সরল গরল-‘অভিষেকে’ প্রধান বিচারপতি by মিজানুর রহমান খান
শামীম ওসমানের দূষিত রাজনীতিতে দীর্ণ নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির অভিষেক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের অংশগ্রহণ কি ঠিক হয়েছে? বিচারের জগতে ক্ষমতার ‘কালারাবল’ অনুশীলন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাইরে দেখে মনে হবে এক জিনিস, কিন্তু ভেতরে অন্য জিনিস। বাইরে থেকে মনে হতে পারে নারায়ণগঞ্জ বারের অভিষেক ও বার্ষিক ভোজ হচ্ছে। কিন্তু এখানে অন্তত এক ঢিলে দুই পাখি মারার ঘটনা ঘটেছে। নামে অভিষেক। কার্যত মেয়র আইভিকে টেক্কা দিতে আয়োজিত অভিষেক-শোডাউন।
আইনজীবীরা ‘কোর্ট অফিসার’। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তাদের অভিষেকে প্রধান বিচারপতির উপস্থিতি প্রশ্নসাপেক্ষ হবে কেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নিতে হবে, অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালতের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে প্রধান বিচারপতির মর্যাদা চার নম্বরে হলেও সারা বিশ্বের অলিখিত বিধান হচ্ছে, একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও শ্রদ্ধার আসনটি প্রধান বিচারপতির। সংবিধান প্রধান বিচারপতিকে কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হিসেবে গণ্য করেনি। তাঁর পদবি হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি।
অভিষেক অনুষ্ঠান কোনো বিধিবদ্ধ অপরিহার্য অনুষ্ঠানও নয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সবচেয়ে আকর্ষণীয় হিসেবে গণ্য হলেও তাদের কোনো অভিষেক-পর্ব নেই। সুতরাং প্রধান বিচারপতিদের অভিষেকে প্রধান অতিথি হওয়ার প্রশ্ন নেই। অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ স্মরণ করতে পারেননি যে প্রধান বিচারপতিরা জেলা বারের অভিষেকে যান কি না। রেওয়াজের দিক থেকেও এটা খুবই বিরল। সার্বিক বিচারে প্রধান বিচারপতির ওই সফর আইনের শাসনের কোনো চেতনা বা কারণগুলোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়নি। বরং তাকে দুর্বল করেছে।
জানতে পারি, নারায়ণগঞ্জ বারের একটি দল সরাসরি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তাঁকে হয়তো বলা হয় যে এটা একটি সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বিযুক্ত উদ্যোগ। যেখানে শুধু পেশাদার আইনজীবীরাই অংশ নেবেন।
নির্বাচন হয়েছে গত এপ্রিলে। এক বছর মেয়াদি কমিটি। আট মাস পার হয়ে গেছে। আর তিন মাস পরে নতুন নির্বাচন হবে। এখানে অভিষেকের কী আছে? খুবই বাসী অভিষেক। তা ছাড়া অভিষেক তো এমন কোনো বিচার বিভাগীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত কিছু বিষয় নয় যে এটা হতেই হবে। সেখানে জেলা জজের প্রধান অতিথি হওয়াই যথেষ্ট ছিল। এমনকি হাইকার্টের কোনো একজন কনিষ্ঠ বিচারপতিও যদি প্রধান অতিথি হতেন তাতেও চলত।
প্রশ্ন হলো প্রধান বিচারপতিকেই লাগবে কেন। তাঁকেই কেন যেতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির রাজনীতি শামীম ওসমানের কলুষিত রাজনীতি মুক্ত নয়। ২০১০-১১ বর্ষের কার্যকরী কমিটির অভিষেক ও ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নিয়ে গোল বেঁধেছিল। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র দুবার ছাপতে হয়েছিল। প্রথম আমন্ত্রণপত্রে নারায়ণগঞ্জের পাঁচ ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদের নামের আগে বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমানের নাম ছাপা হয়েছিল। এতে জেলা সাংসদেরা আপত্তি জানালে আমন্ত্রণপত্র পুনরায় ছাপা হয়েছিল। তখন মধ্যস্থতা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ‘নানা কারণে বিতর্কিত শামীম ওসমান ও তাঁর ভাই সেলিম ওসমান মঞ্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসবেন না এই শর্তে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। শামীম ওসমানের প্রেস্টিজ বাড়ানো এবং অন্যান্য দলীয় সাংসদদের নাজেহাল করার শোডাউনের সঙ্গে যে দুটি নাম জড়িত ছিলেন এবারও সেই তাঁরাই আছেন।
