উড়ে যাক, দূরে যাক যত জঞ্জাল-ধর নির্ভয় গান by আলী যাকের
বনানীর একটি ব্যস্ত রাস্তা। আমি গাড়িতে, চলছি শম্বুকগতিতে। আজকাল এসব গলি-ঘুঁজিতেও জ্যামের প্রাদুর্ভাব নিত্যদৃষ্ট। কিছুদূর যাই, তারপর থামি, তারপর আবার চলি। আমার সঙ্গে এক কিশোরীর একটা মজার খেলা হচ্ছে। শ্যামলা এই সুন্দর কিশোরী, পরনে স্কুল ইউনিফরম, পেছনে পিঠের সঙ্গে বাঁধা ব্যাকপ্যাক, চলেছে সাইকেলে, আমি যেদিকে যাচ্ছি সেদিকেই। মাঝে মধ্যে আমি ওকে ছাড়িয়ে যাই, তারপর ভিড়ে বসে থাকি, ও আমাকে ছাড়িয়ে যায়।
জ্যাম ছুটলে আমি আবার আগে বাড়ি, তখন ওর সঙ্গে দেখা হয়। আমি ওকে ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। ওর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি। কিন্তু ওর দৃষ্টি সামনের দিকে নিবদ্ধ। ডানে বা বাঁয়ে কোনোদিকেই তাকাবে না, এই পণ করেছে সে। আমাদের খেলা চলছে যেন সেই খরগোশ ও কচ্ছপের খেলার মতোই। আমি, খরগোশ, যখন জ্যামের কারণে স্থগিত হয়ে যাই, তখন ও, কচ্ছপ, আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায়। আবার আমি ওকে, ও আমাকে। ভারি মজার এ খেলা। এরপরে লালবাতির নিষেধে আমি যখন থামি, দেখি মেয়েটি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। আমি ওর চেহারার দিকে আবার তাকাই। দৃঢ় প্রত্যয়ী মুখ, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। আমি আবার একটু হাসি। এবারে মেয়েটি আমার দিকে তাকায় এবং আমার হাসির বিনিময়ে অপূর্ব একটি হাসি আমায় উপহার দেয়। লালবাতি সবুজ হয়। আমরা আবার চলতে শুরু করি। ও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমি ভাবি, ভাবতে থাকি। মেয়েটি নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ে এবং চেহারা দেখে মনে হয় অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণীতে। অবাক লাগে। ভালোও লাগে। অবাক লাগে এই কারণে যে, এই স্বল্প বয়সী কিশোরীটির অভিভাবকরা কী দারুণ প্রত্যয়ে ওর দুই ক্ষীণ বাহুতে তুলে দিয়েছে নিজেকে সামলানোর দায়িত্ব। কী সাহস ভরা বুক নিয়ে আত্মবিশ্বাসী এই কন্যা একটি বাইসাইকেলে চড়ে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে ব্যস্ত একটি রাস্তার ওপর দিয়ে। আমাদের শহর বড় নিরাপদ নয়। অথচ এই শহরে যৌন হয়রানি নিত্যদৃষ্ট। অথচ আমরা গাড়িগুলোকে চালাই এমন এক বেপরোয়া গতিতে যে, তুচ্ছ একটি বাইসাইকেলের খবর কে রাখে? ভালো লাগল এই ভেবে, গর্বে আমার বুক ভরে গেল এই দেখে যে, আমার দেশের এক কিশোরী কী পরম সাহসে এক উত্তাল সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়েছে, এগিয়ে চলেছে তার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।
আমরা, সুশীলজনেরা, মুখে যতই নারী স্বাধীনতার কথা বলি না কেন, আমাদের স্বাধীনতার পরে গত ৪০ বছরে আমাদের মনমানসিকতা সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হচ্ছে। আজ একেক সময় মনে হয় দেয়ালের সঙ্গে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। কেবল স্বাধীন নয়, মুক্ত। এই মুক্তি শব্দটির তাৎপর্য অসীম। এই মুক্তি হচ্ছে দেশের মুক্তি, সমাজের মুক্তি এবং সর্বোপরি মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি মানসিকতার মুক্তিও বটে। একটি সমাজ সত্যিকার অর্থে তখনই মুক্ত হয়, যখন মানুষ অন্ধকারকে পেছনে ফেলে দিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে আলোর দিকে এগোয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, বস্তুতপক্ষে ভয় হয়, যে আমরা বোধহয় '৭১-এর ২৫ মার্চ আলো দিয়ে শুরু করে ক্রমেই অন্ধকারের দিকে পথ চলেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার সব দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমি দেশে ফিরি ১০ জানুয়ারি। সেই একই দিন, যেদিন আমাদের জাতির পিতা পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন। তাঁকে