চোরাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন যেভাবে
আশরাফ খান: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে চোরাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন পৃষ্ঠা ৫ কলাম ৫ দেয়া হচ্ছে। সরজমিন পরীক্ষা ছাড়াই দেয়া হচ্ছে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট। গত দু’বছরে বিআরটিএ’র খুলনা অফিস থেকে এ ধরনের সহস্রাধিক চোরাই ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে বিআরটিএ’র খুলনা অফিস। উৎকোচ ছাড়া এখানে কোন কাজ হয় না। রুট পারমিট রেজিস্ট্রেশন, নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্স, শিক্ষানবিশ লাইসেন্স, অবৈধভাবে লাইসেন্স দেয়ার কাজ এখানে চলছে উৎকোচের বিনিময়ে। এমনকি চোরাই মোটরসাইকেল ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের জন্য কাস্টমস-এর কাগজপত্র জাল করে অবৈধ রেজিস্ট্রেশন নম্বরও দেয়া হয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বিআরটিএ’র খুলনা অফিসের এই অবৈধ তৎপরতার চিত্র তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি সূত্রে জানা যায়, বিআরটিএ’র খুলনা অফিসে জনবল রয়েছে মাত্র আটজন। জনবলের ঘাটতির জন্য দৈনিক বেতন ভিত্তিতে জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এখানে কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এরা দুর্নীতির বিশাল চক্র গড়ে তুলেছে। এদের সঙ্গে পুলিশের এক শ্রেণীর লোকও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ পথে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এরা দৈনিক কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার মতে অফিসটি এখন অর্ধশত লোকের বেআইনি আয়ের উৎস হয়েছে। যানবাহন মালিক ও লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীরা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে প্রতিনিয়ত প্রতারণা ও চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ খুলনা অফিস থেকে শুরু করে ঢাকায় হেড অফিস পর্যন্ত ভাগাভাগি হয় বলে অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে সমস্যা হচ্ছে না। জানা যায়, গাড়ির কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও নতুন রুট পারমিট নিতে নির্দিষ্ট হারে ফি’র অতিরিক্ত দুই থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। এই অর্থ না দিলে রুট পারমিট ও লাইসেন্স নবায়নে নানা সমস্যা ও পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষায় অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক হলেও পরীক্ষা ছাড়াই এখান থেকে লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। এ জন্য দিতে হয় কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা। নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলে আবেদনের সঙ্গে অতিরিক্ত দু’শ টাকা, শিক্ষানবিশ লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত পাঁচশ’ টাকা দিতে হয়। ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে যে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটও এখান থেকে দেয়া হয়। ট্রাক প্রতি বার’শ টাকা, পিকআপ প্রতি বার’শ থেকে পনের’শ টাকা নিয়ে অবৈধভাবে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়। মারাত্মক উদ্বেগজনক হলো পনের থেকে বিশ হাজার টাকা নিয়ে এবং গাড়ি প্রতি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে চোরাই মোটরসাইকেল ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। কাগজপত্র জাল করে অনায়াসেই এই অবৈধ কার্যক্রম চলে আসছে বিআরটিএ’র খুলনা অফিসে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে জানান হয়েছে যে, শাহ আলম নামক একজন মোটরযান পরিদর্শক প্রায় দু’শ চোরাই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়ে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছেন। বিআরটিএ অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী দালাল চক্রের মাধ্যমে সিলমোহর তৈরি করে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন ও অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরি করছে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেমন বহুগুণে বেড়েছে, সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়গুলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের অবগতিতে থাকলেও কোন সময়ই তারা প্রতিকারে কোন ব্যবস্থা নিতে আগ্রহ দেখান না। ফিটনেসবিহীন গাড়িকে অবৈধভাবে রুট পারমিট দেয়ায় এবং অশিক্ষিত, অদক্ষ ব্যক্তিদের অবৈধভাবে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। চোরাই গাড়ির ভুয়া নতুন কাগজপত্র তৈরি হওয়ায় গাড়ির প্রকৃত মালিকরা হারিয়ে যাওয়া গাড়ি উদ্ধার করতে পারছেন না। জানা যায়, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খুলনা বিআরটিএ অফিসের উপ-পরিচালক, সহকারী পরিচালক, পরিদর্শক, সিল মেকানিক, অফিস সহকারী, কম্পিউটার সহকারী নামোল্লেখ করে এই অবৈধ কার্যক্রমে তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানান হয়েছে। এগারজন অস্থায়ী কর্মচারী, দালাল চক্রের বারজনের নামও দেয়া হয়েছে। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
No comments