সেবার পরিধি কম by তাসলিমা তামান্না

মাত্র কয়েক বছর আগে নবজাতকের মৃত্যু সারাবিশ্বে অন্যতম বড় সমস্যা ছিল। কিন্তু গত দুই দশকে এ মৃত্যুর হার ২৮ শতাংশ কমেছে। তবে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ১০টি দেশে এখনও নবজাতকের মৃত্যু আশাব্যঞ্জক হারে কমেনি। এই ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তমে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১০-এর তথ্য অনুযায়ী, সারাবিশ্বে ৩০ লাখের বেশি নবজাতক মারা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১ লাখ ১৩ হাজারের বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে,


এই মৃত্যু কমাতে হলে জরুরিভাবে প্রসব-পরবর্তী সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। তা না হলে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
ল্যানসেটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সারাবিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি শিশু জন্ম নিচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম চার সপ্তাহের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৪০ লাখ নবজাতক। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু জন্মের চার সপ্তাহ খুবই সতর্ক থাকতে হয়। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পরপর সঠিক পরিচর্যা নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০০৭ সালের তথ্য অনুযায়ী এ দেশে যেসব নবজাতক মারা যায় তাদের অর্ধেক জন্মের প্রথম দিনেই মারা যায়। আর ৭৫ শতাংশ নবজাতক মারা যায় প্রথম সপ্তাহে। তাদের সূত্র অনুযায়ী, সাধারণত তিনটি কারণে দেশে নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে। প্রথমত, বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন; দ্বিতীয়ত, জন্মের পর শ্বাস নিতে না পারা এবং তৃতীয়ত, কম ওজনে জন্ম নেওয়া। তবে কোথাও কোথাও আবার ভুল চিকিৎসা বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে_ এমন অভিযোগও রয়েছে।
দেশে নবজাতকের মৃত্যু প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার আগের চেয়ে অনেক কমেছে। তবে এটা ঠিক, আরও কমানো প্রয়োজন। তার মতে, গর্ভাবস্থায় ঠিকমতো চিকিৎসা না করানো নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া অপ্রশিক্ষিত দাইয়ের মাধ্যমে এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রসব করানো নবজাতকের মৃত্যুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ। তিনি জানান, সরকার ইতিমধ্যে মা ও নবজাতক শিশুর মৃত্যুহার কমাতে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ধাত্রীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও আছে। এটা খুবই ইতিবাচক। তবে যারা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে তাদের ঠিকমতো দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন যাতে তারা সাধারণ জনগণকে সঠিক তথ্য পেঁৗছাতে পারে। এ জন্য তাদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তার মতে, নবজাতকের মৃত্যু রোধে সচেতনতার বিকল্প নেই।
নবজাতকের মৃত্যুর সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, বিভিন্ন রকমের ইনফেকশনের কারণে জন্ম নেওয়া ৩৬ শতাংশ শিশু মারা যায়। তিনি বলেন, জন্মের পরে নবজাতকের মায়ের দুধ অর্থাৎ শালদুধ পাওয়াটা খুবই জরুরি। জন্মের পরে নবজাতককে বুকের দুধ না খাওয়ালে নানা সমস্যা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবেও নবজাতকের ইনফেকশন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নবজাতকের কাছে যেতে হলে ভালোমতো হাত-পা পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। তিনি জানান, অনেক বাবা-মা আছেন যারা নবজাতক অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সে ক্ষেত্রেও নবজাতকের জীবনের শঙ্কা থাকে। জন্মের পরপরই যদি কোনো শিশু না কাঁদে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। কান্নার মাধ্যমেই নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে বাড়িতেই ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হয়। যাদের অনেকেই প্রশিক্ষিত নন। তারা অনেকেই জানেন না এমন হলে তাৎক্ষণিকভাবে নবজাতককে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। তিনি বলেন, কম ওজনের শিশু জন্ম নিচ্ছে অপরিণত মায়েদের কারণে। বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণ বাল্যবিবাহ এখনও হচ্ছে তার পরিসংখ্যান বলা সম্ভব নয়। তবে সচেতনতা বাড়লেও এখনও এর সংখ্যা অনেক। বাল্যবিবাহের শিকার মায়েরা অপুষ্টির কারণে কম ওজনের শিশুর জন্ম দিচ্ছে। এতে মায়েদের যেমন মৃত্যুঝুঁকি থাকছে, তেমনি তাদের শিশুরাও মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছে। এ জন্য শুধু স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করলেই হবে না। যেহেতু এটা সামাজিক সমস্যা সমাজকর্মীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, ৫ বছর আগেও দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যেত। সচেতনতা, চিকিৎসার উন্নয়নের কারণে এখন তা ২৬ হাজারে নেমে এসেছে। একইভাবে আমরা দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার আরও কমে আসবে বলে আশা করছি।
দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার কমলেও সেবা পরিধি এখনও কম। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা । ঁ

No comments

Powered by Blogger.