একবার দেখার জন্য সদ্য প্রত্যাগত আমি এই প্রিয় শহরকে দেখে মনে করেছিলাম যেন সারাদেশের সব মানুষ একসঙ্গে নেমে এসেছে রাস্তায় রাস্তায়। এই যে তারা নেমে এসেছিল, তা এ দেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধুকে এক ঝলক দেখার জন্য তো বটেই, তাছাড়াও আমার মনে হয়েছিল, একটি সদ্য স্বাধীন জনগোষ্ঠী এক অপার আনন্দে যেন বাঁধহীন বন্যার মতো নেমে এসেছিল সড়কে সড়কে। সেই উচ্ছ্বাস, সেই আনন্দ, সেই হাসি দেখে আমার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, আমি আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ঢাকা শহরে এত মেয়ে এলো কোথা থেকে? এই শহর যে এত রঙিন, তা তো আমার জানা ছিল না? কোনো সংকোচ, কোনো শঙ্কা এতটুকু ছিল না কারও মনে। আসার সময় সেই সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় দেখেছি গ্রামের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট সারাতে গ্রামের নারী-পুরুষ একজোট হয়ে সানন্দে শ্রম দিয়ে চলেছে। একেই তো বলে স্বাধীনতা। একেই বলে মুক্তি। ভেবেছিলাম ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বুদ্ধিমুক্তিও অনিবার্যভাবে ঘটে গেছে আমাদের। ঘটেছিলও বটে। কিন্তু আমাদের ওই হাসি, ওই উচ্ছ্বাস অমলিন থাকেনি। আক্রমণের পর আক্রমণ হেনেছে সেই পরাভূত, পরাজিত শক্তি। চেষ্টা করেছে, করে চলেছে, যে মূল্যবোধ ও আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিকে তার প্রকৃত সংজ্ঞায় লাভ করার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলাম, সেই মুক্তিকে যেন ধ্বংস করা যায়। আমাদের বোধ-বুদ্ধিকে খর্বকায় করে রাখা যায়। আমাদের বিদ্যা, আমাদের অনুসন্ধিৎসাকে যেন নিঃশেষ করে দেওয়া যায়। সেই কারণে '৭৫-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, যে জাতি মুক্তবিহঙ্গের মতো এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে, আনন্দের পথে, সৃষ্টির পথে, সেই জাতির চেহারা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে গেছে। নানাবিধ দুরাচার, দুরভিসন্ধির মাধ্যমে এই জাতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে এই কথাটি যে, তারা প্রকৃতই মুক্ত, স্বাধীন। ক্রমে সামাজিক অনাচার বেড়েছে, অবিচার বেড়েছে, দুরাচার বেড়েছে, দুর্নীতি সারা সমাজকে গ্রাস করেছে এবং দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ঐশ্বর্যের ইমারত। ক্রমে ধনী আরও ধনী হয়েছে এবং দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর।
আজ সত্যিকথা বলতে গেলে এ দেশে মধ্যবিত্ত নিশ্চিহ্ন প্রায় এবং লোভের বৃক্ষ এমনই গভীরে প্রোথিত এই সমাজের যে, কেউ প্রশ্ন করে না এই অবক্ষয় রুখব কীভাবে? এ রকম সমাজে আমরা আমাদের দুর্ভাগা সন্তানদের এনেছি। তারা দিশেহারা আজ। শোনা যায় আমাদের উচ্চবিত্ত মানুষদের সমাজে মানুষ এখন তাদের দৈনন্দিন খরচের হিসাব কষে ডলার, ইউরো, পাউন্ডে, টাকায় নয়। তারা আয়োজন করে স্বাদু চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়-সমন্বয়ে আতশবাজির মতো আলোর ঝলকানি সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানাদির। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। কেননা এসব তাদের সাধ্যের বাইরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমেই সংকুচিত হয়। দারিদ্র্য তাকে নিচে টেনে ধরে। এরই মধ্যে যাদের চোখের চামড়া নেই, তারা ঘুরঘুর করে প্রাচুর্যের টেবিল থেকে ছুড়ে ফেলা উচ্ছিষ্টের খোঁজে। তাদের লোভ তাদের দুর্বৃত্তের সন্ধান দেয়। সানি্নধ্যে নিয়ে যায় সে অমানুষদের, যারা এই সমাজকে ধ্বংস করে বড়ই আহ্লাদিত হয়। এদের অপরাধবোধ নেই, পাপবোধ নেই, নেই কোনো বিবেক। এরা নিজেরা ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত, চারদিকে খুঁজে ফেরে নতুন সাঙ্গাতদের। এদেরই কল্যাণে আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সব ধরনের অনাচার। এই চরম বিধ্বংসী কালঔষধির বিস্তার রোধ করে কার সাধ্য? ছড়িয়ে পড়েছে তা আমাদের নগর, জনপদ, গ্রামে-গঞ্জে। ছড়িয়ে পড়ছে এক নৃশংস, পরিকল্পিত মানব সংহারের অস্ত্র হিসেবে। এক এক সময় ভাবি, তবে কি আর কোনো উপায় নেই? তবে কি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এই দেশ? এই জাতি? আমার পিতার মূল্যবোধ, আমার মায়ের ত্যাগ? কী এক বীভৎস আঁধার যেন গ্রাস করেছে আমাদের। এ রকম মানসিক চিন্তা যখন, ঠিক তখনই ওই বাইসাইকেল আরোহিণী আমার বুকে আশার জন্ম দেয় আবার। হয়তো সব শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো সব আগাছার মধ্যেও একটি-দুটি প্রত্যয়ী বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এখন। সাগ্রহে তাকিয়ে আছে দৃপ্ত সূর্যের দিকে। ভাবি, এরা যদি আছে, তাহলে আমাদের ভয় কী? সাগ্রহে এবং সানন্দে এদের হাতে তুলে দেব আমার যা আছে গর্বের ধন। ওই মেয়েটির আবার দেখা পেলে আমি ওকে দাঁড় করিয়ে বলব, 'তুমিই আমার ভবিষ্যৎ। তুমিই আমার পরবর্তী প্রজন্ম। তুমিই আমার সব ভালোবাসা। তুমিই আমার মুক্তি। তুমিই আমার বড় ভরসার স্থান।' বলব, 'এসো হাতে হাত ধরি, এগিয়ে যাই একসঙ্গে। তোমরা আমাদের নেতৃত্ব দাও। উড়ে যাক, দূরে যাক যত জঞ্জাল।'
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমরা, সুশীলজনেরা, মুখে যতই নারী স্বাধীনতার কথা বলি না কেন, আমাদের স্বাধীনতার পরে গত ৪০ বছরে আমাদের মনমানসিকতা সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হচ্ছে। আজ একেক সময় মনে হয় দেয়ালের সঙ্গে আমাদের পিঠ ঠেকে গেছে। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে আমরা মুক্ত হয়েছিলাম। কেবল স্বাধীন নয়, মুক্ত। এই মুক্তি শব্দটির তাৎপর্য অসীম। এই মুক্তি হচ্ছে দেশের মুক্তি, সমাজের মুক্তি এবং সর্বোপরি মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি মানসিকতার মুক্তিও বটে। একটি সমাজ সত্যিকার অর্থে তখনই মুক্ত হয়, যখন মানুষ অন্ধকারকে পেছনে ফেলে দিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে আলোর দিকে এগোয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, বস্তুতপক্ষে ভয় হয়, যে আমরা বোধহয় '৭১-এর ২৫ মার্চ আলো দিয়ে শুরু করে ক্রমেই অন্ধকারের দিকে পথ চলেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার সব দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমি দেশে ফিরি ১০ জানুয়ারি। সেই একই দিন, যেদিন আমাদের জাতির পিতা পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন। তাঁকে একবার দেখার জন্য সদ্য প্রত্যাগত আমি এই প্রিয় শহরকে দেখে মনে করেছিলাম যেন সারাদেশের সব মানুষ একসঙ্গে নেমে এসেছে রাস্তায় রাস্তায়। এই যে তারা নেমে এসেছিল, তা এ দেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধুকে এক ঝলক দেখার জন্য তো বটেই, তাছাড়াও আমার মনে হয়েছিল, একটি সদ্য স্বাধীন জনগোষ্ঠী এক অপার আনন্দে যেন বাঁধহীন বন্যার মতো নেমে এসেছিল সড়কে সড়কে। সেই উচ্ছ্বাস, সেই আনন্দ, সেই হাসি দেখে আমার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, আমি আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ঢাকা শহরে এত মেয়ে এলো কোথা থেকে? এই শহর যে এত রঙিন, তা তো আমার জানা ছিল না? কোনো সংকোচ, কোনো শঙ্কা এতটুকু ছিল না কারও মনে। আসার সময় সেই সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় দেখেছি গ্রামের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাস্তাঘাট সারাতে গ্রামের নারী-পুরুষ একজোট হয়ে সানন্দে শ্রম দিয়ে চলেছে। একেই তো বলে স্বাধীনতা। একেই বলে মুক্তি। ভেবেছিলাম ওই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বুদ্ধিমুক্তিও অনিবার্যভাবে ঘটে গেছে আমাদের। ঘটেছিলও বটে। কিন্তু আমাদের