আশানুরূপ না হলেও ব্যর্থ নয়-সুফলগুলো কাজে লাগাতে হবে
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বহু প্রতীক্ষিত সফর অবশেষে সম্পন্ন হলো। তাঁকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়াসহ উষ্ণ আতিথেয়তার আয়োজনে কোনো কার্পণ্য ছিল না। কারণ ২০১০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিলি্ল সফরের পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল।
তিস্তার পানিবণ্টন, ছিটমহল বিনিময় এবং ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হবে বলে দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রত্যাশায় ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত বিরোধিতার মুখে বাংলাদেশের এবং সম্ভবত ভারতেরও প্রত্যাশা অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ সফর ব্যর্থ নয়। প্রত্যাশিত পর্যায়ে না হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি একেবারে কমও নয়। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, দীর্ঘদিনের সীমান্তবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সীমান্ত চুক্তি, ভারতের ওপর দিয়ে নেপালের সঙ্গে ট্রানজিটসহ আরো কিছু বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ইতিবাচক ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ধারা জোরদার হয়েছে। যে সমস্যাগুলোর সমাধান এখন হয়নি, এই ধারায় চলতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে সেই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে_এমন প্রত্যাশা এখন আমরা করতেই পারি।
মিয়ানমারের সঙ্গে সামান্য অংশ ছাড়া বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে রয়েছে ভারত আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সেই অর্থে ভারতই আমাদের প্রধান প্রতিবেশী। সুদীর্ঘকাল ধরে দেশ দুটির বিশাল অংশ একটি অভিন্ন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশংকর, উদয়শংকর, শচীনদেব বর্মণ, সম্প্রতি প্রয়াত রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসুসহ আরো অনেকেরই নাম করা যায়, যাঁরা দুই দেশেরই অহংকার, দুই দেশেরই গর্বের প্রতীক। এ রকম দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক না থাকার কি যুক্তিসংগত কোনো কারণ আছে? অথচ দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবে তাই চলে আসছিল। অপ্রিয় হলেও সত্য যে দুটি দেশেই মৌলবাদী ও সংকীর্ণমনা কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা এই সম্পর্ক উন্নয়নের পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে যাচ্ছেন এবং তাঁরা অনেকাংশে সফলও হচ্ছেন। আমরা আশা করি, দুই প্রধানমন্ত্রীর সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক ধারার সূচনা হয়েছে, উভয় দেশের সচেতন জনগণ সেই ধারা বজায় রাখতে এবং এগিয়ে নিতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকবেন। এটিও সত্য, দুটি দেশের মধ্যে অর্ধ শতাধিক অভিন্ন নদী রয়েছে, রয়েছে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিন্ন ঐতিহ্য। এই নদীগুলোর উৎসে ভারতের বাঁধ তৈরি বা একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশে নদীগুলোতে স্বাভাবিক পানির ধারা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নদী মরে গেছে অথবা মৃতপ্রায়। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মার অনেক অংশ এখন মৃতপ্রায়, শুষ্ক মৌসুমে কোনো কোনো অংশে হেঁটে পার হওয়া যায়। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রেরও একই অবস্থা। এর ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ফসল ফলানো যায় না, আবার বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ব্যাপক ফসলহানি হয়। প্রতিবেশী বাঁচল কী মরল, তা আমার দেখার বিষয় নয়_এই মনোভাব কোনো দিনও সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ হতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনও তা সমর্থন করে না। বাংলাদেশের মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনেক আপন ভেবেছিল। তাই তাঁর কাছ থেকে পাওয়া এ আঘাত তাদের বুকে বড় বেশি বেজেছে, বড় বেশি কষ্টের কারণ হয়েছে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সাদরে বরণ করেছি। দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারার সূচনাকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এক সফরে কী পেলাম, আর কী পেলাম না_তার মধ্যেই আমরা সব হিসাব মেলাতে চাই না। আমরা এগিয়ে যেতে চাই এবং পরস্পরের সমৃদ্ধি
দেখতে চাই।
No comments