প্রতিবন্ধী মাহমুদের সমাজ পরিবর্তনের লড়াই
সোলায়মান তুষার: কলেজছাত্র মাহমুদুল আলম। ট্রেন দুর্ঘটনায় দু’টি পা হারিয়েছেন। চলাফেরা করেন হুইল চেয়ারে করে। জীবনের এ প্রতিবন্ধকতা নিয়েই মাহমুদ সমাজ পরিবর্তনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিনাবেতনে গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন গ্রন্থাগার। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার জন্যও প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সুতিয়া ক্রীড়া কানন’। মাহমুদ গফরগাঁও জেলার ছয়ানী রসুলপুর গ্রামের সন্তান। পুরো গ্রামটি তিনি শিক্ষিত করে তুলতে চান। নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি চালু করেছেন বিনাবেতনের টিউশনি। আর বয়স্কদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন লাইব্রেরি। মাহমুদের স্বপ্ন পিছিয়ে পড়া গ্রামটি একদিন শিক্ষিত হয়ে উঠবে। নিজের প্রতিবন্ধকতা নিয়েই এসএসসি পাস করেছেন। কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন কোর্স শেষ করেছেন। পেয়েছেন এ প্লাস। একাদশ শ্রেণীতে পড়ালেখা করছেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে। মাহমুদ ২০১২ সালে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ভাই-বোন সবাই বিবাহিত। আর্থিকভাবে সাহায্য করেন তার বোন হাফছা খাতুন। হাফছা ব্র্যাককর্মী। ৮ বছর বয়সেই মা মারজিয়া খাতুন ইহলোক ত্যাগ করেন। দুর্ঘটনার পর ১৯৯৭ সালে পিতা আবদুল মোমেন মোল্লা মারা যান। মাহমুদ পড়লেখা শেষ করে সরকারি চাকরি করার স্বপ্ন দেখেন। পা হারানোর ফলে সঠিক সময়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। সে সময় অবশ্য কাটিয়েছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সাহায্য করে। তিনি সাভারের সিআরপি মাধব স্মৃতি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন কোর্স শেষ করেন। কম্পিউটার কোর্সের সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য এসেছিলেন ঢাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ৩৬৫ নম্বর কক্ষের ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান ও নাজমুল হকের কাছে অবস্থান করেন। সেখানেই কথা হয় মাহমুদের সঙ্গে। ১৯৯৬ সালের ৬ই এপ্রিল বিকালে মাহমুদ ‘বলাকা’ ট্রেনযোগে ঢাকায় বড়ভাইয়ের কাছে আসছিলেন। ট্রেনে জায়গা না থাকায় দরজার হাতল ধরে দাঁড়ান। নাখালপড়া আসতেই ট্রেনের ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে যান রেললাইনে। পরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন মাহমুদ। বলেন, ট্রেন আমার দুই পায়ের ওপর দিয়ে গেল। ২টি পা শরীর থেকে বিচ্ছন্ন হতে দেখলাম। আমি ভাগ্যক্রমে রেললাইনের ফাঁকা জায়গায় পড়েছিলাম। আল্লাহ আমার জীবনটা অন্তত রক্ষা করেছেন। এরপর দু’জন লোক এগিয়ে এলেন আমার সাহায্যে। তারাই নিয়ে গেলেন ঢাকা মেডিকেলে। তাদের নাম আজ আর মনে নেই। ১৯৯৬ সালের ৬ই এপ্রিল থেকে ১২ই জুন পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল ও পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। আমি ডা. এজাজ আহমেদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলাম। তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা থাকলেও পঙ্গুত্বের কারণে দিতে পারিনি। ২০০১ সালে রায়ের গ্রাম শহীদ স্মৃতি দাখিল মাদরাসা থেকে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৩.