। আসলে বয়স্ক সাক্ষরতার জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা থাকা দরকার। তা করলে আমরা এক বা দেড় দশকের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতার দাবিদার হতে পারব। শিক্ষানীতিতে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নিরক্ষরদের অগ্রাধিকার দেওয়াকে কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটিও বাস্তবতার সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ। এই বয়সের জনগোষ্ঠীকে উদ্দীষ্ট করে বয়স্ক সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমরা যদি সাক্ষরতার হার আরো ২৫ শতাংশ বাড়াতে পারি সে অর্জনও আমাদের জন্য কম নয়।
শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষার সহায়কদের প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বয়স্ক সাক্ষরতার বৈচিত্র্যের দিকটিও যথাযথভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। পাঠ অনুশীলনচক্র ও গ্রাম শিক্ষা মিলনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অব্যাহত শিক্ষার দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। কার্যকর পদ্ধতি, উপকরণ ও প্রক্রিয়ার ব্যবহারে সমন্বিত সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনার জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। কার্যকর পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণে মূল্যায়ন কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, বয়স্কদের জন্য সাক্ষরতা কর্মসূচি পরিচালনা বেশ দুরূহ কাজ। সপ্তাহে কমপক্ষে পাঁচ দিন এবং দিনে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা হিসেবে ২০-২৫ জনের একটি দলের জন্য ছয় থেকে ৯ মাস নিবিড়ভাবে সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনা করলেই কেবল অংশগ্রহণকারীদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশকে সাক্ষর করা যায়। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি এনজিওর পরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে। এসব পদ্ধতি ও উপকরণ ব্যবহার করে সফলভাবে সাক্ষরতা কার্যক্রম এবং অন্যান্য দূরশিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাক্ষরতা সহায়ক ও তত্ত্বাবধায়কদের কার্যকর বিভিন্ন কৌশল শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাদের মৌলিক প্রশিক্ষণ হতে হবে কমপক্ষে তিন সপ্তাহের এবং তা হবে অনুশীলনকেন্দ্রিক। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বয়স্ক সাক্ষরতার খণ্ডকালীন সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। তবে তাদের সবাইকে নিবিড় পরিবীক্ষণের আওতায় রাখতে হবে।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সংক্ষিপ্ত অথচ যথাযথ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না বা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে আট থেকে ১৪ বছর বয়সী এমন সব শিশুর জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা পরিচালনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারা শেষে শিশু-কিশোররা যাতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, সে লক্ষ্যে দুই ধারার মধ্যে সমমান স্থাপনের কথাও এতে উলি্লখিত আছে। অন্যদিকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার কর্মোদ্যোগের সমন্বয় করতে শিক্ষানীতিতে 'বাংলাদেশ অব্যাহত ও দক্ষতা সংস্থা' গঠনের কথা বলা হয়েছে। এটি একটি সময়োপযোগী ও যুগান্তরকারী সুপারিশ। তবে এ রকম সংস্থাকে 'গণশিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ফাউন্ডেশন' নামে অভিহিত করলে তা বয়স্ক শিক্ষা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার সামগ্রিকতাকে ধারণ করবে। এই সংস্থার গঠন কাঠামো প্রস্তাবনায় নেই, তবে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের মতো কাঠামো দ্বারা এটি পরিচালিত হতে পারে।
শিক্ষানীতিতে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সরকার ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যকার অংশীদারির বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। অতীতে সরকার বেসরকারি সংস্থাকে ঠিকাদারের মতো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োগ দিয়েছে। এতে করে এমন সব সংস্থাও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তবায়নে নিয়োগ পেয়েছে, যেগুলোর কোনো সক্ষমতা নেই বা যারা মোটেই এ রকম কাজে আন্তরিক নয়। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গুণগত ও পরিমাণগত মান অর্জিত হয়নি। আর এ রকম ঠিকাদারি ব্যবস্থা থেকেই মূলত দুর্নীতির সূচনা। সরকারের এই ব্যবস্থার কারণেই অনেক সক্ষম ও ভালো সংস্থা সরকারের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি, যার ফলে জাতি উন্নত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রস্তাবিত সমন্বয় সংস্থাকে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বাস্তবায়নে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সক্ষমতা অনুযায়ী এসব সংস্থা যাতে এগিয়ে আসে সে জন্য সরকারকে আহ্বান জানাতে হবে।
শিক্ষানীতিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্প্রসারণে যথাসম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত হবে, দেশে কার্যকর সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যকে আরো বিস্তৃত ও সংহত করা। বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আয়োজন, শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণ, স্থানীয় জনসমাজের অংশগ্রহণসহ উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পাদনে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। উপানুষ্ঠানিক ও বয়স্ক শিক্ষা বাস্তবায়নের সময় উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদকে এই দায়িত্ব প্রদানের বিষয়টি বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে। গত শতকের সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত এনজিওগুলো বয়স্ক সাক্ষরতা ও গণশিক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করত। কিন্তু এখন মুষ্টিমেয় সংস্থা ছাড়া কেউই বয়স্ক শিক্ষার জন্য তহবিল সংগ্রহ করে না। বেশির ভাগ সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করায়ই নিয়োজিত হয়েছে। এসব সংস্থার জন্য বলতে হয়, বয়স্ক সাক্ষরতাকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দরিদ্র মানুষের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃৃপক্ষকে এ ব্যাপারে এখনই এসব সংস্থাকে এ বার্তাটি দিতে হবে।
লেখক : সাক্ষরতা ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ
No comments