এই নগরীর দিনরাত্রিঃ ঘড়ির কাঁটার চমক by রেজোয়ান সিদ্দিকী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই যে কবে দিনের আলো দিয়ে বিদ্যুত্ বাঁচানোর অলীক কল্পনায় রাত এগারোটায়ই দেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে বারোটা বেজেই আছে। বেজেই যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে নাগরিকরা তার কাছ থেকে অনেক মধুর কথা শুনেছিলেন।
শুনেছিলেন তারা ক্ষমতায় গেলে দেশে বিদ্যুতের সঙ্কট বলে আর কিছু থাকবে না। চারদিকে হাসির হল্লা বয়ে যাবে। ঝলমল করবে বিদ্যুত্। তারপর ক্ষমতায় এসে তারা জানিয়ে দিলেন, তাদের হাতে আলাদীনের চেরাগ নেই যে, ঘষা দিলেই বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠবে। শুধু বিদ্যুত্ কেন, আরও কত যে মধুর মধুর কথা আমরা শুনেছিলাম, সেগুলো বেশুমার। তারপর সরকার গঠন করে তারা কেবলই একের পর এক চমক দিতে থাকে। প্রথম চমকটি ছিল তার মন্ত্রিসভা। তাতেই দুই-একজন ছাড়া আর সবই নতুন মুখ। এই মন্ত্রিসভাকে তার দলেই কেউ কেউ আনাড়ি, কেউবা কচিকাঁচার আসর, কেউবা পাঠশালার ছাত্র বলে অভিহিত করলেন। গত ১০ মাসে প্রমাণিত হয়েছে, এরা সত্যি আনাড়ি এবং মন্ত্রিত্ব করার যোগ্যতা অর্জনেও অনাগ্রহী। ওই মন্ত্রিসভা যখন গঠিত হলো, তখন সকলেই একে চমক বলে অভিহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য এখনও বলে যাচ্ছেন, প্রথম প্রথম সবাই নতুন থাকে। অভিজ্ঞতা অর্জন করে। এরপর তারা পুরনো হয়। এক সময় এরাও পুরনো হবে। অভিজ্ঞ হবে।
সরকার মনে হয় এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের কল্যাণ-অকল্যাণ বিবেচনায় নিতে চান না। মন্ত্রিসভা যদি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করতে না পারে তাহলে নাগরিকদের অকল্যাণ হয়। ভোগান্তি বাড়ে। যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি দক্ষ হতেন, তাহলে নিশ্চয়ই আইন-শৃঙ্খলার এতটা অবনতি ঘটত না। নাগরিকদের জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে উঠত না। সেই কারণেই আমরা নাগরিকরা সরকারের গুণাগুণ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি।
সরকারের চমকে নাগরিকের যদি অকল্যাণ হয়, তাহলে সেই চমক কেউ মেনে নেয় না। সরকার তেমনি আর এক চমক দেখিয়েছে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দিয়ে। রাত এগারোটায়ই ঘড়ির কাঁটা ঠেলে সরিয়ে বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে চমক ছিল। সরকার নাগরিকদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিল, ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিলে বিদ্যুত্ বাঁচবে; কিন্তু বিদ্যুত্ বাঁচেনি। আর অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন দেশের নাগরিকরা। এখন সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুল মানে অভিভাবকদের ফজরের আজানের আগেই নিজে ওঠে ছেলেমেয়েদের তৈরি করতে হয়। শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পথে ঝিমায়। ক্লাসরুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এতে তার লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকরা অভিসম্পাত করছেন। বিদ্যুত্ বাঁচাতে সরকার সরকারি কর্মচারীদের স্যুট পরা নিষিদ্ধ করেছে। স্রেফ শার্ট-প্যান্ট পরে অফিস করার নির্দেশ দিয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে কোনো ড্রেস-কোড জারি করা হয়নি। সেই যা রক্ষা!
