মুক্তিযুদ্ধ-আমি তার জন্য অপেক্ষা করব by মহিউদ্দিন আহমদ

কটি রাষ্ট্র সাবালক হতে কত বছর সময় নেয়? ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকে। খোদ ইতালিতে গণতন্ত্রের অবস্থা এখনো নড়বড়ে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ১৯৭১ সালে। দেখতে দেখতে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এ অঞ্চলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা নবীনতম। চার দশকে আমরা এগিয়েছি কত দূর?


এশিয়ায় বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র খুব বেশি নেই। আমরা অনেক দিক থেকেই স্বতন্ত্র। আমরা মধ্যরাতে চুক্তি করে স্বাধীনতা পাইনি। অনেক লড়াই করে, অনেক রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কারও কারও জন্য এটা ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’ হতে পারে। কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষ তার শ্রম-ঘাম-রক্ত-মেধা দিয়ে এ দেশের জন্ম দিয়েছে। এ দেশ তাই সবার অহংকার। এর জন্ম প্রক্রিয়ায় আরও অনেকের সঙ্গে সহযাত্রী হিসেবে অংশ নিতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। এ আমার অহংকার। যখন শুনি দেশ ভালো চলছে না, মানুষ ভালো নেই, তখন আমার অহংকারে আঘাত লাগে, আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, আমি অপমানিত হই। আমি বা আমরা নিছক জন্মসূত্রে এ দেশের নাগরিক নই। আমরা এ দেশের জন্মদাতা। এ জন্যই কোনো দল নয়, কোনো বাহিনী নয়, এ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক এবং মালিক দুটোই হচ্ছে এ দেশের মানুষ।
অনেকের কাছেই ১৯৭১ হয়তো নিছক একটি যুদ্ধ কিংবা রাজনৈতিক পালাবদল। আমরা জানি, এই যুদ্ধ একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে হঠাৎ করে শুরু হয়নি। অনেক বছর ধরে এ জন্য চলেছিল সচেতন চিন্তা, পরিকল্পনা ও আয়োজন। তাই কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিল, কবে দিল কিংবা আদৌ ঘোষণা দিল কি না তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এটা ছিল একটা জাতির যূথবদ্ধ প্রয়াস, একসঙ্গে জেগে ওঠার অনুশীলন, এক মহাজাগরণ। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এ দেশের অনেক মানুষ ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে এই উদ্ভাসনের সিঁড়িগুলো একটি একটি করে নির্মাণ করেছে।
৪০ বছর পর যখন ফিরে তাকাই তখন ফ্লাশব্যাকে অনেক কিছুই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বর্তমান সময়ের মূল্যবোধ, চেতনা ও প্রেক্ষিত দিয়ে ৪০ বছর আগের মুহূর্তগুলো ধরতে গেলে ভুল করা হবে। কেননা, এখন আমি যে রকম ভাবি ও চিন্তা করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত ছাত্র হিসেবে আমি ও রকম করে ভাবিনি কিংবা চিন্তা করতে শিখিনি। তখন যেটা মনে হয়েছিল, সেটাই করেছি।
ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে রাজপথে যখন স্লোগান উঠেছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, আমি তাতে গলা মিলিয়েছিলাম। ওটা ছিল আমার বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রথম সিঁড়ি টপকানো। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। সত্তরের ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের পল্টনের জনসভায় অনেকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমি ‘জয়বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়েছিলাম। এটা ছিল আমার দ্বিতীয় সিঁড়ি ডিঙানো। সত্তরের জুন মাসের ৭ তারিখ পল্টন ময়দানে ঢাকা নগর ছাত্রলীগের উদ্যোগে জয়বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্টে অংশ নিয়েছিলাম, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা মার্চপাস্টে সালাম নিতে আসা প্রধান অতিথি শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেওয়া হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। এ পতাকাটি তৈরি হয়েছিল ৬ জুন রাতে ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৮ নম্বর রুমে। আমি তার সাক্ষী। এভাবেই তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার সিঁড়িগুলো।
জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এটা একটা আপ্তবাক্য। সত্তরের নির্বাচনের সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানে’ ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি ৯৫ লাখ। ভোট দিয়েছিল ৫৮ শতাংশ ভোটার। নৌকায় ভোট পড়েছিল এক কোটি ২৩ লাখের মতো (মোট ভোটারের ৪২ শতাংশ এবং প্রদত্ত ভোটের ৭৫ শতাংশ)। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) পেয়েছিল প্রায় তিন লাখ ১১ হাজার ভোট (প্রদত্ত ভোটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ)। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ ভোটার সরাসরি পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তখন এদের পরিচয় ছিল ‘ইসলাম পছন্দ পার্টি’ হিসেবে। গত চার দশকে এদের সংখ্যা বেড়েছে। নানা লেবাসে এরা পুরোনো রাজনীতিই করছে, যাদের কাঁধে ভর করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এই ভূখণ্ডে টিকেছিল ২৪ বছর।
একাত্তরে আমরা জাতীয়তাবোধে উন্মাতাল ছিলাম। আমাদের আবেগ ছিল অসীম, প্রাণশক্তি ছিল অফুরন্ত। কিন্তু আমাদের নেতৃত্বের কাছে কোনো রূপকল্প ছিল না। তাই ২৫ মার্চের ধাক্কা সামলাতে আমরা হিমশিম খেয়েছিলাম। ছিটকে পড়েছিলাম এদিক-সেদিক।
শেখ মুজিববিহীন সংগঠন ও জনতার মধ্যে ঐক্য ও সংহতি কতটুকু ছিল, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। আমি দুটো উদাহরণ দিতে চাই। তাজউদ্দীন আহমদ যখন সরকার গঠন করলেন, তখন চার যুবনেতা এবং আরও অনেকেই এর বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছিলেন। তাঁদের যুক্তি ছিল তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী সরকার গঠন করেননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল এ দেশের মানুষের এবং সংস্কৃতিসেবীদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্লাটফর্ম, মুক্তিযুদ্ধে যার অবদান আগ্নেয়াস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে কম নয়। কিন্তু ওখানেও বেতন বাড়ানোর জন্য ধর্মঘট হয়েছিল একাত্তরের সেপ্টেম্বরে। এসব নেতিবাচক ঘটনা আমরা সচেতনে এড়িয়ে যাই। কেননা, একেকটা নেতিবাচক উদাহরণ মুহূর্তের মধ্যেই একপাল রাজাকার পয়দা করে। এভাবে আমরা অনেকেই ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির’ কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।
আমরা একদা স্তোকবাক্য শুনেছিলাম দেশ মুক্ত হলে সুখ আসবে, স্বাচ্ছন্দ্য আসবে, শান্তি আসবে। চার দশকে আমাদের হিসেবের ব্যালান্স মেলানো যাচ্ছে না। আমি কয়েক দিন ধরেই অনেক বন্ধুর মতামত জানার চেষ্টা করছি, এই চার দশকে আমরা এমন কী পেয়েছি, যা আমরা পেতাম না, যদি আমরা স্বাধীন না হতাম। সবাই মোটামুটি একই রকম উত্তর দিয়েছেন, আমাদের সুযোগ ও সম্ভাবনা বেড়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, কিন্তু এটা একটা আপেক্ষিক ধারণা। আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেও একই জিনিস ঘটেছে। পাকিস্তানের ২৪ বছর আমাদের পিছিয়ে রেখেছিল। ৪০ বছরেও আমরা পাকিস্তানের কাছাকাছি যেতে পারিনি। মানব উন্নয়নের সার্বিক সূচক অনুযায়ী আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানটিতে পড়ে আছি। ঘটনাচক্রে আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অংশ হয়ে যাওয়ায় আমরা অন্তত এটুকু বলতে পারি, আমরা ওদের চেয়ে ভালো আছি।
