কালের আয়নায়-আইভী নির্বাচনে জয়ী হলে আওয়ামী লীগের নৈতিক জয় হবে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
যদি এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হন, তাহলে আওয়ামী লীগের পার্টি-হায়ার্কির তাতে মুখ চুন হতে পারে; কিন্তু দলের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল নীতি ও নৈতিকতার জয় হবে। দলকে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের দখলমুক্ত রাখা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে তা আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে সাহায্য করবে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনেও দলটি তার বেনিফিসিয়ারি হবে।
শামীম ও আইভীর মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আইভীর সাফল্য কামনা করি আজ শনিবার। আগামীকাল রোববার, ৩০ অক্টোবর শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জে যে ভোটযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দলের তাৎক্ষণিক ভাগ্য বদলাবে না এ কথা সত্য; কিন্তু এই একটি নির্বাচনের ফল দেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি অগি্নপরীক্ষা। যদি সরকারি দলের ঘোষিত প্রার্থীর নির্বাচনে অসাধু পন্থায় আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ ওঠে, তাহলে ক্রেডিবিলিটি হারাবে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। দেশের মানুষ তাতে ধরে নেবে, এই সরকার ও তাদের নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাতে বড় লাভ হবে বিএনপির। নির্বাচনে তাদের প্রার্থীর জয়ের চেয়েও এই লাভ তাদের অনেক বেশি কাম্য হবে।
আর এই নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তাহলে অসম্ভবকে সম্ভব করে বিএনপি প্রার্থী এই সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে জয়ীও হন, তাহলেও বিরাট রাজনৈতিক লাভ আওয়ামী লীগের। তাদের দাবি প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ যে কোনো দলই ক্ষমতায় থাকুক, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা অধিক এবং এই প্রক্রিয়াতেই অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত_ আওয়ামী লীগের এই বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে বিএনপির জঙ্গি আন্দোলন তখন মাঠে মারা যাবে।
এ জন্যই রাজধানী ঢাকার অদূরে সদ্য সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়া নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন এত গুরুত্ব পাচ্ছে যে, তা অভূতপূর্ব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অনেক কূটনীতিক এবং অসংখ্য বিদেশি পর্যবেক্ষক যাচ্ছেন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে। নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থান নিয়েছে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করার ব্যাপারে। শুক্রবার থেকেই সেনা মোতায়েন করার কথা। নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রাম্যমাণ সেনা ইউনিটের টহলদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৭ জন করে কর্মী উপস্থিত থাকবেন, তাদের মধ্যে ৭ জনই হবে পুলিশ। নির্বাচন প্রচারণা শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, কোনো নির্বাচন কেন্দ্রে সামান্যতম গণ্ডগোল হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সম্ভব সব ব্যবস্থা করেছে, যা প্রশংসনীয়। যদি কোনো প্রার্থী তার পরাজয় নিশ্চিত জেনে ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাস সৃষ্টি বা অন্য কোনো উপায়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা না চালান তাহলে এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে আমার ধারণা। প্রার্থীদের জয়-পরাজয় দ্বারা এই নির্বাচনকে বিচার করা ঠিক হবে না। এই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও অবাধভাবে হলো তার দ্বারাই এর গুরুত্ব নির্ধারিত হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এই মেয়র নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের জয়ের আশা আছে বলে কেউ মনে করেন না। কিন্তু সব গণনা ব্যর্থ করে তিনি যদিও জয়ী হন, তাহলে সেটা হবে বিএনপির একটি বিচ্ছিন্ন দলীয় জয়। কিন্তু বিরাট রাজনৈতিক জয় হবে আওয়ামী লীগের। প্রমাণিত হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের দ্বারাই ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠান সম্ভব এবং ব্যর্থ ও দূষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দরকার নেই। এটা যদি হয় তা হলে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক নীতি ও রাজনীতির জয় হবে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তা সুদূরপ্রসারী শুভ প্রভাব ফেলবে।