তাছাড়া ঘড়ির কাঁটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সরকার পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশকে একটি অনাধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। যে কোনো দেশের সময় নির্ণীত হয় দ্রাঘিমা রেখার হিসাব ধরে। দ্রাঘিমা রেখার হিসাব করে, মানচিত্রের পাতা দেখে ঘরে বসেই ভূগোলের যে কোনো ছাত্র বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন দেশে কখন কতটা বাজে। দ্রাঘিমা রেখাগুলো এমনভাবে আঁকা হয়েছে, তাতে প্রতি এক ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ ৪ মিনিট সময় নির্দেশ করে। আর বাংলাদেশের ঠিক মধ্যভাগ দিয়ে অতিক্রম করেছে ৯০হ্ন দ্রাঘিমা রেখা। গ্রিনিচের পূর্বদিকে বাংলাদেশের অবস্থান। সে হিসাবে গ্রিনিচ সময়ের সঙ্গে ৯০–৪ মিনিট অর্থাত্ ৬ ঘণ্টা যোগ করে বাংলাদেশে সময় নির্ণয় করা হয়। পৃথিবীর সব দেশই এই নিয়ম অনুসরণ করে চলে। এর যে কোনো ব্যতিক্রম নেই, সে কথা বলছি না; কিন্তু এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। কোনো দেশই তার দেশের সময় খেয়াল-খুশিমত বদলে দেয় না। বর্তমান সরকার ভূগোলের এবং দিন-রাতের এই নিয়মনীতি বদলে দিয়েছে।
দ্রাঘিমা রেখা হিসাব করে যুক্তরাষ্ট্র, অসেল্ট্রলিয়া নিজ নিজ দেশকে একাধিক টাইমজোনে ভাগ করেছে। আবার কোনো কোনো দেশ একই সময় বহাল রেখেছে। যেমন ভারতে পূর্ব থেকে পশ্চিমে দ্রাঘিমা রেখার দূরত্ব অনুযায়ী সময়ের হেরফের ১০০ মিনিট; কিন্তু জনগণের কষ্টের কথা ভেবে সে দেশের সরকার গোটা দেশকে একটি টাইমজোনেই সীমিত রেখেছে। আর জনগণের কষ্ট বিবেচনায় না নিয়ে আমাদের সরকার সভ্যতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অহেতুক গ্রিনিচ মানের হিসাবের চেয়ে এক ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। যেন আমরা আছি এক হীরক রাজার দেশে।
একটি খুনের প্রত্যক্ষদর্শী
বাংলাদেশে বর্তমান চমকের সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিদিন ১০ জনের অধিক মানুষ খুন হয়েছে। খুনের ঘটনা গ্রামাঞ্চল থেকে নগরে অনেক বেশি। প্রতিদিনই এই নগরীতে কোনো না কোনো মানুষ খুন হচ্ছে। পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সেসব খুনের বিবরণ প্রকাশিত হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খুনের কোনো না কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকে। সে প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেক সময় খুনের ঘটনা বর্ণনা করেন। সে বর্ণনা সামান্যই প্রকাশিত হয়। তার ভয়, তার আতঙ্ক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
গত ৮ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে রাত পৌনে ১০টার দিকে এমনি এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেল। রিকশায় আসছিলেন তিন যুবক। তাজমহল রোডের পূর্বদিকে সে রিকশা একটি গলির মুখে ঢুকতেই কোথা থেকে যেন দুটি মোটরসাইকেলে করে ছয়জন যমদূত দু’পাশ দিয়ে এসে রিকশার গতিরোধ করে দিল। এই ঘটনায় রিকশার দুই যাত্রী প্রাণভয়ে কোথায় যে ছুটে পালাল, বোঝা গেল না। মোটরসাইকেল দুটি থেকে ঝটপট নেমে গেল চারজন যাত্রী। পাশে একটি চটপটির দোকানে চটপটি খাচ্ছিল কেউ কেউ। লোকজনের আনাগোনা ছিল। সড়কে বহুবিধ যানবাহন ছিল। গলিটা কিছুটা ফাঁকা। মোটরসাইকেল আরোহী চারজনের একজন পিস্তল বের করে রিকশায় বসে থাকা লোকটাকে লক্ষ্য করে পরপর তিন রাউন্ড গুলি ছুড়ল। মুহূর্তেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল তারা।
গুলি খেয়ে রিকশার যাত্রী পড়ে গেলেন রিকশা থেকে। সব লোক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন সিনেমার কাহিনীর মতো ঘটে গেল এই ঘটনা। আহত নাগরিক কয়েক মিনিট একাকীই পড়ে থাকলেন রাস্তার ওপর। তার পেটে, পায়ে ও বাহুতে গুলি লেগেছে। অন্য নাগরিকরা সিএনজি থামিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেলেন হাসপাতালের দিকে।
এটা কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ছিল না। এই যুবককে গুলি করে বন্দুকবাজরা তার ধারে-কাছেও আসেনি। ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেনি তার নগদ অর্থ, হাতঘড়ি, মোবাইল বা সোনার চেন। মনে হয় তাকে হত্যা করাই ওই ঘাতকদের উদ্দেশ্য।
ওই গুলির ঘটনায় এই নাগিরকের মৃত্যু হয়েছে কিনা জানি না; কিন্তু ঘাতকদের সাহস যে কত বেড়েছে এই ঘটনাই তার প্রমাণ। দেশে প্রতিদিন যত খুনের ঘটনা ঘটছে তার সামান্যেরই কিনারা হচ্ছে। খুনিরা নিরুপদ্রবে পালিয়ে যেতে পারছে। নাগরিকের নিরাপত্তা ক্রমেই শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকার কি এর কোনো দায়দায়িত্বই বহন করবে না?
