চালচিত্র-মনমোহনের সফর ও দুই দেশের প্রত্যাশা ইতিহাসের আরেক রেড লেটার ডে by শুভ রহমান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের দীর্ঘপ্রতীক্ষিত সফর ও দুই দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত, দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে ১৯৭৪-এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর সূচিত হয়েছে আরেক রেড লেটার ডে।
মহান প্রতিবেশী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পরীক্ষিত বন্ধু ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীর, সুদূরপ্রসারী ও রক্তিম নবতর অধ্যায় যুক্ত হওয়ার মহালগ্নটিকে দুই দেশের সাধারণ মানুষ অকুণ্ঠচিত্তে স্বাগত জানিয়েছে। বিশেষ করে এ মুহূর্তে দুই দেশের সীমান্তবর্তী ছিটমহলগুলোর ৫৫ হাজার বাসিন্দা ৬৪ বছরের দুঃখকষ্ট, দুর্ভোগ ও অনিশ্চয়তায় ভরা অমানবিক পরিস্থিতির স্থায়ী অবসানের সম্ভাবনায় এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। সেই সঙ্গে দুই দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা এবং বিশেষ করে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহল ভারতের পূর্বাঞ্চলে সৃষ্ট এই নতুন সম্ভাবনা সম্পর্কে ব্যাপকভাবেই আশাবাদ ব্যক্ত করছে। তাদের মতে, দীর্ঘ এক যুগ পর ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর এই প্রথম বাংলাদেশ সফর দুই দেশের দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যা, সীমান্ত বিরোধ, সীমান্ত হত্যা এবং বাণিজ্য ঘাটতি ও যৌথ নদীর পানিবণ্টনসহ অমীমাংসিত সব সমস্যার ন্যায়সংগত ও প্রত্যাশিত সমাধানে এক যুগান্তকারী, কার্যকর ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে তা উপমহাদেশে ও গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেবে। এরই ফলে উপমহাদেশে ও দক্ষিণ এশিয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক ও ঐতিহ্যগত বন্ধন আরো সুদৃঢ় করার অত্যন্ত ইতিবাচক পথ রচিত হবে।
মঙ্গলবার সূচিত ড. মনমোহন সিংয়ের চলতি ৩০ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফর একই দিন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ও আনুষ্ঠানিক বৈঠক, বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), সম্মতিপত্র ও যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা। আজ বুধবার এ ঐতিহাসিক সফর ড. মনমোহন সিংয়ের জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হওয়ার এবং মহামান্য অতিথির দেশে ফিরে যাওয়ার কথা।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু জাতিই শুধু শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার অভাবে বিরোধ-বিসংবাদে লিপ্ত রয়েছে। তাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ হয় অবরুদ্ধ, না হয় ব্যাহত হচ্ছে। আজ নতুন চেতনা ও উপলব্ধির ফলে আমরা যেমন বিরোধের সীমান্তকে শান্তির সীমান্তে পরিণত করতে চাই, তেমনি পারস্পরিক অনাস্থা-অবিশ্বাসের সম্পর্ককে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্কে পরিণত করতে চাই। আমাদের দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়া ও সারা বিশ্বের জাতিগুলোকে বিরোধ মীমাংসায় উদ্বুদ্ধ করবে।
বস্তুত নয়াদিলি্লতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বর্তমান সফর বিশ্বস্বীকৃত উলি্লখিত সত্যের আলোকেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির কেন্দ্রে পরীক্ষিত ও সুদীর্ঘ স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক শক্তি ক্ষমতাসীন বলেই এই সফর অনুষ্ঠান ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশেও আজ পরীক্ষিত ও মুক্তিযুদ্ধসহ সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাসীন বলেই মহান প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সফরবিনিময় তথা ড. মনমোহন সিংয়ের এই ফিরতি সফর এবং দ্বিপক্ষীয় সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সব বাধামুক্ত করার বর্তমান উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। বস্তুত ড. মনমোহন সিংয়ের বর্তমান সফর গত বছরের জানুয়ারি মাসে মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের ফল হিসেবে ও পরিপ্রেক্ষিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ড. মনমোহন সিংয়ের চলতি বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে পূরণ হচ্ছে শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের সময় ঘোষিত দুই দেশের যৌথ ইশতেহারের ৫০তম তথা শেষ অনুচ্ছেদটি। শেষ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও তাঁর স্ত্রীকে ঢাকা সফরে আসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিমন্ত্রণেই ঢাকা এসেছেন ড. মনমোহন সিং ও তাঁর স্ত্রী গুরুশরণ কাউর। বিভিন্ন দেশে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অভাবেই অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে, সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত ঘটছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাসিন্দাদের জানমালের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং উন্নয়ন ব্যাহত হয়ে জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু অঞ্চলেই এই দুঃখজনক বাস্তবতা বিরাজ করছে।
আমাদের সৌভাগ্য, আমরা আমাদের মহান প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দীর্ঘকালের দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছি। ভারতের সঙ্গে আমাদের চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তকে আমরা বিরোধ, অবিশ্বাস, সংঘাত-সংঘর্ষের সীমান্ত থেকে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে শান্তির সীমান্তে রূপান্তর করার উদ্যোগ ও সংকল্প নিয়েছি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত তিনটি বিষয়_ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর এবং সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার কাজ চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল আশাবাদ ব্যক্ত করছে। দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের দীর্ঘকালের দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, অনিশ্চতার এবার চির অবসান ঘটবে, তাদের নাগরিকত্ব সুস্পষ্ট হবে, তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ফলে তাদের চলাচলের শত অসুবিধা দূর হবে।
এদিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ড. সিংয়ের সফর শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই দেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করে শেষ মুহূর্তে ড. সিংয়ের সফরসঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় তিস্তার পানিবণ্টনে মমতার অবস্থানকে একরকম সমর্থনই করা হচ্ছে। মমতা নাকি চুক্তির খসড়া অনুযায়ী বাংলাদেশকে তিস্তার পানির হিস্যা হিসেবে ৬০ হাজার কিউসেক দিতে চান না। তিনি রাজি হয়েছিলেন ২৫ হাজার কিউসেক দেওয়ার প্রস্তাবে। কিন্তু তাঁকে না জানিয়েই নাকি মূল চুক্তির সে প্রস্তাব পাল্টে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকলেও তাঁর নিজ রাজ্য উত্তরবঙ্গের ক্ষতি করে তিনি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। মূল চুক্তিতে নাকি এমন কথা ছিল না। ড. মনমোহন সিংও তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কলকাতার পত্রিকায় দেখা গেল, প্রণব মুখার্জি পর্যন্ত তাঁকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, তাহলে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে হবে। তাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সফরসঙ্গী হতে রাজি করানো যায়নি। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, মনমোহন সিংয়ের সফরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতে এতটুকু ক্ষুণ্ন হবে না। বস্তুত আমরাও মনে করি, মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মাত্রা যোগ করেছে, নিছক চুক্তি স্বাক্ষর ধরনের কোনো কিছু দিয়ে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মমতার অবস্থানের কারণে আপাতত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত রাখা হলেও আমাদের বিশ্বাস, দুই দেশের মধ্যে এ সফর উত্তেজনা নিরসনে এবং শান্তি ও সৌহার্দ্যের এমনই দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে যে তিস্তা ও ফেনী নদীসহ দুই দেশের সব অভিন্ন ও যৌথ নদনদীর ন্যায়সংগত পানিবণ্টন অচিরেই সুসম্পন্ন হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও তিস্তার ব্যাপারে এখনো আশাবাদী। বস্তুত ইন্টারন্যাশনাল রাইপেরিয়ান ল বা আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন আইন সব গণতান্ত্রিক দেশকেই মানতে হবে। অতীতে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন ঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায়ই সেটি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। চুক্তি সম্পাদন না করার মধ্যে সমস্যার সমাধান নিহিত থাকতে পারে না, চুক্তি সম্পাদন ও তা ঠিকভাবে কার্যকর করার ওপরই সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি নির্ভর করে। শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমেই সমস্বার্থ, সমমর্যাদার ভিত্তিতে তিস্তার পানিবণ্টন হতে হবে; এর বিকল্প কিছু নেই। ঠিক একইভাবে দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তিও অচিরেই সম্পাদন করতে হবে। ১৯৭৪-এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতেই ট্রানজিট চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। বাস্তবে ১৯৪৭ থেকেই দুই দেশের মধ্যে নানা ফরমে ট্রানজিট চালু রয়েছে। এ ব্যাপারে গণভোট গ্রহণের কিছু নেই। শুধু সম্মতিপত্র দিয়ে বিষয়টিকে অসম্পূর্ণ করে রাখলে চলবে না।