আগামীকাল রোববার শীতলক্ষ্যার তীরে যে ভোটযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে তিনজন প্রার্থীর জয়-পরাজয়কে আমি নিম্নোক্তভাবে বিবেচনা করছি। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে একজন বিএনপির একক প্রার্থী। অপর দু'জন শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগ প্রার্থী। দু'জনে সমান জনপ্রিয় প্রার্থী না হলেও সমান শক্তিশালী প্রার্থী। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কেন শেষ মুহূর্তে শামীম ওসমানকে তাদের আসল প্রার্থী বলে চিহ্নিত করতে গেল, সে রহস্য আমি জানি না। আমি যত দূর জানি, আইভী হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের মানুষের পছন্দের প্রার্থী। তার প্রতি আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশেরও সমর্থন রয়েছে।
এখন নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয় এবং শামীম ওসমান জয়ী হন, তাহলে এটা হবে আওয়ামী লীগের পার্টি-হায়ার্কির জয়। দলটির সাধারণ নেতাকর্মীর এবং দলের নৈতিক জয় নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে, শামীম ওসমানের জয় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। বর্তমানের এই জয় ভবিষ্যতে, বিশেষ করে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য লায়াবিলিটি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যদি এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হন, তাহলে আওয়ামী লীগের পার্টি-হায়ার্কির তাতে মুখ চুন হতে পারে; কিন্তু দলের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল নীতি ও নৈতিকতার জয় হবে। দলকে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের দখলমুক্ত রাখা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে তা আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে সাহায্য করবে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনেও দলটি তার বেনিফিসিয়ারি হবে। শামীম ও আইভীর মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আইভীর সাফল্য কামনা করি। তবে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে যিনিই জয়ী হন, তাকেই অভিনন্দন জানাব। জনগণের রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধা পোষণ করি।
যদি সব গণনা ব্যর্থ করে বিএনপির তৈমুর আলম নির্বাচিত হন, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য দলীয় পরাজয় ঘটাবে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক বিজয় আসবে। আগেই বলেছি, এটা প্রমাণিত হবে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এটা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনেও প্রমাণিত হয়েছে। এখন নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনেও যদি আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় ঘটে, তাহলে দলটির রাজনৈতিক বিজয় এই পরাজয়ের ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে গেলে তারও যে একটি শুভ দিক আছে, সে কথা উপরে আলোচনা করেছি। এখন অশুভ দিকটির কথা বলি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে হারলে আগামী ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কেও দলটির শঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটবে। চট্টগ্রাম মেয়র ইলেকশনে আওয়ামী লীগের পরাজয়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না এই কারণে যে, সেই পরাজয় আওয়ামী লীগের ততটা ছিল না, যতটা ছিল ব্যক্তিবিশেষের। যদি এবার নারায়ণগঞ্জে অসম্ভবকে সম্ভব করে তৈমুর জেতেন, তাহলে বুঝতে হবে আগামী নির্বাচনগুলো সম্পর্কে আওয়ামী লীগের আত্মসন্তোষ পোষণের কোনো কারণ নেই; বরং তাদের জনসমর্থনে সত্য সত্যই ধস নেমেছে।
এখনও তারা যদি সংগঠনকে শক্তিশালী না করেন, সরকার ও সংগঠনের মধ্যে যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা না কমান, একজন দক্ষ ও ব্যক্তিত্বশালী সাধারণ সম্পাদক বেছে না নেন, মন্ত্রিসভায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি না হয় এবং দলে সুবিধাবাদী ও চাটুকারদের বদলে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অংশের মতামতের গুরুত্ব না বাড়ে, সর্বোপরি আগামীতে সব পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণের পছন্দের ও পরীক্ষিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া না হয়, তাহলে বলব, ক্ষমতার ঠুলি পরা অন্ধ চোখে আওয়ামী লীগ দেয়ালের লিখন পড়তে পারছে না।