অর্জন অবশ্যই অনেক আছে। নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে অবিশ্বাস্য সংখ্যায়। আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি এখন অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো তাদের ঘাম ঝরানো টাকা। আমাদের গণমাধ্যম বিকশিত হয়েছে, সংখ্যায় এবং গুণে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ফরমাল সেক্টরে এখন পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রের চেয়ে বেশি। আমরা তো এগুলোই চেয়েছিলাম।
কিন্তু যা আমরা চাইনি, তাও ঘটছে। একাত্তরে সমাজের বাঁধনটা নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। একটা যুদ্ধ আমাদের সমাজের বুনন, মূল্যবোধ এবং সম্পর্কগুলোকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ফল বয়ে এনেছে।
আমাদের রাজনীতিতে সুবিধাবাদ এবং মেধাহীন নেতৃত্ব জ্যামিতিক গতিতে বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক আন্দোলন এখন অনেক সহিংস। মানুষ পেটানোর মধ্যে পুলিশ যেমন আনন্দ পায়, গাড়ি ভাঙায় রাজনৈতিক দলের ক্যাডার ততধিক পুলক অনুভব করে। এই স্বাধীনতা তো আমরা চাইনি।
যখন একটি বই তথ্য মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যখন একটি কিশোরী স্কুলে যাওয়ার পথে সহিংসতার শিকার হয়, যখন একজন করদাতা কর দেওয়ার জন্য উৎকোচ দিতে বাধ্য হয়, যখন প্রলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়ায় একজন ফরিয়াদি সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে, যখন একজন রাজকর্মচারী হজে যাওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করতে ঠিকাদারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে, যখন একটি বসন্তের কোকিল কোটি টাকায় মনোনয়ন কিনে নির্বাচনের মাঠে উদয় হয় জনসেবার উদ্গ্র বাসনা নিয়ে, যখন মানুষ হত্যা করার জন্য কারও হাতে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স ধরিয়ে দেওয়া হয়, যখন পরিবারতন্ত্রের জপমালা হাতে ধাড়ি রাজনীতিকেরা হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েদের বন্দনা করে, তখন মনে হয় আমাদের দেশ ছিনতাই হয়ে গেছে। এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিনে চড়ে যদি আমি ৪০ বছর আগের সময়টাতে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে চিৎকার করে বলতাম এই দেশ, এই স্বাধীনতা, আমি চাইনি।
তার পরও জীবন থেমে থাকে না। আমাদের পথ চলতেই হয়। বাগাড়ম্বর করে অনেকেই বলেন, আমাদের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। আমি জানি এরা মন থেকে এটা বলছে না। কেননা, ৪০ বছর আগের মুক্তিযুদ্ধে এরা অনেকেই অনুপস্থিত অথবা বিপরীত মেরুতে ছিল।
আমি একটা আশার আলো দেখতি পাচ্ছি। নতুন প্রজন্ম যাদের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পর, তাদের একটা বিরাট অংশ অন্যরকম চিন্তা করে। এরা সংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক। অতীতের জঞ্জাল নয়, ভবিষ্যতের দিগন্তরেখার দিকে তাদের দৃষ্টি। তাদের আছে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। এরা যখন দেশের হাল ধরবে, তখন এরাই পারবে এই সমাজের এবং রাষ্ট্রের খোলনলচে পালটে দিতে।
আমরা যে একটি ব্যর্থ প্রজন্ম, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বুড়িগঙ্গার মতো ছোট্ট একটা নদী আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এটা স্বীকার করে নিয়েই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যুবশক্তির আবাহনের জন্য।
আমার পিতা ভারত ভেঙেছিলেন। তিনি স্বাধীনতা পাননি। আমি পাকিস্তান ভেঙেছিলাম। দেশ স্বাধীন হলো, মানুষের পরাধীনতা ঘুচল না। আমার সন্তান এই রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙবে মানুষের কল্যাণের জন্য। আমি তার জন্য অপেক্ষা করব।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.