আর ফেলানী নয়
ড. মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের সীমান্ত বিরোধের স্থায়ী নিষ্পত্তির পথ সুগম করে দিয়েছে। সীমান্তে এমনকি সেই সাতচলি্লশের সময় থেকেই দ্বন্দ্ব-বিরোধ চলছে। দুই দেশের মধ্যে চোরাচালান, অবৈধ যাতায়াত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ_এসব অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার চির অবসান ঘটিয়ে এবার নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার দুরূহ কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। সীমান্ত সংঘর্ষ ও গুলির জন্য জবাবদিহির কঠোর ব্যবস্থা কায়েম হচ্ছে। এর ফলে নিঃসন্দেহেই বিরোধের সীমান্ত পরিণত হবে শান্তির সীমান্তে। ফেলানী হত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না সীমান্তে। অবৈধ যাতায়াত ও চোরাচালানের ফলে দীর্ঘকাল ধরে দুই দেশের সীমান্তে ও অভ্যন্তরভাগে যে অর্থনৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আসছে, তারও ক্রম-অবসান ঘটবে। শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তি ছাড়া যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা যায় না, তা প্রমাণিত হয়েছে। আজ বালাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি দিয়েও তা প্রমাণিত হবে। দুই দেশের মধ্যে ভিসা-সংক্রান্ত যে সমস্যা ও জটিলতা রয়েছে, তারও আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হবে_ইউরোপ এর পথ দেখিয়েছে। ভিসার কড়াকড়ি নেই অনেক দেশেই।
ড. মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কেরও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের দৃঢ়প্রতিশ্রুতি রেখে গেছে। ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত ও অশুল্ক প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে এবার অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে এবং দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ঐতিহাসিক সফর দুই দেশের জনগণকে অচ্ছেদ্য মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করে গেল, যার সুফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ভোগ করে চলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অহেতুক সমালোচনাকারী, ভারতবিরোধী নেতিবাচক রাজনীতির ধারকদের মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর মহাজোট সরকার আজ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ফিরতি সফর এবং দুই দেশের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদনকে সম্ভব করে তুলেছেন, তা তাঁর গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত আরো সুদৃঢ় করবে।
৬.৯.২০১১
মঙ্গলবার সূচিত ড. মনমোহন সিংয়ের চলতি ৩০ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফর একই দিন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ও আনুষ্ঠানিক বৈঠক, বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক (এমওইউ), সম্মতিপত্র ও যৌথ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা। আজ বুধবার এ ঐতিহাসিক সফর ড. মনমোহন সিংয়ের জন্য গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হওয়ার এবং মহামান্য অতিথির দেশে ফিরে যাওয়ার কথা।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু জাতিই শুধু শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার অভাবে বিরোধ-বিসংবাদে লিপ্ত রয়েছে। তাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ হয় অবরুদ্ধ, না হয় ব্যাহত হচ্ছে। আজ নতুন চেতনা ও উপলব্ধির ফলে আমরা যেমন বিরোধের সীমান্তকে শান্তির সীমান্তে পরিণত করতে চাই, তেমনি পারস্পরিক অনাস্থা-অবিশ্বাসের সম্পর্ককে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, সমঝোতা ও সহযোগিতার সম্পর্কে পরিণত করতে চাই। আমাদের দৃষ্টান্ত দক্ষিণ এশিয়া ও সারা বিশ্বের জাতিগুলোকে বিরোধ মীমাংসায় উদ্বুদ্ধ করবে।
বস্তুত নয়াদিলি্লতে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বর্তমান সফর বিশ্বস্বীকৃত উলি্লখিত সত্যের আলোকেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশটির কেন্দ্রে পরীক্ষিত ও সুদীর্ঘ স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক শক্তি ক্ষমতাসীন বলেই এই সফর অনুষ্ঠান ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। ঠিক তেমনি আমাদের দেশেও আজ পরীক্ষিত ও মুক্তিযুদ্ধসহ সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শক্তি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাসীন বলেই মহান প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সফরবিনিময় তথা ড. মনমোহন সিংয়ের এই ফিরতি সফর এবং দ্বিপক্ষীয় সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সব বাধামুক্ত করার বর্তমান উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। বস্তুত ড. মনমোহন সিংয়ের বর্তমান সফর গত বছরের জানুয়ারি মাসে মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের ফল হিসেবে ও পরিপ্রেক্ষিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ড. মনমোহন সিংয়ের চলতি বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে পূরণ হচ্ছে শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফরের সময় ঘোষিত দুই দেশের যৌথ ইশতেহারের ৫০তম তথা শেষ অনুচ্ছেদটি। শেষ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ও তাঁর স্ত্রীকে ঢাকা সফরে আসতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিমন্ত্রণেই ঢাকা এসেছেন ড. মনমোহন সিং ও তাঁর স্ত্রী গুরুশরণ কাউর। বিভিন্ন দেশে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অভাবেই অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে, সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত ঘটছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বাসিন্দাদের জানমালের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং উন্নয়ন ব্যাহত হয়ে জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু অঞ্চলেই এই দুঃখজনক বাস্তবতা বিরাজ করছে।
আমাদের সৌভাগ্য, আমরা আমাদের মহান প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দীর্ঘকালের দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান ঘটাতে উদ্যোগী হয়েছি। ভারতের সঙ্গে আমাদের চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তকে আমরা বিরোধ, অবিশ্বাস, সংঘাত-সংঘর্ষের সীমান্ত থেকে শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে শান্তির সীমান্তে রূপান্তর করার উদ্যোগ ও সংকল্প নিয়েছি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত তিনটি বিষয়_ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর এবং সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিত করার কাজ চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল আশাবাদ ব্যক্ত করছে। দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের দীর্ঘকালের দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ, অনিশ্চতার এবার চির অবসান ঘটবে, তাদের নাগরিকত্ব সুস্পষ্ট হবে, তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার ফলে তাদের চলাচলের শত অসুবিধা দূর হবে।
এদিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ড. সিংয়ের সফর শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই দেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করে শেষ মুহূর্তে ড. সিংয়ের সফরসঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। কলকাতার পত্রপত্রিকায় তিস্তার পানিবণ্টনে মমতার অবস্থানকে একরকম সমর্থনই করা হচ্ছে। মমতা নাকি চুক্তির খসড়া অনুযায়ী বাংলাদেশকে তিস্তার পানির হিস্যা হিসেবে ৬০ হাজার কিউসেক দিতে চান না। তিনি রাজি হয়েছিলেন ২৫ হাজার কিউসেক দেওয়ার প্রস্তাবে। কিন্তু তাঁকে না জানিয়েই নাকি মূল চুক্তির সে প্রস্তাব পাল্টে ফেলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক থাকলেও তাঁর নিজ রাজ্য উত্তরবঙ্গের ক্ষতি করে তিনি এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। মূল চুক্তিতে নাকি এমন কথা ছিল না। ড. মনমোহন সিংও তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। কলকাতার পত্রিকায় দেখা গেল, প্রণব মুখার্জি পর্যন্ত তাঁকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, তাহলে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর বাতিল করতে হবে। তাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সফরসঙ্গী হতে রাজি করানো যায়নি। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, মনমোহন সিংয়ের সফরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এতে এতটুকু ক্ষুণ্ন হবে না। বস্তুত আমরাও মনে করি, মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মাত্রা যোগ করেছে, নিছক চুক্তি স্বাক্ষর ধরনের কোনো কিছু দিয়ে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মমতার অবস্থানের কারণে আপাতত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত রাখা হলেও আমাদের বিশ্বাস, দুই দেশের মধ্যে এ সফর উত্তেজনা নিরসনে এবং শান্তি ও সৌহার্দ্যের এমনই দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে যে তিস্তা ও ফেনী নদীসহ দুই দেশের সব অভিন্ন ও যৌথ নদনদীর ন্যায়সংগত পানিবণ্টন অচিরেই সুসম্পন্ন হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিও তিস্তার ব্যাপারে এখনো আশাবাদী। বস্তুত ইন্টারন্যাশনাল রাইপেরিয়ান ল বা আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন আইন সব গণতান্ত্রিক দেশকেই মানতে হবে। অতীতে ফারাক্কায় গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন ঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায়ই সেটি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। চুক্তি সম্পাদন না করার মধ্যে সমস্যার সমাধান নিহিত থাকতে পারে না, চুক্তি সম্পাদন ও তা ঠিকভাবে কার্যকর করার ওপরই সংশ্লিষ্ট দেশের স্বার্থ হাসিলের বিষয়টি নির্ভর করে। শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমেই সমস্বার্থ, সমমর্যাদার ভিত্তিতে তিস্তার পানিবণ্টন হতে হবে; এর বিকল্প কিছু নেই। ঠিক একইভাবে দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তিও অচিরেই সম্পাদন করতে হবে। ১৯৭৪-এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতেই ট্রানজিট চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। বাস্তবে ১৯৪৭ থেকেই দুই দেশের মধ্যে নানা ফরমে ট্রানজিট চালু রয়েছে। এ ব্যাপারে গণভোট গ্রহণের কিছু নেই। শুধু সম্মতিপত্র দিয়ে বিষয়টিকে অসম্পূর্ণ করে রাখলে চলবে না।
আর ফেলানী নয়
ড. মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের সীমান্ত বিরোধের স্থায়ী নিষ্পত্তির পথ সুগম করে দিয়েছে। সীমান্তে এমনকি সেই সাতচলি্লশের সময় থেকেই দ্বন্দ্ব-বিরোধ চলছে। দুই দেশের মধ্যে চোরাচালান, অবৈধ যাতায়াত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ_এসব অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার চির অবসান ঘটিয়ে এবার নতুন করে সীমান্ত চিহ্নিত করার দুরূহ কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে। সীমান্ত সংঘর্ষ ও গুলির জন্য জবাবদিহির কঠোর ব্যবস্থা কায়েম হচ্ছে। এর ফলে নিঃসন্দেহেই বিরোধের সীমান্ত পরিণত হবে শান্তির সীমান্তে। ফেলানী হত্যার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না সীমান্তে। অবৈধ যাতায়াত ও চোরাচালানের ফলে দীর্ঘকাল ধরে দুই দেশের সীমান্তে ও অভ্যন্তরভাগে যে অর্থনৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আসছে, তারও ক্রম-অবসান ঘটবে। শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও চুক্তি ছাড়া যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা যায় না, তা প্রমাণিত হয়েছে। আজ বালাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি দিয়েও তা প্রমাণিত হবে। দুই দেশের মধ্যে ভিসা-সংক্রান্ত যে সমস্যা ও জটিলতা রয়েছে, তারও আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হবে_ইউরোপ এর পথ দেখিয়েছে। ভিসার কড়াকড়ি নেই অনেক দেশেই।
ড. মনমোহন সিংয়ের সফর দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কেরও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধনের দৃঢ়প্রতিশ্রুতি রেখে গেছে। ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত ও অশুল্ক প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে এবার অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে এবং দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ ঐতিহাসিক সফর দুই দেশের জনগণকে অচ্ছেদ্য মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করে গেল, যার সুফল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ভোগ করে চলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অহেতুক সমালোচনাকারী, ভারতবিরোধী নেতিবাচক রাজনীতির ধারকদের মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর মহাজোট সরকার আজ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর যে ফিরতি সফর এবং দুই দেশের অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদনকে সম্ভব করে তুলেছেন, তা তাঁর গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত আরো সুদৃঢ় করবে।
৬.৯.২০১১
No comments