চিত্তের দায়
জীবনে চিত্তের প্রয়োজন আছে। ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য উন্নত চিকিত্সার জন্য, সন্তানের লেখাপড়ার জন্য বিত্তের প্রয়োজন; কিন্তু জীবনে কী বিত্তই শেষ কথা? নগর তো ক্রমেই মানুষকে চিত্তবাসনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সকলেই বিত্তের পেছনে ছুটছে। লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধি, শ্রম-সাধনা সবকিছুই চলছে বিত্তের আশায়; কিন্তু বিত্ত কী চিত্তবৃত্তিকে বাদ দিয়ে? চিত্তের কী কোনো চাহিদা নেই?
আমাদের সমাজ যেন চিত্তের চাহিদাকে অস্বীকার করে বসেছে। আমাদের সব প্রয়াস, প্রচেষ্টা, আয়োজন বিত্তকে ঘিরে। দেশে কয়েকটি মাত্র সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর কোনো কোনোটিতে মানবিক বিষয়গুলোর অস্তিত্ব নেই। আর সব ফাঁকা। এখন অর্ধশতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। সেখানে মানবিক বিষয়গুলোর অস্তিত্বই নেই। সাহিত্য নেই, ললিতকলা নেই, ইতিহাস নেই, ভূগোল নেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞান নেই, ধর্মচর্চা নেই, কেবলই বাণিজ্য বিষয়ের ছড়াছড়ি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ইবা বলি কেন, বহু মাধ্যমিক স্কুলে মানবিক শাখা নেই। কেবল বাণিজ্য আর বিজ্ঞান আছে।
কিন্তু মানবিক শাখা না থাকলে মানবিকতার চর্চা যে বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। হৃদয় প্রসারিত হবে না। সমাজ কোটি কোটি যন্ত্রমানবের জন্ম দেবে। প্রকৃত মানুষ গড়ে উঠবে না। দেশে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা হ্রাস পেয়েছে। সত্তর-আশির দশকে যা ছিল, এখন তা নেই। জন্ম হচ্ছে না জানান দেয়ার কবি-ঔপন্যাসিক-নাট্যকারের। জন্ম হচ্ছে না সাহিত্য সমালোচকের। সত্তর-আশির দশকে এসব ক্ষেত্রে যারা জনিপ্রয় হয়ে উঠেছিলেন, এখনও তারাই জনপ্রিয়তার শীর্ষে। নতুনরা এসে আসন দাবি করতে পারছে না। নবীনের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে না শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গন। এই দীনদশা থেকে জাতিকে মুক্ত করা প্রয়োজন। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার, তাদের বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত। যেন আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এক চিত্তহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে তৈরি না করে যাই।
ফুটনোট
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, তিনি দ্রব্যমূল্য অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন। তার এই কথা শুনে মন্তব্য করলেন একজন গৃহিণী, ‘প্রধানমন্ত্রীকে তো আর আমাদের মতো ব্যাগ হাতে বাজারে যেতে হয় না। হলে তিনি বুঝতেন, তিনি দ্রব্যমূল্য কার্যত দ্বিগুণ করে ফেলেছেন।’

No comments

Powered by Blogger.