বারের সভাপতি আনিসুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা নামে ‘পেশাদার আইনজীবী’ হলেও দুজনই শামীমের চিহ্নিত লোক। এবার তাঁরা আইভির বিরুদ্ধে শামীমের পক্ষে শোডাউন করার কাজে অভিষেককে ব্যবহার করেছেন।
সেলিনা হায়াৎ আইভির কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর শামীম ওসমান বাহিনীর শোডাউন খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। সে কারণেই আমরা দেখি আইভি গত ২৭ নভেম্বর শপথ নেন। ১৬ নভেম্বরে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ১ ডিসেম্বরে তিনি দায়িত্ব নেবেন। এর সাত দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বরে শামীম ওসমান ঘোষণা দেন ১ ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জে তিনি শোডাউন করবেন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় শামীমকে নিবৃত্ত করেন বলে শুনেছি। কাকতালীয়ভাবে হোক বা না হোক নারায়ণগঞ্জবাসীর অনেকের কাছে ঠিকই প্রতীয়মান হয়েছে যে ১ ডিসেম্বরে শামীম ওসমানের অন্ধ সমর্থক জেলা বার সভাপতি আনিসুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহার অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই দুজন আইনজীবী সমাজের নেতা হলেও আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকারারের উন্নয়নসংক্রান্ত কোনো তৎপরতায় তাদের দেখা যায় না। উদ্বেগজনক বিষয় হলো এই চিত্র শুধু নারায়ণগঞ্জে নয়, দেশের আরও অনেক শহরের আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব পেশাজীবীর ছদ্মবেশে ’ক্যাডাররা’ ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। জামিনের উকিলরা দিব্বি কালো গাউনের আড়ালে নিজেদের মুখোশ লুকোতে পারছেন। কোথাও কোথাও অধস্তন আদালতের বিচারকেরা তটস্থ থাকেন। আদালতের আদেশ নিজেদের মনঃপূত না হলে বিচারকের বিরুদ্ধে জেলা আইনজীবী সমিতির নামে রেজুলেশন পাস করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেন। আদালত বর্জন করেন। নারায়ণগঞ্জ বার সভাপতি ও সম্পাদকের সাম্প্রতিক প্রকাশ্য তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে তাতে আইনের কোনো ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না।
চিত্রাভিনেত্রী সাংসদ কবরীকে গত ১৮ জুন ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে চরমভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। ওই দিন শামীম ওসমানের পরই যাকে সবচেয়ে মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে তিনি জেলা বার সভাপতি। ওই সভা ছিল বাসভাড়া নিয়ে। ডিসি ও এসপির সামনেই আনিসুর রহমান কবরী ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে মারতে তেড়ে যান। দেশে আইনের শাসন থাকলে এই ঘটনার পরে পেশাগত অসদাচরণের দায়ে তাঁর সনদ খোয়া যাওয়ার কথা। দণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হোক। তাই বলে তাঁকে আমরা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দ্বারা অভিষেক লাভ করতে দেখব? বাস ভাড়াসংক্রান্ত আলোচনায় বার সভাপতির ওই অসদাচরণের দৃশ্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। এর আগে তিনি অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য। সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা আওয়ামী লীগের শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এই দুজনকেই শামীম ওসমানের বাম ও ডান হাত হিসেবে নাসিক নির্বাচনী তৎপরতায় দেখা গেছে। আইভির বিজয় যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের কথায় ‘সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির’ বিরুদ্ধে গণরায় হয়ে থাকে, তাহলে ওই রায় সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের ‘দলীয় তৎপরতার’ বিরুদ্ধেও একটি চপেটাঘাত।
নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী সমিতির করিৎকর্মা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের খায়েশ হতেই পারে প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর। তবে প্রধান বিচারপতি নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির অভিষেকের রাজনীতিতে জড়াতে আগ্রহী থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রধান বিচারপতির সচিবালয়ের কর্মকর্তারা কি এসব বিবেচনায় নিয়েছিলেন? শুনে অবাক হলাম, এ রকম বিষয় যাচাই-বাছাই করার মতো উপযুক্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সেখানে নেই। কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ তাঁর সচিবালয়কে বিবেচনায় নিতে হবে যে প্রধান বিচারপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বশেষ ভরসার জায়গায় আসীন। তাঁর পদমর্যাদা ও ভাবমূর্তির সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে কারণেই আচরণবিধিতে বিচারকের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান নিয়ে বিরাট সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা আছে।
নারায়ণগঞ্জের বার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবার আইভিকে দাওয়াত যাতে না দিতে হয় সে জন্য জনপ্রতিনিধিদের বয়কট করেছে। এবার শামীম ওসমানের নাম আমন্ত্রণপত্রে ছাপা যেহেতু আরও বিতর্কের বিষয়বস্তু হবে সে কারণে তারা এবার তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। একই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হঠাৎ ভোল পাল্টান। এবার তাঁরা ‘প্রধান বিচারপতির’ দোহাই দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের বর্জন করেন।
উদ্দেশ্য একটাই নবনিযুক্ত মেয়র আইভিকে শায়েস্তা করা, তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া যে তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে হাজির করতে সক্ষম। যদি কেউ বলেন যে এটা তো সমালোচকদের মনগড়া হতে পারে। এসবের প্রমাণ কী। আমরা এ কথা নাকচ করে দেব না। কিন্তু এটা বলব যে সার্বিক বিচারে বিশেষ করে যে বার নেতাদের আচরণ বিতর্কিত সেখানে প্রধান বিচারপতির উপস্থিতি জনমনে পরিচ্ছন্ন ধারণা নাও দিতে পারে। এমন ঝুঁকি জনপ্রতিনিধিরা এড়াতে পারলেও বিচারপতিরা পারেন না। কারণ তাঁরা জানেন, ন্যায় বিচার করলে হবে না, সেটা প্রতীয়মান হতে হবে। সে কারণেই আচরণবিধিতে প্রতীয়মান হওয়ার প্রতি বিরাট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আইভিকে এড়াতেই এবার যে জনপ্রতিনিধি বর্জন করা হয়েছে তেমন খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপদফার আওতায় প্রণীত আচরণবিধি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন উদাসীন থাকতে পারে না। আচরণবিধিতে বলা আছে, একজন বিচারক শুধু আইনের অধীন হবেন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। এবং তিনি সব সময় এমনভাবে আচরণ করবেন যাতে বিচার বিভাগের অখণ্ডতা এবং নিরপেক্ষতার প্রতি জনগণের আস্থার উন্নয়ন ঘটে। এমনকি একজন বিচারক তাঁর বিচারিক আচরণকে প্রভাবিত করতে দিতে তাঁর পরিবার, সমাজ কিংবা অন্য কোনো সম্পর্ককে একদম প্রশ্রয় দেবেন না।
আচরণবিধিতে বলা আছে, ‘একজন বিচারক কারো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁর বিচার বিভাগীয় মর্যাদাকে ব্যবহার করতে দেবেন না। এমনকি অন্য কাউকেও এই ধারণা তিনি সৃষ্টি করতে দেবেন না যে তারা একজন বিচারকের ওপরে প্রভাব খাটানোর মতো বিশেষ অবস্থানে রয়েছেন। তাঁরা সব সময় জনগণের নজরদারিতে থাকবেন। তাঁর দপ্তরের জন্য অশোভন মনে হতে পারে এমন সবকিছুই তিনি এড়িয়ে চলবেন।
সংবিধানমতে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের। কিন্তু এখন যদি প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের কোনো মাননীয় বিচারক নিম্ন আদালত পরিদর্শনে যান এবং দেখা যায় তিনি হয়তো সেই আদালতে ব্যক্তিগতভাবে কোনো মামলার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাহলে কিন্তু ভয়ানক প্রশ্ন ও দিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।