১৭ পান। পঙ্গুত্ববরণের কারণে বারবারই লেখাপড়ায় গ্যাপ পড়ে। তারপরও স্বপ্ন হারাননি মাহমুদ। মাহমুদ বলেন, বেঁচে যাওয়ার পর ‘সংগ্রামী জীবন’ বেছে নিই। আজ আমার দু’টি পা নেই। সংগ্রাম করেই আমাকে টিকে থাকতে হবে। আমি সমাজের মধ্যে পরিবর্তন করতে চাই। ছয়ানী রসুলপুর গ্রামটিকে শিক্ষিত করে তুলতে চাই। পুরো গ্রামের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই। মাহমুদ বলেন, ‘আজ ইচ্ছে হলেই আমি বাড়ির সামনের পুকুরে একটু সাঁতার কাটতে পারি না। ইচ্ছে হলেই থোকায় থোকায় ফোটা মাধবী লতার বোঁটায় স্পর্শ করতে পারিনা। তবুও এ না পারার ক্ষোভের মধ্যে আমি নতুন পথে, নতুন মতে আমি নির্মল আনন্দের সন্ধ্যান করি। আমি এখন আমার গ্রামের বাড়িতে ছোট্ট একটা মুদির দোকান পরিচালনা করি। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করি। মাহমুদ ছয়ানী রসুলপুরের ৬নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়ান। ২০০৮ সালে তিনি এ স্কুলের কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এরপর ২০১০ সালের ১৫ই অক্টোবর তার সঙ্গে যোগ দেন শাহনাজ পারভীন, এনামুল হক, মুসলেমা ইসলাম, লিজা, আফিয়া খাতুন শিমু, নিলুফা, খোরশেদ আলম, নাজমুল হক। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থী বেড়ে দাঁড়ায় একশ’র উপরে। তাদের কার্যক্রমে সাহায্য করেন ওয়াহিদুল ইসলাম, মোশারফ হোসেন, নাজির আহমেদ শরীফ, খলিলুর রহমান, ফরিদ আহমেদ, সাইদুল ইসলাম, খালেকুজ্জামান, আবু রায়হান। এরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। স্বাবলম্বী পরিবারের ছেলেমেয়েরা মাসিক ১০০ টাকা করে দেন। তা দিয়ে চলে দৈনন্দিন ব্যয়। বিভিন্ন পরামর্শ ও নানাভাবে তাদের সাহায্য করেন ৬নং ছয়ানী রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এডভোকেট আনিছুর রহমান, রসুলপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এম আর খায়রুল, মাদরাসা শিক্ষক ইউসুফ। মাহমুদ শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার কথা মাথায় রেখে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুতিয়া ক্রীড়া কানন’। ২০১০ সালের ১লা জানুয়ারি ৬নং ছয়ানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলার আয়োজন করে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে একুশে বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান, একুশে বিষয়ক নাটিকা, একুশে বিষয়ক কবিতা আবৃত্তির আয়োজন করা হয়। সর্বশেষ ৩১শে ডিসেম্বর ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ‘সুতিয়া ক্রীড়া কানন’-এর ব্যবস্থাপনায়। ওই অনুষ্ঠানে ৬নং ছয়ানী রসুলপুর সরকারি বিদ্যালয়, ছয়ানী আনিছুর রহমান বালিকা দাখিল মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। মাহমুদ তার বন্ধুদের নিয়ে ‘গণগ্রন্থাগার’ নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে প্রায় ৩০০ বই রয়েছে। মাহমুদ বলেন, একদিন হয়তো আমার নেয়া ছোট পদক্ষেপের কারণে পুরোগ্রামটি শিক্ষিত হবে। ‘গণগ্রন্থাগার’ বিশাল লাইব্রেরিতে পরিণত হবে। ‘সুতিয়া ক্রীড়া কানন’ প্রতিবছর খেলাধুলার আয়োজন করবে। কেউ হয়তো একদিন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। মাহমুদ বলেন, পড়ালেখা শেষ করে আমি চাকরি করার স্বপ্ন দেখি। সেটা আমার জেলার মধ্যে হলে ভাল। তখন হয়তো অর্থনৈতিকভাবে অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হবে না।
No comments