ওই হাসি, ওই উচ্ছ্বাস অমলিন থাকেনি। আক্রমণের পর আক্রমণ হেনেছে সেই পরাভূত, পরাজিত শক্তি। চেষ্টা করেছে, করে চলেছে, যে মূল্যবোধ ও আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিকে তার প্রকৃত সংজ্ঞায় লাভ করার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিলাম, সেই মুক্তিকে যেন ধ্বংস করা যায়। আমাদের বোধ-বুদ্ধিকে খর্বকায় করে রাখা যায়। আমাদের বিদ্যা, আমাদের অনুসন্ধিৎসাকে যেন নিঃশেষ করে দেওয়া যায়। সেই কারণে '৭৫-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, যে জাতি মুক্তবিহঙ্গের মতো এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে, আনন্দের পথে, সৃষ্টির পথে, সেই জাতির চেহারা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে গেছে। নানাবিধ দুরাচার, দুরভিসন্ধির মাধ্যমে এই জাতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে এই কথাটি যে, তারা প্রকৃতই মুক্ত, স্বাধীন। ক্রমে সামাজিক অনাচার বেড়েছে, অবিচার বেড়েছে, দুরাচার বেড়েছে, দুর্নীতি সারা সমাজকে গ্রাস করেছে এবং দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ঐশ্বর্যের ইমারত। ক্রমে ধনী আরও ধনী হয়েছে এবং দরিদ্র হয়েছে দরিদ্রতর।
আজ সত্যিকথা বলতে গেলে এ দেশে মধ্যবিত্ত নিশ্চিহ্ন প্রায় এবং লোভের বৃক্ষ এমনই গভীরে প্রোথিত এই সমাজের যে, কেউ প্রশ্ন করে না এই অবক্ষয় রুখব কীভাবে? এ রকম সমাজে আমরা আমাদের দুর্ভাগা সন্তানদের এনেছি। তারা দিশেহারা আজ। শোনা যায় আমাদের উচ্চবিত্ত মানুষদের সমাজে মানুষ এখন তাদের দৈনন্দিন খরচের হিসাব কষে ডলার, ইউরো, পাউন্ডে, টাকায় নয়। তারা আয়োজন করে স্বাদু চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়-সমন্বয়ে আতশবাজির মতো আলোর ঝলকানি সমৃদ্ধ অনুষ্ঠানাদির। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। কেননা এসব তাদের সাধ্যের বাইরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমেই সংকুচিত হয়। দারিদ্র্য তাকে নিচে টেনে ধরে। এরই মধ্যে যাদের চোখের চামড়া নেই, তারা ঘুরঘুর করে প্রাচুর্যের টেবিল থেকে ছুড়ে ফেলা উচ্ছিষ্টের খোঁজে। তাদের লোভ তাদের দুর্বৃত্তের সন্ধান দেয়। সানি্নধ্যে নিয়ে যায় সে অমানুষদের, যারা এই সমাজকে ধ্বংস করে বড়ই আহ্লাদিত হয়। এদের অপরাধবোধ নেই, পাপবোধ নেই, নেই কোনো বিবেক। এরা নিজেরা ডাকাতিতে সিদ্ধহস্ত, চারদিকে খুঁজে ফেরে নতুন সাঙ্গাতদের। এদেরই কল্যাণে আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সব ধরনের অনাচার। এই চরম বিধ্বংসী কালঔষধির বিস্তার রোধ করে কার সাধ্য? ছড়িয়ে পড়েছে তা আমাদের নগর, জনপদ, গ্রামে-গঞ্জে। ছড়িয়ে পড়ছে এক নৃশংস, পরিকল্পিত মানব সংহারের অস্ত্র হিসেবে। এক এক সময় ভাবি, তবে কি আর কোনো উপায় নেই? তবে কি একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এই দেশ? এই জাতি? আমার পিতার মূল্যবোধ, আমার মায়ের ত্যাগ? কী এক বীভৎস আঁধার যেন গ্রাস করেছে আমাদের। এ রকম মানসিক চিন্তা যখন, ঠিক তখনই ওই বাইসাইকেল আরোহিণী আমার বুকে আশার জন্ম দেয় আবার। হয়তো সব শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো সব আগাছার মধ্যেও একটি-দুটি প্রত্যয়ী বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এখন। সাগ্রহে তাকিয়ে আছে দৃপ্ত সূর্যের দিকে। ভাবি, এরা যদি আছে, তাহলে আমাদের ভয় কী? সাগ্রহে এবং সানন্দে এদের হাতে তুলে দেব আমার যা আছে গর্বের ধন। ওই মেয়েটির আবার দেখা পেলে আমি ওকে দাঁড় করিয়ে বলব, 'তুমিই আমার ভবিষ্যৎ। তুমিই আমার পরবর্তী প্রজন্ম। তুমিই আমার সব ভালোবাসা। তুমিই আমার মুক্তি। তুমিই আমার বড় ভরসার স্থান।' বলব, 'এসো হাতে হাত ধরি, এগিয়ে যাই একসঙ্গে। তোমরা আমাদের নেতৃত্ব দাও। উড়ে যাক, দূরে যাক যত জঞ্জাল।'
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments