রাষ্ট্রনীতি-ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের প্রশ্ন by রাশেদ খান মেনন

০ বছর আগে যেসব কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেসবের অন্যতম ছিল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরোধিতা। মুক্তি-যুদ্ধের এই অন্যতম মূলকথাটি প্রতিফলিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংবিধানে। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংযোজন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করে প্রণীত বিধান ওই সংবিধানকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল।


কিন্তু বাংলাদেশের ৪০ বছরে সংবিধানের এই মূলনীতি থেকে ক্রমেই পশ্চাদ্পসরণ ঘটে। এবং পঁচাত্তর-পরবর্তী সাংবিধানিক পরিবর্তনে সংবিধানের এই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপূর্ণভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সংযোজিত হয় সংবিধানের ধর্মীয় পাঠ আল্লাহ্র ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের মৌল নীতিগত বিধান। সংবিধানের এই ধর্মের পথ অনুসরণের পরিণতি ঘটে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনগুলো সাধিত হয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংবিধানের এই পরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকৃতি বলে বিবেচিত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক এবং সংগত ছিল যে সংবিধানের কোনো গণতান্ত্রিক পরিবর্তনে এই বিকৃতির অবসান ঘটানো হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সংবিধানের দুই দফায় যে গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তাতে সংবিধানের এই ধর্মীয়করণের বিধান পরিবর্তন করা হয়নি, বরং সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনীতে তাকে নতুন করে জায়েজ করা হয়েছে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে এ দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ঘটে। ওই সংশোধনীতে সংবিধানের অগণতান্ত্রিক বিধানগুলো পরিবর্তন করা হলেও এই সংশোধনী সংবিধানের ধর্মীয় এই ধারাগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থেকেছে। অপরদিকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ অষ্টম সংশোধনীর বিধানগুলোকে দূর করলেও সংবিধানের এই ধর্মীয় বিধানগুলোকে নতুনভাবে অনুমোদন দিয়েছে।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল ভিত্তি থেকে এই পশ্চাদ্পসরণ নিঃসন্দেহে গভীর পর্যালোচনার দাবি করে। বস্তুত, ধর্মের প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনীতির এই পরিবর্তনটি আকস্মিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্কের ইতি ঘটালেও যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে এর প্রসার ঘটেছিল সেই অবস্থা অক্ষুণ্ন থাকায় তার পুনরাগমনের ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। বরং ওই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বহাল থাকার ফলে মানুষের জীবনে শোষণ-বঞ্চনার যে বিস্তৃতি ঘটেছে, তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় মানুষ ধর্ম ও ধর্মানুভূতির প্রতি আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নতুন শাসকগোষ্ঠীও বিদ্যমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে নিজেরাও ধর্মের মধ্যে ওই প্রশ্নের সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে।
নব্যস্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত এই রাজনৈতিক প্রশ্নটি সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। বরং পাকিস্তান আমলের রাজনীতির ধারা অনুসরণ করে তারাও রাজনীতিতে ধর্মের মিশেল দেওয়ায় বিশেষ দোষ দেখেনি। আমরা এর প্রতিপালন দেখি রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত না করে সব ধর্মের সহাবস্থানের নীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি হিসেবে ব্যাখ্যাদানে। ফলে একপর্যায়ে এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মটি স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মূল ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে। পরবর্তীকালে শাসককুল ওই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে সংবিধানের বিধানে প্রাধান্যে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের এই পুনরাগমনের ফল কী? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাদ পড়া এবং অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের এই ব্যবহারের ফলে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কেবল ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি, এর ফল হিসেবে তাদের মধ্যে যে মানসিক বোধ গড়ে উঠেছে সেটা মারাত্মক। গত ৪০ বছরে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্রোতধারা থেকে নিজেদের ক্রমাগত বিচ্ছিন্নবোধ করেছে। তারা অনেকটা নিজ দেশে পরবাসী বলে নিজেদের মনে করেছে। দেশের মানুষের কোনো অংশের মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা যে জাতীয় ঐক্যে বিঘ্ন ঘটায় সে কথা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
অপরদিকে ধর্মের এই রাজনৈতিক ব্যবহার বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে। এই মৌলবাদী রাজনীতিই বিগত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে জঙ্গিবাদে রূপ নিয়ে সমগ্র দেশে এক চরম অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করেছিল। এই জঙ্গিবাদের মূলকথা, জিহাদের মাধ্যমে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে পুনঃসংগঠিত হয়ে দেশের ইসলামপন্থী দলগুলো নিচু স্বরে এ কথা বলে এলেও এখন তারা এ বিষয়ে কেবল সোচ্চারই নয়, সারা দেশে গোপন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নিজেদের সশস্ত্র করেছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিও নিয়েছে। সম্প্রতি এই জঙ্গিবাদী তৎপরতা কমে এলেও তার নেটওয়ার্ক অটুটই আছে। এবং অনুকূল পরিস্থিতি পেলেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।
রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিষয়টি তাই বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। মুসলিম ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুসলমানদের আলাদা বাসভূমির নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অথবা ইসলামের নামে মুসলিম লীগ ও পরে পাকিস্তানি সামরিক শাসন অব্যাহত রাখা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ওই ধর্মকে হানাদার বাহিনীর ধর্ষণ-লুণ্ঠনের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার, আল-বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী এবং সর্বশেষ জিহাদের নামে জঙ্গি তৎপরতা—এ সবই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ফল। ধর্ম যখন রাজনীতির বাহন হয় তখন তার ফল ওপরোল্লিখিত অভিজ্ঞতারই জন্ম দেয়।
তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পরে এসে ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কল্যাণ, সর্বোপরি শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশের একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই আরেকবার জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজনীতিতে প্রায়ই বাস্তবতার কথা বলা হয়। এই রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা বলেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যেটা বাস্তবে ঘটবে তা ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার, ধর্মীয় আচরণ ও মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা নয়, বরং সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতি, যা সম্প্রতি জঙ্গিবাদী রূপ নিয়েছে, তার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। বস্তুত, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা করা এক বিষয়; আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পূর্ণ আরেক বিষয়। এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধর্ম বিষয়ে এই পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করতে হবে। এটা কেবল বক্তৃতা, গোলটেবিল বৈঠক বা সেমিনারে আলোচনার বিষয় নয়; জনগণের জীবন-জীবিকা, তার প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার সংগ্রামের সঙ্গে মিলিয়ে এই পার্থক্যটি সুস্পষ্ট করতে হবে।
এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু সেই মানুষই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সব সময় সমর্থন করেছে এবং এখনো করে। যেটা মূল প্রশ্ন তা হলো জনগণের এই চেতনাবোধের ওপর বিশ্বাস রাখা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ওই চেতনাবোধকে আরও শাণিত করা এবং তাকে অগ্রবর্তী করে নিয়ে যাওয়া। ৪০ বছর পরে এসে এ লড়াইকে আরও শাণিত করতে হবে। তাহলেই কেবল সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা একটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে পারব।
রাশেদ খান মেনন: সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

No comments

Powered by Blogger.