নারায়ণগঞ্জের দিকে এখন সারাদেশের চোখ। আগেই বলেছি, এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের জন্য সততা এবং নিরপেক্ষতার অগি্নপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ উত্তীর্ণ হলে নির্বাচনের ফল যাই হোক দলটির রাজনৈতিক জয় হবে এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনেই যে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে এবং হওয়া উচিত এটা প্রমাণিত হবে। নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ, তারা বিএনপি প্রার্থীর কাছ থেকে বন্দর থানার ওসিকে সেখান থেকে সরানোর দাবি পাওয়া মাত্র এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তুলেই দাবি পূরণ করেছে। এটা থেকে এই নির্বাচন যাতে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের অতি সতর্কতা বোঝা যায়। এই সতর্কতা নির্বাচনের ফল ঘোষণা পর্যন্ত কমিশনকে বজায় রাখতে হবে।
রোববারের নির্বাচনে যদি সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয় হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের উচিত হবে এই জয়কে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো। এটা পার্টি-হায়ার্কির কেউ যেন তার বা তাদের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে না করেন। নির্বাচনে আইভীর জয় সুনিশ্চিত কি-না আমি জানি না। কিন্তু তিনি জয়ী হলে এটা দলের পরাজয় বলে বিবেচনা না করে আওয়ামী লীগের বহুকালের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও নৈতিক শক্তির জয় বলে বিবেচনা করতে হবে। তাতে সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ায় যে ঘোষিত লক্ষ্য আওয়ামী লীগের, তার বাস্তবায়নে দল ও সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ মিলবে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীদের দল থেকে দূরে রাখার কাজে দলের শীর্ষ নেতারা যদি কঠোর হন এবং দলের নীতিনিষ্ঠ ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দল ও সরকার পরিচালনায় এগিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেন সেটা হবে সকলের কাম্য।
সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা প্রয়াত আলী আহমদ চুনকা একজন খাঁটি আওয়ামী লীগার ছিলেন এবং নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে অনেক জনহিতকর ও উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। আইভীও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নিজের যোগ্যতার ও সততার পরিচয় দিয়েছেন এবং বন্দরনগরীর উন্নয়নে জনসমর্থন ও প্রশংসা পেয়েছেন। এখন সদ্য সিটি করপোরেশনে উন্নীত পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারলে তিনি যে নতুন নারায়ণগঞ্জ নির্মাণের রূপকার হতে পারবেন এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই। তার বিরুদ্ধে অন্তত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। রোববারের নির্বাচনে জনগণের রায় কী হবে তা জানি না। আমি নারায়ণগঞ্জের ভোটার নই। কিন্তু আমার রায় ও শুভেচ্ছা রইল তার পক্ষে।
লন্ডন, ২৮ অক্টোবর ২০১১, শুক্রবার
আর এই নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তাহলে অসম্ভবকে সম্ভব করে বিএনপি প্রার্থী এই সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে জয়ীও হন, তাহলেও বিরাট রাজনৈতিক লাভ আওয়ামী লীগের। তাদের দাবি প্রমাণিত হবে। অর্থাৎ যে কোনো দলই ক্ষমতায় থাকুক, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা অধিক এবং এই প্রক্রিয়াতেই অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত_ আওয়ামী লীগের এই বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবিতে বিএনপির জঙ্গি আন্দোলন তখন মাঠে মারা যাবে।
এ জন্যই রাজধানী ঢাকার অদূরে সদ্য সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়া নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র নির্বাচন এত গুরুত্ব পাচ্ছে যে, তা অভূতপূর্ব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ অনেক কূটনীতিক এবং অসংখ্য বিদেশি পর্যবেক্ষক যাচ্ছেন নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে। নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থান নিয়েছে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করার ব্যাপারে। শুক্রবার থেকেই সেনা মোতায়েন করার কথা। নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ভ্রাম্যমাণ সেনা ইউনিটের টহলদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৭ জন করে কর্মী উপস্থিত