প্রধান বিচারপতি কোন অনুষ্ঠানে যাবেন এবং কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না তার একটি লিখিত নীতিমালা থাকা দরকার। এটা এখন আর মুখের কথানির্ভর থাকতে পারে না।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি যদি প্রশাসন খতিয়ে দেখত এবং সে অনুযায়ী নোট লেখা হতো তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো। বিচারপতিরা আইনগত বিষয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে অবশ্যই কথা বলবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন আর কোথায় যাবেন না, সেই সিদ্ধান্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রটোকল বিভাগকে প্রতিটি আমন্ত্রণ সযত্নে পরীক্ষা করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্যই আমাদের এই নিবেদন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
অভিষেক অনুষ্ঠান কোনো বিধিবদ্ধ অপরিহার্য অনুষ্ঠানও নয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন সবচেয়ে আকর্ষণীয় হিসেবে গণ্য হলেও তাদের কোনো অভিষেক-পর্ব নেই। সুতরাং প্রধান বিচারপতিদের অভিষেকে প্রধান অতিথি হওয়ার প্রশ্ন নেই। অনেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ স্মরণ করতে পারেননি যে প্রধান বিচারপতিরা জেলা বারের অভিষেকে যান কি না। রেওয়াজের দিক থেকেও এটা খুবই বিরল। সার্বিক বিচারে প্রধান বিচারপতির ওই সফর আইনের শাসনের কোনো চেতনা বা কারণগুলোর শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়নি। বরং তাকে দুর্বল করেছে।
জানতে পারি, নারায়ণগঞ্জ বারের একটি দল সরাসরি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তাঁকে হয়তো বলা হয় যে এটা একটি সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল বিযুক্ত উদ্যোগ। যেখানে শুধু পেশাদার আইনজীবীরাই অংশ নেবেন।
নির্বাচন হয়েছে গত এপ্রিলে। এক বছর মেয়াদি কমিটি। আট মাস পার হয়ে গেছে। আর তিন মাস পরে নতুন নির্বাচন হবে। এখানে অভিষেকের কী আছে? খুবই বাসী অভিষেক। তা ছাড়া অভিষেক তো এমন কোনো বিচার বিভাগীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত কিছু বিষয় নয় যে এটা হতেই হবে। সেখানে জেলা জজের প্রধান অতিথি হওয়াই যথেষ্ট ছিল। এমনকি হাইকার্টের কোনো একজন কনিষ্ঠ বিচারপতিও যদি প্রধান অতিথি হতেন তাতেও চলত।
প্রশ্ন হলো প্রধান বিচারপতিকেই লাগবে কেন। তাঁকেই কেন যেতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির রাজনীতি শামীম ওসমানের কলুষিত রাজনীতি মুক্ত নয়। ২০১০-১১ বর্ষের কার্যকরী কমিটির অভিষেক ও ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নিয়ে গোল বেঁধেছিল। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র দুবার ছাপতে হয়েছিল। প্রথম আমন্ত্রণপত্রে নারায়ণগঞ্জের পাঁচ ক্ষমতাসীন দলীয় সাংসদের নামের আগে বিতর্কিত নেতা শামীম ওসমানের নাম ছাপা হয়েছিল। এতে জেলা সাংসদেরা আপত্তি জানালে আমন্ত্রণপত্র পুনরায় ছাপা হয়েছিল। তখন মধ্যস্থতা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১০ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ‘নানা কারণে বিতর্কিত শামীম ওসমান ও তাঁর ভাই সেলিম ওসমান মঞ্চে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসবেন না এই শর্তে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। শামীম ওসমানের প্রেস্টিজ বাড়ানো এবং অন্যান্য দলীয় সাংসদদের নাজেহাল করার শোডাউনের সঙ্গে যে দুটি নাম জড়িত ছিলেন এবারও সেই তাঁরাই আছেন।
বারের সভাপতি আনিসুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা নামে ‘পেশাদার আইনজীবী’ হলেও দুজনই শামীমের চিহ্নিত লোক। এবার তাঁরা আইভির বিরুদ্ধে শামীমের পক্ষে শোডাউন করার কাজে অভিষেককে ব্যবহার করেছেন।
