চট্টগ্রামে বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়ার ঘোষণা-১২ মার্চ চলো চলো ঢাকা চলো-কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ বাধা দিলে দায়িত্ব সরকারের by তৌফিকুল ইসলাম বাবর ও হাসান শিপলু
চট্টগ্রামের বিশাল জনসভা থেকে 'চলো চলো ঢাকা চলো' স্লোগানে রাজধানীতে ১২ মার্চ মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। কর্মসূচি ঘোষণা করে তিনি বলেন, এটি হবে শান্তিপূর্ণ। এতে বাধা দিলে দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। বর্তমান সরকারকে 'ব্যর্থ' দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, 'আপনাদের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। তাই অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন।'
গতকাল সোমবার রোডমার্চের সমাপনী জনসভায় লক্ষাধিক লোকের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ডে চারদলীয় ঐক্যজোট জনসভার আয়োজন করে। এটি ছিল বিএনপির শেষ রোডমার্চ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে ঘোষিত প্যাকেজ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ২৯ জানুয়ারি রোববার বিভাগীয় ও জেলা সদরে গণমিছিল। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে গণসংযোগ, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। এসএসসি পরীক্ষার কারণে এ মাসে (ফেব্রুয়ারি) বড় ধরনের কর্মসূচি পালন করা হবে না বলে জানান বিরোধীদলীয় নেতা।
খালেদা জিয়া জনতার উদ্দেশে বলেন, 'আমি আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার চট্টগ্রামে এসেছি। আপনারা কী আমার ডাকে সাড়া দেবেন?' এ সময় সমস্বরে সবাই হ্যাঁ জবাব দেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'আপনাদের চলো চলো স্লোগান দিয়ে ঢাকায় যেতে হবে। দেশ রক্ষায় সবাইকে এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে।' তিনি বলেন, '৮৬
সালে আঁতাত করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে গিয়েছিল। তখন এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিল, আর আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল। এবার একই প্রক্রিয়ায় ঋণ শোধ করতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, আর এরশাদের জাতীয় পার্টি হবে বিরোধী দল_ এটিই তাদের পরিকল্পনা। এবার তা হতে দেওয়া হবে না।
অতীতের ভুলের কথা স্বীকার করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'আমাদের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। আমরা ফেরেশতা নই, মানুষ। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করব। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দেশ পরিচালনা করব।'
বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে জনসভাস্থলে এসে পেঁৗছান খালেদা জিয়া। মঞ্চে উঠে লাখো জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান তিনি। নেতাকর্মীরাও তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন সার্কিট হাউসে যান। সেখানে বিশ্রাম শেষে ৭টা ৪০ মিনিটে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। মধ্যরাতে ফেনীতে যাত্রাবিরতি করেন।
জনসভাকে ঘিরে উৎসবমুখর ছিলেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর, দক্ষিণ জেলা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে মহাসমাবেশে লাখ লাখ মানুষ যোগ দেন। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ছবি সংবলিত রঙ-বেরঙের বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার হাতে মিছিল নিয়ে আসেন বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। পলো গ্রাউন্ড মাঠ ও আশপাশের এলাকা মানুষের পাশাপাশি ভরে ওঠে ব্যানার-ফেস্টুনে। পলো গ্রাউন্ড মাঠ সংলগ্ন সড়ক, বিআরটিসি, দেওয়ানহাট মোড়, টাইগারপাস মোড়, শুভপুর বাসস্টেশন, পুরো কদমতলীসহ আশপাশের এলাকা লোকেলোকারণ্য হয়ে ওঠে। এসব এলাকায় দুপুর ১২টার পর থেকে বন্ধ ছিল যানবাহন চলাচল।
চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ড মাঠে এটি ছিল বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রথম জনসভা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মাঠে জনসভা করেছিলেন।
অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। জনসভার ভেতরে-বাইরে ছিল সাদা পোশাকধারী বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা।
খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুরুর আধা ঘণ্টা আগে মাঠের বাইরের মাইকগুলো বিকল হয়ে যায়। তাই নেতাকর্মীদের বিশাল অংশকে বক্তব্য না শুনেই ফিরতে হয়।
বিকেল ৪টা ৫০ থেকে পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বিরোধিতা করলে চলবে না। নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই হতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তার দাবি, বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ভয় পায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করলে তাতে বিরোধী দল অংশ নেবে না। ওই নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ দেশে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অতীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল, ভবিষ্যতেও হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং লতিফুর রহমানের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করেছিল। এখন আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দীনের 'অসাংবিধানিক ও অবৈধ' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অজুহাত দেখিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে।
তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল না করে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপকে 'লোক দেখানো' বলে অভিহিত করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, সংলাপের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নেই। তারা সব নিজেদের মতোই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। সার্চ কমিটি গঠন করে নিজেদের মতো ইসি গঠন করবে। এভাবে ইসি গঠন করে লাভ হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে ইসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
সীমান্ত হত্যা, টিপাইমুখ বাঁধসহ নানা চুক্তির সমালোচনা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেক গভীর বলে দাবি করেন তারা। বলা হয়, হাসু-মমতা দিদি সম্পর্ক বেশ ভালো। হাসু দি (শেখ হাসিনা) মমতা দিদিকে খুশি করতে ইলিশ, জামদানি শাড়ি উপহার দিয়েছেন। তাতেও কাজ হয়নি। ভারত একটু ছাড় দেয়নি। তিস্তার চুক্তি করেনি। তিনি বলেন, সম্পর্ক হতে হবে দেশের সঙ্গে দেশের, জনগণের সঙ্গে জনগণের। আমরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব রাখতে চাই।
সেনাবাহিনীর অফিসাররাও এখন গুম হচ্ছে দাবি করেন তিনি। খালেদা বলেন, সেনাবাহিনীর ভালো অফিসাররা চাকরি হারাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বলেছিল, সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না। এবার তাই সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রক্ষীবাহিনী ও লালবাহিনীর মতো নতুন বাহিনী গঠন করে ভারত তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আওয়ামী লীগ তাদের অধীনে পুতুল সরকারের হয়ে কাজ করবে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। দেশ রক্ষায় আপনারা স্লোগান দিচ্ছেন, এ মুহূর্তে দরকার খালেদা জিয়ার সরকার। আমি বলব, খালেদা জিয়ার নয়, দরকার জনগণের সরকার।
বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের ব্যর্থতা, অপশাসন, দুর্নীতি, পররাষ্ট্রনীতি, গুপ্তহত্যাসহ সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেন। পাশাপাশি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গ্রামকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এ নগরের মানুষকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এগিয়ে আসতে হবে।
বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য : জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, আওয়ামী লীগ যত চেষ্টাই করুক তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। এলডিপি সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ বলেন, দেশের চরম দুর্দিনে মানুষকে মুক্তি দিতে হাল ধরেছেন খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণ তাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিথ্যাবাদী ও ওয়াদার বরখেলাপকারী এ সরকারকে বিদায় জানাতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বর্তমান সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার বলে অভিহিত করে বলেন, তারা দেশে বাকশালী কায়দায় একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এম কে আনোয়ার বলেন, বর্তমান জালেম সরকারকে হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী বলেন, 'বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্বল করতে আমার স্বামীকে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। চালানো হয়েছে নির্যাতন।'
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পলো গ্রাউন্ড মাঠে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হওয়ার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসী বর্তমান সরকারকে 'না' বলে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও নগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম মনজুরুল আলম, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, বরকত উল্লা বুলু, মোঃ শাহজাহান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার, ফজলুল হক মিলন, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম, খায়রুল কবীর খোকন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মিয়া মোঃ গোলাম পরওয়ার, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, রোজি কবির, অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, মাজহারুল ইসলাম দোলন, জামায়াত নেতা মাওলানা শামসুল ইসলাম এমপি, বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আমীরুল ইসলাম আলিম, বিএনপি নেতা মোস্তফা কামাল পাশা এমপি, শিরীন সুলতানা প্রমুখ।
দুর্ভোগ ছিল চরমে