থাকবেন, তাদের মধ্যে ৭ জনই হবে পুলিশ। নির্বাচন প্রচারণা শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই বন্ধ করা হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, কোনো নির্বাচন কেন্দ্রে সামান্যতম গণ্ডগোল হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সম্ভব সব ব্যবস্থা করেছে, যা প্রশংসনীয়। যদি কোনো প্রার্থী তার পরাজয় নিশ্চিত জেনে ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাস সৃষ্টি বা অন্য কোনো উপায়ে নির্বাচন ভণ্ডুল করার চেষ্টা না চালান তাহলে এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে বলে আমার ধারণা। প্রার্থীদের জয়-পরাজয় দ্বারা এই নির্বাচনকে বিচার করা ঠিক হবে না। এই নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও অবাধভাবে হলো তার দ্বারাই এর গুরুত্ব নির্ধারিত হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এই মেয়র নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের জয়ের আশা আছে বলে কেউ মনে করেন না। কিন্তু সব গণনা ব্যর্থ করে তিনি যদিও জয়ী হন, তাহলে সেটা হবে বিএনপির একটি বিচ্ছিন্ন দলীয় জয়। কিন্তু বিরাট রাজনৈতিক জয় হবে আওয়ামী লীগের। প্রমাণিত হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের দ্বারাই ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠান সম্ভব এবং ব্যর্থ ও দূষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দরকার নেই। এটা যদি হয় তা হলে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক নীতি ও রাজনীতির জয় হবে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তা সুদূরপ্রসারী শুভ প্রভাব ফেলবে।
আগামীকাল রোববার শীতলক্ষ্যার তীরে যে ভোটযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে তিনজন প্রার্থীর জয়-পরাজয়কে আমি নিম্নোক্তভাবে বিবেচনা করছি। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে একজন বিএনপির একক প্রার্থী। অপর দু'জন শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগ প্রার্থী। দু'জনে সমান জনপ্রিয় প্রার্থী না হলেও সমান শক্তিশালী প্রার্থী। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কেন শেষ মুহূর্তে শামীম ওসমানকে তাদের আসল প্রার্থী বলে চিহ্নিত করতে গেল, সে রহস্য আমি জানি না। আমি যত দূর জানি, আইভী হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের মানুষের পছন্দের প্রার্থী। তার প্রতি আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল অংশেরও সমর্থন রয়েছে।
এখন নির্বাচনটি যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয় এবং শামীম ওসমান জয়ী হন, তাহলে এটা হবে আওয়ামী লীগের পার্টি-হায়ার্কির জয়। দলটির সাধারণ নেতাকর্মীর এবং দলের নৈতিক জয় নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ যে সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে, শামীম ওসমানের জয় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে না। বর্তমানের এই জয় ভবিষ্যতে, বিশেষ করে আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য লায়াবিলিটি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যদি এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হন, তাহলে আওয়ামী লীগের পার্টি-হায়ার্কির তাতে মুখ চুন হতে পারে; কিন্তু দলের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল নীতি ও নৈতিকতার জয় হবে। দলকে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের দখলমুক্ত রাখা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজে তা আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে সাহায্য করবে এবং আগামী সাধারণ নির্বাচনেও দলটি তার বেনিফিসিয়ারি হবে। শামীম ও আইভীর মধ্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে আইভীর সাফল্য কামনা করি। তবে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে যিনিই জয়ী হন, তাকেই অভিনন্দন জানাব। জনগণের রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধা পোষণ করি।