সেলিনা হায়াৎ আইভির কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর শামীম ওসমান বাহিনীর শোডাউন খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। সে কারণেই আমরা দেখি আইভি গত ২৭ নভেম্বর শপথ নেন। ১৬ নভেম্বরে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ১ ডিসেম্বরে তিনি দায়িত্ব নেবেন। এর সাত দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বরে শামীম ওসমান ঘোষণা দেন ১ ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জে তিনি শোডাউন করবেন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় শামীমকে নিবৃত্ত করেন বলে শুনেছি। কাকতালীয়ভাবে হোক বা না হোক নারায়ণগঞ্জবাসীর অনেকের কাছে ঠিকই প্রতীয়মান হয়েছে যে ১ ডিসেম্বরে শামীম ওসমানের অন্ধ সমর্থক জেলা বার সভাপতি আনিসুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহার অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। এই দুজন আইনজীবী সমাজের নেতা হলেও আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকারারের উন্নয়নসংক্রান্ত কোনো তৎপরতায় তাদের দেখা যায় না। উদ্বেগজনক বিষয় হলো এই চিত্র শুধু নারায়ণগঞ্জে নয়, দেশের আরও অনেক শহরের আইনজীবী সমিতির নেতৃত্ব পেশাজীবীর ছদ্মবেশে ’ক্যাডাররা’ ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। জামিনের উকিলরা দিব্বি কালো গাউনের আড়ালে নিজেদের মুখোশ লুকোতে পারছেন। কোথাও কোথাও অধস্তন আদালতের বিচারকেরা তটস্থ থাকেন। আদালতের আদেশ নিজেদের মনঃপূত না হলে বিচারকের বিরুদ্ধে জেলা আইনজীবী সমিতির নামে রেজুলেশন পাস করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠিয়ে দেন। আদালত বর্জন করেন। নারায়ণগঞ্জ বার সভাপতি ও সম্পাদকের সাম্প্রতিক প্রকাশ্য তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে তাতে আইনের কোনো ছিটেফোঁটাও পাওয়া যাবে না।
চিত্রাভিনেত্রী সাংসদ কবরীকে গত ১৮ জুন ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে চরমভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল। ওই দিন শামীম ওসমানের পরই যাকে সবচেয়ে মারমুখী অবস্থায় দেখা গেছে তিনি জেলা বার সভাপতি। ওই সভা ছিল বাসভাড়া নিয়ে। ডিসি ও এসপির সামনেই আনিসুর রহমান কবরী ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে মারতে তেড়ে যান। দেশে আইনের শাসন থাকলে এই ঘটনার পরে পেশাগত অসদাচরণের দায়ে তাঁর সনদ খোয়া যাওয়ার কথা। দণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হোক। তাই বলে তাঁকে আমরা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দ্বারা অভিষেক লাভ করতে দেখব? বাস ভাড়াসংক্রান্ত আলোচনায় বার সভাপতির ওই অসদাচরণের দৃশ্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে। এর আগে তিনি অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। কমিটি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য। সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা আওয়ামী লীগের শহর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এই দুজনকেই শামীম ওসমানের বাম ও ডান হাত হিসেবে নাসিক নির্বাচনী তৎপরতায় দেখা গেছে। আইভির বিজয় যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্তের কথায় ‘সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির’ বিরুদ্ধে গণরায় হয়ে থাকে, তাহলে ওই রায় সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের ‘দলীয় তৎপরতার’ বিরুদ্ধেও একটি চপেটাঘাত।
নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী সমিতির করিৎকর্মা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের খায়েশ হতেই পারে প্রধান বিচারপতিকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর। তবে প্রধান বিচারপতি নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির অভিষেকের রাজনীতিতে জড়াতে আগ্রহী থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু প্রধান বিচারপতির সচিবালয়ের কর্মকর্তারা কি এসব বিবেচনায় নিয়েছিলেন? শুনে অবাক হলাম, এ রকম বিষয় যাচাই-বাছাই করার মতো উপযুক্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সেখানে নেই। কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। কারণ তাঁর সচিবালয়কে বিবেচনায় নিতে হবে যে প্রধান বিচারপতি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বশেষ ভরসার জায়গায় আসীন। তাঁর পদমর্যাদা ও ভাবমূর্তির সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে কারণেই আচরণবিধিতে বিচারকের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদান নিয়ে বিরাট সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা আছে।