মহাসমাবেশ উপলক্ষে পুলিশ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাস আটকে দেয় নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায়। এখানে কক্সবাজার ও কাপ্তাই থেকে আসা লোকজনকে হেঁটে গন্তব্যস্থলে যেতে হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সব গাড়ি নগরীর অলঙ্কার মোড়, বড়পোল, আগ্রাবাদ বারিক বিল্ডিং মোড়ে আটকে যায়। হাটহাজারী, রাঙামাটি, ফটিকছড়ির গাড়ি নগরীর অক্সিজেন মোড়ে আটকানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সমাবেশের গাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেও পাবলিক যানবাহনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। চারদিকে আটকানো গাড়িস্থল থেকে সমাবেশস্থলের দূরত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। ফলে অফিস, স্কুল এবং কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হওয়া লোকজন চরম বিপাকে পড়ে। মাইলের পর মাইল হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে অনেককে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আসা কোনো গাড়ি শহরে ঢুকতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল অসহনীয়।
খালেদা জিয়া জনতার উদ্দেশে বলেন, 'আমি আপনাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার চট্টগ্রামে এসেছি। আপনারা কী আমার ডাকে সাড়া দেবেন?' এ সময় সমস্বরে সবাই হ্যাঁ জবাব দেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'আপনাদের চলো চলো স্লোগান দিয়ে ঢাকায় যেতে হবে। দেশ রক্ষায় সবাইকে এ কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে।' তিনি বলেন, '৮৬
সালে আঁতাত করে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে গিয়েছিল। তখন এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিল, আর আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল। এবার একই প্রক্রিয়ায় ঋণ শোধ করতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, আর এরশাদের জাতীয় পার্টি হবে বিরোধী দল_ এটিই তাদের পরিকল্পনা। এবার তা হতে দেওয়া হবে না।
অতীতের ভুলের কথা স্বীকার করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, 'আমাদের ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। আমরা ফেরেশতা নই, মানুষ। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করব। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে দেশ পরিচালনা করব।'
বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে জনসভাস্থলে এসে পেঁৗছান খালেদা জিয়া। মঞ্চে উঠে লাখো জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান তিনি। নেতাকর্মীরাও তাকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। জনসভা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন সার্কিট হাউসে যান। সেখানে বিশ্রাম শেষে ৭টা ৪০ মিনিটে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। মধ্যরাতে ফেনীতে যাত্রাবিরতি করেন।
জনসভাকে ঘিরে উৎসবমুখর ছিলেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর, দক্ষিণ জেলা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে মহাসমাবেশে লাখ লাখ মানুষ যোগ দেন। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ছবি সংবলিত রঙ-বেরঙের বিভিন্ন ব্যানার, পোস্টার হাতে মিছিল নিয়ে আসেন বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। পলো গ্রাউন্ড মাঠ ও আশপাশের এলাকা মানুষের পাশাপাশি ভরে ওঠে ব্যানার-ফেস্টুনে। পলো গ্রাউন্ড মাঠ সংলগ্ন সড়ক, বিআরটিসি, দেওয়ানহাট মোড়, টাইগারপাস মোড়, শুভপুর বাসস্টেশন, পুরো কদমতলীসহ আশপাশের এলাকা লোকেলোকারণ্য হয়ে ওঠে। এসব এলাকায় দুপুর ১২টার পর থেকে বন্ধ ছিল যানবাহন চলাচল।
চট্টগ্রামের পলো গ্রাউন্ড মাঠে এটি ছিল বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার প্রথম জনসভা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মাঠে জনসভা করেছিলেন।
অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। জনসভার ভেতরে-বাইরে ছিল সাদা পোশাকধারী বিপুলসংখ্যক গোয়েন্দা।
খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুরুর আধা ঘণ্টা আগে মাঠের বাইরের মাইকগুলো বিকল হয়ে যায়। তাই নেতাকর্মীদের বিশাল অংশকে বক্তব্য না শুনেই ফিরতে হয়।
বিকেল ৪টা ৫০ থেকে পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বিরোধিতা করলে চলবে না। নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই হতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। তার দাবি, বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ভয় পায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন করলে তাতে বিরোধী দল অংশ নেবে না। ওই নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এ দেশে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে অতীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল, ভবিষ্যতেও হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং লতিফুর রহমানের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করেছিল। এখন আওয়ামী লীগ ফখরুদ্দীনের 'অসাংবিধানিক ও অবৈধ' তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অজুহাত দেখিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইছে।
তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল না করে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপকে 'লোক দেখানো' বলে অভিহিত করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, সংলাপের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির নেই। তারা সব নিজেদের মতোই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। সার্চ কমিটি গঠন করে নিজেদের মতো ইসি গঠন করবে। এভাবে ইসি গঠন করে লাভ হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে ইসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
সীমান্ত হত্যা, টিপাইমুখ বাঁধসহ নানা চুক্তির সমালোচনা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অনেক গভীর বলে দাবি করেন তারা। বলা হয়, হাসু-মমতা দিদি সম্পর্ক বেশ ভালো। হাসু দি (শেখ হাসিনা) মমতা দিদিকে খুশি করতে ইলিশ, জামদানি শাড়ি উপহার দিয়েছেন। তাতেও কাজ হয়নি। ভারত একটু ছাড় দেয়নি। তিস্তার চুক্তি করেনি। তিনি বলেন, সম্পর্ক হতে হবে দেশের সঙ্গে দেশের, জনগণের সঙ্গে জনগণের। আমরা সমমর্যাদার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব রাখতে চাই।
সেনাবাহিনীর অফিসাররাও এখন গুম হচ্ছে দাবি করেন তিনি। খালেদা বলেন, সেনাবাহিনীর ভালো অফিসাররা চাকরি হারাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ বলেছিল, সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে না। এবার তাই সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রক্ষীবাহিনী ও লালবাহিনীর মতো নতুন বাহিনী গঠন করে ভারত তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আওয়ামী লীগ তাদের অধীনে পুতুল সরকারের হয়ে কাজ করবে। এভাবে দেশ চলতে পারে না। দেশ রক্ষায় আপনারা স্লোগান দিচ্ছেন, এ মুহূর্তে দরকার খালেদা জিয়ার সরকার। আমি বলব, খালেদা জিয়ার নয়, দরকার জনগণের সরকার।
বিরোধীদলীয় নেতা সরকারের ব্যর্থতা, অপশাসন, দুর্নীতি, পররাষ্ট্রনীতি, গুপ্তহত্যাসহ সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেন। পাশাপাশি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিএনপি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, গ্রামকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ঐতিহাসিক এ নগরের মানুষকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এগিয়ে আসতে হবে।
বিএনপিসহ চারদলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য : জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, আওয়ামী লীগ যত চেষ্টাই করুক তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারবে না। এলডিপি সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ বলেন, দেশের চরম দুর্দিনে মানুষকে মুক্তি দিতে হাল ধরেছেন খালেদা জিয়া। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মহাজোট সরকার দেশ পরিচালনায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জনগণ তাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিথ্যাবাদী ও ওয়াদার বরখেলাপকারী এ সরকারকে বিদায় জানাতে হবে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বর্তমান সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার বলে অভিহিত করে বলেন, তারা দেশে বাকশালী কায়দায় একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এম কে আনোয়ার বলেন, বর্তমান জালেম সরকারকে হটিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী বলেন, 'বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্বল করতে আমার স্বামীকে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। চালানো হয়েছে নির্যাতন।'
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পলো গ্রাউন্ড মাঠে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হওয়ার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামবাসী বর্তমান সরকারকে 'না' বলে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও নগর সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এম মনজুরুল আলম, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাছির, শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, বরকত উল্লা বুলু, মোঃ শাহজাহান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খোন্দকার, ফজলুল হক মিলন, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম, খায়রুল কবীর খোকন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মিয়া মোঃ গোলাম পরওয়ার, সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, রোজি কবির, অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরব, মাজহারুল ইসলাম দোলন, জামায়াত নেতা মাওলানা শামসুল ইসলাম এমপি, বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাধারণ সম্পাদক আমীরুল ইসলাম আলিম, বিএনপি নেতা মোস্তফা কামাল পাশা এমপি, শিরীন সুলতানা প্রমুখ।
দুর্ভোগ ছিল চরমে
মহাসমাবেশ উপলক্ষে পুলিশ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাস আটকে দেয় নগরীর বহদ্দারহাট এলাকায়। এখানে কক্সবাজার ও কাপ্তাই থেকে আসা লোকজনকে হেঁটে গন্তব্যস্থলে যেতে হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সব গাড়ি নগরীর অলঙ্কার মোড়, বড়পোল, আগ্রাবাদ বারিক বিল্ডিং মোড়ে আটকে যায়। হাটহাজারী, রাঙামাটি, ফটিকছড়ির গাড়ি নগরীর অক্সিজেন মোড়ে আটকানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সমাবেশের গাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেও পাবলিক যানবাহনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। চারদিকে আটকানো গাড়িস্থল থেকে সমাবেশস্থলের দূরত্ব ছিল ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার। ফলে অফিস, স্কুল এবং কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হওয়া লোকজন চরম বিপাকে পড়ে। মাইলের পর মাইল হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে অনেককে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে আসা কোনো গাড়ি শহরে ঢুকতে পারেনি। ফলে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ভোগান্তি ছিল অসহনীয়।
No comments