যদি সব গণনা ব্যর্থ করে বিএনপির তৈমুর আলম নির্বাচিত হন, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য দলীয় পরাজয় ঘটাবে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক বিজয় আসবে। আগেই বলেছি, এটা প্রমাণিত হবে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। এটা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনেও প্রমাণিত হয়েছে। এখন নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনেও যদি আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় ঘটে, তাহলে দলটির রাজনৈতিক বিজয় এই পরাজয়ের ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে গেলে তারও যে একটি শুভ দিক আছে, সে কথা উপরে আলোচনা করেছি। এখন অশুভ দিকটির কথা বলি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির কাছে হারলে আগামী ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কেও দলটির শঙ্কিত হওয়ার কারণ ঘটবে। চট্টগ্রাম মেয়র ইলেকশনে আওয়ামী লীগের পরাজয়কে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না এই কারণে যে, সেই পরাজয় আওয়ামী লীগের ততটা ছিল না, যতটা ছিল ব্যক্তিবিশেষের। যদি এবার নারায়ণগঞ্জে অসম্ভবকে সম্ভব করে তৈমুর জেতেন, তাহলে বুঝতে হবে আগামী নির্বাচনগুলো সম্পর্কে আওয়ামী লীগের আত্মসন্তোষ পোষণের কোনো কারণ নেই; বরং তাদের জনসমর্থনে সত্য সত্যই ধস নেমেছে।
এখনও তারা যদি সংগঠনকে শক্তিশালী না করেন, সরকার ও সংগঠনের মধ্যে যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, তা না কমান, একজন দক্ষ ও ব্যক্তিত্বশালী সাধারণ সম্পাদক বেছে না নেন, মন্ত্রিসভায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি না হয় এবং দলে সুবিধাবাদী ও চাটুকারদের বদলে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অংশের মতামতের গুরুত্ব না বাড়ে, সর্বোপরি আগামীতে সব পর্যায়ের নির্বাচনে জনগণের পছন্দের ও পরীক্ষিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া না হয়, তাহলে বলব, ক্ষমতার ঠুলি পরা অন্ধ চোখে আওয়ামী লীগ দেয়ালের লিখন পড়তে পারছে না।
নারায়ণগঞ্জের দিকে এখন সারাদেশের চোখ। আগেই বলেছি, এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশনের জন্য সততা এবং নিরপেক্ষতার অগি্নপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ উত্তীর্ণ হলে নির্বাচনের ফল যাই হোক দলটির রাজনৈতিক জয় হবে এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনেই যে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হতে পারে এবং হওয়া উচিত এটা প্রমাণিত হবে। নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ, তারা বিএনপি প্রার্থীর কাছ থেকে বন্দর থানার ওসিকে সেখান থেকে সরানোর দাবি পাওয়া মাত্র এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তুলেই দাবি পূরণ করেছে। এটা থেকে এই নির্বাচন যাতে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের অতি সতর্কতা বোঝা যায়। এই সতর্কতা নির্বাচনের ফল ঘোষণা পর্যন্ত কমিশনকে বজায় রাখতে হবে।
রোববারের নির্বাচনে যদি সেলিনা হায়াৎ আইভীর জয় হয়, তাহলে আওয়ামী লীগের উচিত হবে এই জয়কে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো। এটা পার্টি-হায়ার্কির কেউ যেন তার বা তাদের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে না করেন। নির্বাচনে আইভীর জয় সুনিশ্চিত কি-না আমি জানি না। কিন্তু তিনি জয়ী হলে এটা দলের পরাজয় বলে বিবেচনা না করে আওয়ামী লীগের বহুকালের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও নৈতিক শক্তির জয় বলে বিবেচনা করতে হবে। তাতে সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ায় যে ঘোষিত লক্ষ্য আওয়ামী লীগের, তার বাস্তবায়নে দল ও সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ মিলবে। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসীদের দল থেকে দূরে রাখার কাজে দলের শীর্ষ নেতারা যদি কঠোর হন এবং দলের নীতিনিষ্ঠ ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দল ও সরকার পরিচালনায় এগিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি করেন সেটা হবে সকলের কাম্য।
সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা প্রয়াত আলী আহমদ চুনকা একজন খাঁটি আওয়ামী লীগার ছিলেন এবং নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে অনেক জনহিতকর ও উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। আইভীও নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে নিজের যোগ্যতার ও সততার পরিচয় দিয়েছেন এবং বন্দরনগরীর উন্নয়নে জনসমর্থন ও প্রশংসা পেয়েছেন। এখন সদ্য সিটি করপোরেশনে উন্নীত পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারলে তিনি যে নতুন নারায়ণগঞ্জ নির্মাণের রূপকার হতে পারবেন এ ব্যাপারে কারও সন্দেহ নেই। তার বিরুদ্ধে অন্তত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। রোববারের নির্বাচনে জনগণের রায় কী হবে তা জানি না। আমি নারায়ণগঞ্জের ভোটার নই। কিন্তু আমার রায় ও শুভেচ্ছা রইল তার পক্ষে।
লন্ডন, ২৮ অক্টোবর ২০১১, শুক্রবার
No comments