নারায়ণগঞ্জের বার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবার আইভিকে দাওয়াত যাতে না দিতে হয় সে জন্য জনপ্রতিনিধিদের বয়কট করেছে। এবার শামীম ওসমানের নাম আমন্ত্রণপত্রে ছাপা যেহেতু আরও বিতর্কের বিষয়বস্তু হবে সে কারণে তারা এবার তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। একই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হঠাৎ ভোল পাল্টান। এবার তাঁরা ‘প্রধান বিচারপতির’ দোহাই দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের বর্জন করেন।
উদ্দেশ্য একটাই নবনিযুক্ত মেয়র আইভিকে শায়েস্তা করা, তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া যে তাঁরা প্রধান বিচারপতিকে হাজির করতে সক্ষম। যদি কেউ বলেন যে এটা তো সমালোচকদের মনগড়া হতে পারে। এসবের প্রমাণ কী। আমরা এ কথা নাকচ করে দেব না। কিন্তু এটা বলব যে সার্বিক বিচারে বিশেষ করে যে বার নেতাদের আচরণ বিতর্কিত সেখানে প্রধান বিচারপতির উপস্থিতি জনমনে পরিচ্ছন্ন ধারণা নাও দিতে পারে। এমন ঝুঁকি জনপ্রতিনিধিরা এড়াতে পারলেও বিচারপতিরা পারেন না। কারণ তাঁরা জানেন, ন্যায় বিচার করলে হবে না, সেটা প্রতীয়মান হতে হবে। সে কারণেই আচরণবিধিতে প্রতীয়মান হওয়ার প্রতি বিরাট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আইভিকে এড়াতেই এবার যে জনপ্রতিনিধি বর্জন করা হয়েছে তেমন খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের ৪ উপদফার আওতায় প্রণীত আচরণবিধি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন উদাসীন থাকতে পারে না। আচরণবিধিতে বলা আছে, একজন বিচারক শুধু আইনের অধীন হবেন এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। এবং তিনি সব সময় এমনভাবে আচরণ করবেন যাতে বিচার বিভাগের অখণ্ডতা এবং নিরপেক্ষতার প্রতি জনগণের আস্থার উন্নয়ন ঘটে। এমনকি একজন বিচারক তাঁর বিচারিক আচরণকে প্রভাবিত করতে দিতে তাঁর পরিবার, সমাজ কিংবা অন্য কোনো সম্পর্ককে একদম প্রশ্রয় দেবেন না।
আচরণবিধিতে বলা আছে, ‘একজন বিচারক কারো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাঁর বিচার বিভাগীয় মর্যাদাকে ব্যবহার করতে দেবেন না। এমনকি অন্য কাউকেও এই ধারণা তিনি সৃষ্টি করতে দেবেন না যে তারা একজন বিচারকের ওপরে প্রভাব খাটানোর মতো বিশেষ অবস্থানে রয়েছেন। তাঁরা সব সময় জনগণের নজরদারিতে থাকবেন। তাঁর দপ্তরের জন্য অশোভন মনে হতে পারে এমন সবকিছুই তিনি এড়িয়ে চলবেন।
সংবিধানমতে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের। কিন্তু এখন যদি প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের কোনো মাননীয় বিচারক নিম্ন আদালত পরিদর্শনে যান এবং দেখা যায় তিনি হয়তো সেই আদালতে ব্যক্তিগতভাবে কোনো মামলার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাহলে কিন্তু ভয়ানক প্রশ্ন ও দিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক।
প্রধান বিচারপতি কোন অনুষ্ঠানে যাবেন এবং কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না তার একটি লিখিত নীতিমালা থাকা দরকার। এটা এখন আর মুখের কথানির্ভর থাকতে পারে না।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি যদি প্রশাসন খতিয়ে দেখত এবং সে অনুযায়ী নোট লেখা হতো তাহলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো। বিচারপতিরা আইনগত বিষয়ে সামাজিক অনুষ্ঠানে অবশ্যই কথা বলবেন। কিন্তু কোথায় যাবেন আর কোথায় যাবেন না, সেই সিদ্ধান্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রটোকল বিভাগকে প্রতিটি আমন্ত্রণ সযত্নে পরীক্ষা করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের সিদ্ধান্তের পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্যই আমাদের এই নিবেদন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments