আল্লাহ’র ওয়াস্তে ছাত্রলীগের একটা গতি করুন by ফজলুল বারী
আওয়ামী লীগের আগের আমলে ছাত্রলীগের এক নেতার ধর্ষণের সেঞ্চুরির বিচারের দাবিতে তখনকার চলমান আন্দোলনের নিউজ কভার করতে বেশ কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করেছি। কী সবুজ ক্যাম্পাস অথচ তখনও কী সন্ত্রস্ত!
আজকের মতো তখনও সেখানে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে আন্দোলন চলছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকদের অনেকে এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকায় আন্দোলনের টাটকা সব খবরও আসছিল মিডিয়ায়। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদ তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের কলঙ্ক লুকানোর ভদ্রোচিত চেষ্টা-আত্তির যা যা করা সম্ভব, সবই তখন তিনি করছিলেন! এর জন্যে পরে তাকে পুরস্কৃতও করা হয়। উপাচার্যের চাকরি শেষে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমে এমপি হন। এবার মন্ত্রীর পদ মর্যাদায় উপদেষ্টা! তার সাবেক ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগেরই শুধু কোনো উন্নতি নেই। শুধু স্খলন আর স্খলন!
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নেতৃত্বের স্মারক ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃ্ত্বের বদগুণে জাবি ক্যাম্পাসসহ সারাদেশ জুড়ে এখন ভয়ের এক নাম!
সবশেষ এ সংগঠন নামধারী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা জাবিতে জুবায়ের নামের নিজেদেরই এক কর্মীকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে! পরীক্ষার হল থেকে বের হবার পর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে-পিটিয়ে এক ছাত্র হলের তিনতলা থেকে ফেলে দেয়! এরপর নিজেরাই তাকে স্থানীয় এক হাসপাতালে ফেলে আসে। সেখান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকার এক হাসপাতালে স্থানান্তর করে দশ ব্যাগ রক্ত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু জুবায়েরকে বাঁচানো যায়নি। ঢাকার ডাক্তাররা বলেছেন, তাদের কাছে আনার আগেই রক্তক্ষরণ হতে হতে জীবনদীপ প্রায় নিভে গিয়েছিল। তার দুটো পা, একটি হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। সারা গায়ে ছিল কোপের দাগ!
অতএব, মৃত্যু ছাড়া কোনো গতি ছিল না তার। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ নৃশংসতায় এখন কাঁদছে গোটা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস। জুবায়েরের বাবা-মা, স্বজন, সহপাঠীরা কাঁদছেন।
শুধু কাঁদছে না সরকারি হৃদয়! কারণ, এ তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এক পাপ! এ পাপ দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে ২০০৮ সালে জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট! অথচ কতো আশায় ভর করে মানুষ এ ম্যান্ডেটটি দিয়েছিল! কিন্তু এখন দেশ জুড়ে আরেক উপলদ্ধির বাস্তবতা!
এরা দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে, নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের একটা ছাত্রলীগ চালাতে-সামলাতে পারে না, এমন একটি হতাশ ক্রোধ এর মাঝে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়ে গেছে! এ অবস্থা কেন বা এর শেষ কোথায়? সরকারকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
ক’দিন আগে ধর্ষণের দায়ে ধরা পড়েছেন সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এক নৃত্যশিল্পীকে এনে অনুষ্ঠান শেষে তার স্বামীকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে কামক্রিয়ায় লাগেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। ভীতসন্ত্রস্ত স্বামী বেচারা রাস্তায় গিয়ে টহল পুলিশকে সামনে পেয়ে সাহায্য চান। কিন্তু তার আগেও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নামধারী দুই ধর্ষকের রতিক্রিয়া শেষ! পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালায় দুই পাষণ্ড।
এর মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের ধর্ষক সাধারণ সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তার তোলা ছবি দেখে মনে হবে, কি অবাক নির্লজ্জ বিকারহীন! যেন পুলিশ প্রটোকলে কোথাও বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে! গ্রেপ্তার এড়াতে এখনও দৌড়ের ওপর আছেন জেলা ছাত্রলীগের ধর্ষক সভাপতি।
মিডিয়ায় বিষয়টি আনএডিটেড চলে আসার পর চক্ষুলজ্জায় সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঘটনাকে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্ত, সাজানো ঘটনা দাবি করার সময় পাওয়া যায়নি। আর এখন বের হচ্ছে সাবেক আরও কাহিনী। সেই ধর্ষকদের সেটিই প্রথম ঘটনা নয়। সমানে চালাচ্ছিল! দল ক্ষমতায়। অতএব ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছিল না। এমনকি জেলার পুলিশ সুপারও তাদের কাছে ছিলেন অসহায়। পুলিশে চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছিলেন।
কি পাওয়ারফুল ছাত্রলীগ নেতা একেকজন! পুলিশেও চাকরি দিতে পারেন! কিন্তু যাদের থেকে টাকা নিয়েছিলেন তারা পুলিশের নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করেননি। অতএব তারা পুলিশ নিয়োগের প্রাথমিক বাছাই থেকেই বাদ পড়ে যান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই ছাত্রলীগ নেতা নামধারীরা এসপির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। বেচারা এসপি চাকরি বাঁচাতে পরে তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন।
যেখানে জেলার পুলিশ সুপারকে এমন জিম্মি অবস্থায় চাকরি করতে হয়, সেখানে জেলার আইনশৃঙ্খলা অথবা সরকারি ছাত্র সংগঠনের পরিস্থিতি কী বেপরোয়া রূপ নিতে পারে, সেটি অনুমান করা যায়।
এতো গেল জাহাঙ্গীরনগর আর সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের দুটি দৃষ্টান্ত মাত্র। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ে এ সংগঠন নামধারী গুণ্ডারা গত ৬ মাসে সাধারণ ছাত্র থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট, ছাত্রদল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, এলাকার ব্যবসায়ীদের ওপর কমপক্ষে ১০ বার হামলা চালিয়েছে। টেন্ডারসহ নানা ভাগাভাগি, গ্রুপিং’এ নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে ১৯ বার। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি-সংঘর্ষ সেখানে এখন নৈমিত্তিক বিষয়।
এমন সারা দেশের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব খবরই দেশের মানুষের কাছে আছে। এখন পর্যন্ত দেশের মোট কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু ছাত্রলীগের মারামারিতে বন্ধ হয়েছে? এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে মেরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে, একজন জড়িয়ে ধরে রাখছে, আরেকজন কোপ দিচ্ছে, এসব ঘটনার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ছবি কি অস্বীকার করার সুযোগ আছে?
অথচ, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার ছাত্রীবেলায় ছাত্রলীগ করতেন। সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃ্ত্ব দিয়েছে শিক্ষা শান্তি প্রগতি নীতি-আদর্শ স্লোগানধারী এ সংগঠন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি এ সংগঠনের হাতে। এ সংগঠনের নেতার হাতে প্রথম উড়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছেন এ সংগঠনেরই এক নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়বাংলা’ স্লোগান এখনও ছাত্রলীগের স্লোগান। এখনও তোফায়েল আহমদ থেকে শুরু করে ওবায়দুল কাদেরকেও মানুষ চেনে-জানে ‘ছাত্রলীগের তোফায়েল’, ‘ছাত্রলীগের কাদের’ নামে।
এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী সেই তুমুল আলোড়নের মান্না-আখতাররাও আওয়ামী লীগের নেতা। তবে বঞ্চিত নেতা! সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকী, সদ্য প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ থেকে শুরু করে হাসানুল হক ইনু, শেখ শহিদুল ইসলাম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শিরিন আখতার প্রমুখ ছাত্রলীগের প্রোডাক্ট হলেও মূলধারার জায়গাগুলো থেকে ছিটকে নানা বদনাম-বঞ্চনা নিলেও কেউ অন্তত বলতে পারবে না, তারা কেউ ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডা ছিলেন।
এক সময় শেখ হাসিনার হয়ে ছাত্রলীগ দেখতেন আমির হোসেন আমু। তোফায়েলগং তখন থেকেই কোনঠাসা। বলা হয়, তখন থেকে সাংগঠনিক-রাজনৈতিক ছাত্রলীগ-আদর্শের আনুগত্যের বদলে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এর নেতৃত্ব আসার-থাকার উপায় হয়ে দাঁড়ায়। ঐতিহ্য, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বকীয়তা হারিয়ে ড্রইংরুম পলিটিক্সে ঢুকে যায় ছাত্রলীগ। দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের অগ্রসর শক্তি আর সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে থেকে যে সংগঠনের বিকাশ-ব্যপ্তি, সে সংগঠনের নেতারা নির্দিষ্ট কিছু ড্রইংরুম চিনে ফেলেন। তারা জেনে ফেলেন নতুন ঘরানার এক গ্রুপিং রাজনীতির ফর্মূলা!
ছাত্রলীগের নেতা হতে-থাকতে শুধু ক্যাম্পাসের সঙ্গে না, এসব ড্রইংরূমের সঙ্গেও সুসম্পর্ক থাকা চাই। এভাবেই দিনে দিনে সংগ্রামী সংগঠনের ঐতিহ্যটিও গেছে ছাত্রলীগের। এসবে তখন একটি রসাত্মক স্লোগানও জনপ্রিয় হয়, ‘ছাত্রলীগ খাইছি, যুবলীগ খাইছি এখন আওয়ামী লীগ খামু আমার নাম--!’ ১/১১’ ঝড়ে আওয়ামী লীগে আমির হোসেন আমুর প্রভাব বলয়ের সোনার খাঁচার দিনগুলো আর নেই। ওকে কমিশন অথবা এক সময়ের প্রভাবশালী ওবায়দুল কাদেরের অনুগতও নেই আর ছাত্রলীগ। এমনকি এরশাদ শাসন পরবর্তী মইনুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর মতো পরিশ্রমী-আদর্শিক-সততার প্রতিচ্ছবি কেউও আর ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্বে আসতে পারছেন না। আরও কী কী কারণে ছাত্রলীগ এর পথ হারিয়েছে তা সংগঠনটির সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ জড়িতরা আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন।
এটি এখন সরাসরি শেখ হাসিনার বাড়ি থেকে নিয়ন্ত্রিত-পরিচালিত হয়। শেখ হাসিনার হয়ে অথবা তার নামে কারা এই নিয়ন্ত্রণ পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করেন, তাও মোটামুটি সবাই জানেন।
অতএব আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য হারিয়ে ছাত্রলীগ এখন মোটামুটি একটি পাওয়ার গ্রুপের রূপ নিয়েছে। ছাত্রলীগ বা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ পরিষ্কার জানাশুনা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী খুঁজে বের করতে এখন অনুবীক্ষণযন্ত্র লাগবে। কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃ্ত্ব নির্বাচনের কথা বলা হলেও এটি কি রকম নেত্রীর ইচ্ছা নির্ধারিত তা ওয়াকিবহালরা জানেন। সবশেষ এ সংগঠনের নেতা নির্বাচনের ভালো একটি দিক আদুভাই ছাত্র নেতাদের বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্র, নতুন প্রজন্মের অগ্রাধিকার। কিন্তু নির্বাচিতদের নৈতিকতা বহাল অথবা ক্ষমতার দাপুটে লোভ রক্ষা করে চলবার বা চালাবার কোনো যোগসূত্রও যেন নেই অথবা সে বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্ব কেনার, কমিটি অনুমোদনেরও অভিযোগ আছে। এমন সবশেষ অভিযোগটি হচ্ছে সাতক্ষীরার ধর্ষক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃ্ত্বাধীন জেলা কমিটির অনুমোদন টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়।
এসব চরিত্রের ছাত্রলীগের এখনকার মূল বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এখানে জায়গা হয় না। ক্ষমতা থেকে বিদায় হলে ভালো একটি মিছিল-সমাবেশ করার নেতা-কর্মীও জোগাড় করা কষ্ট হয়! বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ চিত্রটি প্রকাশ পায় সবার আগে। বলা হয়, সাংগঠনিক নীতি-আদর্শের চর্চার প্রবণতা-প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এ ছাত্রলীগের নিচের স্তরের অনেক নেতা-কর্মী সমর্থকের ছাত্রদল হয়ে যেতে আবার ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল সমর্থক এমন অনেকের ছাত্রলীগ হয়ে যেতেও সময় লাগে না! এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যখন ছাত্রলীগের নামে মস্তানি-গুণ্ডামি-টেন্ডারবাজি এসব ভীষণ বেড়ে গেল তখন দলের কোনো কোনো নেতা ছাত্রলীগে ছাত্রদল-ছাত্র শিবিরের কর্মী-এজেন্টদের ঢুকে পড়ার কথা তুলেছিলেন।
কিন্তু এ দাবিটি বেশিক্ষণ টেকেনি। অথচ তারা দেশ চালান, প্রশাসন চালান তবু এসব এজেন্ট ধরতে বা শনাক্ত করতে পারেন না। কেন পারেন না --এ প্রশ্ন আসলে তারা চুপ মেরে যান! অতএব ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের মস্তানি-টেন্ডারবাজিও সমানে চলতে থাকে।
এসব নিয়ে সমালোচনা তীব্র হলে ক্ষুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়ান। ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকেও বিরত থাকেন কিছুদিন। কিন্তু ছাত্রলীগের নামে গুণ্ডামি-মস্তানি কিন্তু তাতেও থামেনি। অথবা হাসিনা থাকলেন কিনা সে পরোয়াও তারা করেনি।
দলের কিছু লোক তখন প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের সঙ্গে ভিন্নমত দেখিয়ে বলেন, ছাত্রলীগকে দূরে সরিয়ে রেখে নয়, কাছে রেখে সংশোধন করতে হবে। এরপর সংগঠনের নতুন একটি কমিটি করে দিয়ে আবার এর সঙ্গে বসা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর গুণ্ডামি-মস্তানিও থামলো না, নিয়ন্ত্রণেও এলো না! সবশেষ ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ আমলে নিয়ে এর সাতক্ষীরা জেলা কমিটি বাতিল করতে হয়েছে।
কিন্তু ওই ঘটনার পরপর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গণভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃ্ত্বের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রীকে অনেক গাল দিয়েছেন। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটির জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটু বকেছেন, এমনও শোনা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ঘটনার পর বলা হয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। তাই ঘটনার দায়-দায়িত্বও ছাত্রলীগের নয়। দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর পুলিশের। কিন্তু একটা খুনের পরতো এভাবে বললেই পার পাওয়া যাবে না। এর আগে কি ছাত্রলীগ একবারও তার নামধারী সেখানকার একটা গুণ্ডাকেও পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে? না পুলিশকে কখনো বলেছে, সেখানে অমুক অমুক ছাত্রলীগের নামে গুণ্ডামি করছে, তাদেরকে ধরুন। সাতক্ষীরার ধর্ষণের মতো জাহাঙ্গীরনগরের খুনের ঘটনার দায়িত্বও ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃ্ত্বকে নিতে হবে।
আজকাল মাঝে মাঝেই বলা হয়, ছাত্রলীগের নামে কেউ গুণ্ডামি করলেও তাকে ছাড়া হচ্ছে না, ধরা হচ্ছে। এ সম্পর্কে মিডিয়ার প্রচারণা ঠিক নয়। হলুদ সাংবাদিকতা ইত্যাদি। ক্ষমতায় যেতে মিডিয়াসহ সব কিছু লাগে। আর একবার ক্ষমতায় চলে যেতে পারলে, প্রচারণা একটু বিপক্ষে চলে গেলে সব কিছু যেন একটু বেশি হলুদ হলুদ, টকশোগুলোকে বেশি টক টক মনে হয়।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মী নামধারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেবার দাবি সত্যি হয় তাহলে সরকার কি দেশের মানুষকে এর একটি তালিকা দিয়ে বলতে পারবে, এবার তারা ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নামে এতগুলো গুণ্ডামির ঘটনায় মোট এতোজনকে আটক করা হয়েছে, এবং এতোজন এখন জেলে আছে! তাহলে তো মানুষ অন্তত বুঝতো, সরকার এই গুণ্ডামি বন্ধে আন্তরিক। বা এমন আটক থাকলেতো দেশের ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বন্দীওয়ালা জেলখানাগুলোতে চার-পাঁচগুণ বন্দী থাকার কথা উঠতো।
কিন্তু নীতি যদি হয়, বেশি বিপাকে পড়ে গেলে একদিকে একটারে ধরলাম আর পরিস্থিতি চুপচাপ হয়ে গেলে ‘আর দুষ্টামি করিস না, ছেড়ে দিলাম’! এভাবে কী এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব?
মাঝে কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টেন্ডারবাজি বন্ধে তার সরকার পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নিয়েছে। খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কিন্তু সরকারি পরিচয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামের যারা চলমান এনালগ পদ্ধতিতে টেন্ডারবাজি করেই যাচ্ছে তাদের কেন ঠেকানো যাচ্ছে না বা ঠেকানো হচ্ছে না, এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বা এ দলের কারোরই কোনো সাফ বক্তব্য নেই। দলের কিছু লোকজনকে একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি করে দিতেই কী এসব কিছুতে দেখেও না দেখার ভান করা হচ্ছে? এটি কী তার সঠিক প্রক্রিয়া? একটা দল সরকার চালাতে পারবে, আর দলের নামধারী কিছু গুণ্ডাকে আটকাতে থামাতে পারবে না এটি যদি দেশের মানুষকে বিশ্বাস করতে বলা হয়, তাহলেতো মানুষ উল্টো বলবে, ‘অনেক হয়েছে, আর লাগবে না যান।’
অতএব, সরকারি লোকজনের কাছে সোজা চাওয়াটি হলো, আল্লাহর ওয়াস্তে এবার ক্ষান্ত দিন। ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাগুলোকে সামলান। ছাত্রলীগের একটা গতি করুন। তিন বছর ধরে এক ছাত্রলীগ যদি আপনারা না সামলাতে পারেন, তাহলে দেশের মানুষকে কী সুশাসন দেবেন?
জামায়াতে ইসলামীর বাচ্চা সংগঠন ছাত্র শিবিরের নাম দেশের মানুষজনের কাছে রগকাটা শিবির। ছাত্রদলেরও গুণ্ডামি-নৃশংস অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু ছাত্রলীগও যে সে রকম হয়ে গেছে অথবা তাদের ছাড়িয়ে গেছে এটিতো এখন সাচ্চা সত্য। এটা যদি স্বীকার না করে উটপাখির মতো মাথা বালিতে গুঁজে থাকার চলতি প্রবণতা চলে, তাহলে চরম ভুল।
ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের মাস্তানি-গুণ্ডামিতে ভয় বেশি আমাদের, যারা আওয়ামী লীগ করি না অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এ সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। ছাত্রলীগের গুণ্ডামি অথবা কোনো কারণে যদি এ বিচার কোনো বিলম্বিত-বিঘ্নিত হয়, আমাদের যাওয়ার-চাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
এর জন্য বারবার করে বলছি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ, এদের থামান, গুণ্ডা ধরুন। নইলে কিন্তু পাবলিকই এদের একদিন ধরা শুরু করে দেবে।
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নেতৃত্বের স্মারক ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃ্ত্বের বদগুণে জাবি ক্যাম্পাসসহ সারাদেশ জুড়ে এখন ভয়ের এক নাম!
সবশেষ এ সংগঠন নামধারী গুণ্ডা-সন্ত্রাসীরা জাবিতে জুবায়ের নামের নিজেদেরই এক কর্মীকে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করেছে! পরীক্ষার হল থেকে বের হবার পর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে-পিটিয়ে এক ছাত্র হলের তিনতলা থেকে ফেলে দেয়! এরপর নিজেরাই তাকে স্থানীয় এক হাসপাতালে ফেলে আসে। সেখান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকার এক হাসপাতালে স্থানান্তর করে দশ ব্যাগ রক্ত দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু জুবায়েরকে বাঁচানো যায়নি। ঢাকার ডাক্তাররা বলেছেন, তাদের কাছে আনার আগেই রক্তক্ষরণ হতে হতে জীবনদীপ প্রায় নিভে গিয়েছিল। তার দুটো পা, একটি হাত ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। সারা গায়ে ছিল কোপের দাগ!
অতএব, মৃত্যু ছাড়া কোনো গতি ছিল না তার। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ নৃশংসতায় এখন কাঁদছে গোটা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস। জুবায়েরের বাবা-মা, স্বজন, সহপাঠীরা কাঁদছেন।
শুধু কাঁদছে না সরকারি হৃদয়! কারণ, এ তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এক পাপ! এ পাপ দুমড়ে-মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে ২০০৮ সালে জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট! অথচ কতো আশায় ভর করে মানুষ এ ম্যান্ডেটটি দিয়েছিল! কিন্তু এখন দেশ জুড়ে আরেক উপলদ্ধির বাস্তবতা!
এরা দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে, নিয়েছে। কিন্তু নিজেদের একটা ছাত্রলীগ চালাতে-সামলাতে পারে না, এমন একটি হতাশ ক্রোধ এর মাঝে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়ে গেছে! এ অবস্থা কেন বা এর শেষ কোথায়? সরকারকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।
ক’দিন আগে ধর্ষণের দায়ে ধরা পড়েছেন সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ জুয়েল ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে এক নৃত্যশিল্পীকে এনে অনুষ্ঠান শেষে তার স্বামীকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে কামক্রিয়ায় লাগেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। ভীতসন্ত্রস্ত স্বামী বেচারা রাস্তায় গিয়ে টহল পুলিশকে সামনে পেয়ে সাহায্য চান। কিন্তু তার আগেও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নামধারী দুই ধর্ষকের রতিক্রিয়া শেষ! পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালায় দুই পাষণ্ড।
এর মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের ধর্ষক সাধারণ সম্পাদককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তার তোলা ছবি দেখে মনে হবে, কি অবাক নির্লজ্জ বিকারহীন! যেন পুলিশ প্রটোকলে কোথাও বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে! গ্রেপ্তার এড়াতে এখনও দৌড়ের ওপর আছেন জেলা ছাত্রলীগের ধর্ষক সভাপতি।
মিডিয়ায় বিষয়টি আনএডিটেড চলে আসার পর চক্ষুলজ্জায় সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের জেলা কমিটি ভেঙ্গে দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঘটনাকে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্ত, সাজানো ঘটনা দাবি করার সময় পাওয়া যায়নি। আর এখন বের হচ্ছে সাবেক আরও কাহিনী। সেই ধর্ষকদের সেটিই প্রথম ঘটনা নয়। সমানে চালাচ্ছিল! দল ক্ষমতায়। অতএব ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারছিল না। এমনকি জেলার পুলিশ সুপারও তাদের কাছে ছিলেন অসহায়। পুলিশে চাকরি পাইয়ে দেবার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে তারা টাকা নিয়েছিলেন।
কি পাওয়ারফুল ছাত্রলীগ নেতা একেকজন! পুলিশেও চাকরি দিতে পারেন! কিন্তু যাদের থেকে টাকা নিয়েছিলেন তারা পুলিশের নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করেননি। অতএব তারা পুলিশ নিয়োগের প্রাথমিক বাছাই থেকেই বাদ পড়ে যান। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই ছাত্রলীগ নেতা নামধারীরা এসপির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। বেচারা এসপি চাকরি বাঁচাতে পরে তাদের টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছেন।
যেখানে জেলার পুলিশ সুপারকে এমন জিম্মি অবস্থায় চাকরি করতে হয়, সেখানে জেলার আইনশৃঙ্খলা অথবা সরকারি ছাত্র সংগঠনের পরিস্থিতি কী বেপরোয়া রূপ নিতে পারে, সেটি অনুমান করা যায়।
এতো গেল জাহাঙ্গীরনগর আর সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের দুটি দৃষ্টান্ত মাত্র। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায়ে এ সংগঠন নামধারী গুণ্ডারা গত ৬ মাসে সাধারণ ছাত্র থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট, ছাত্রদল, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, এলাকার ব্যবসায়ীদের ওপর কমপক্ষে ১০ বার হামলা চালিয়েছে। টেন্ডারসহ নানা ভাগাভাগি, গ্রুপিং’এ নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে ১৯ বার। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি-সংঘর্ষ সেখানে এখন নৈমিত্তিক বিষয়।
এমন সারা দেশের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সব খবরই দেশের মানুষের কাছে আছে। এখন পর্যন্ত দেশের মোট কতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু ছাত্রলীগের মারামারিতে বন্ধ হয়েছে? এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে মেরে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছে, একজন জড়িয়ে ধরে রাখছে, আরেকজন কোপ দিচ্ছে, এসব ঘটনার ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ছবি কি অস্বীকার করার সুযোগ আছে?
অথচ, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার ছাত্রীবেলায় ছাত্রলীগ করতেন। সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি আন্দোলনে নেতৃ্ত্ব দিয়েছে শিক্ষা শান্তি প্রগতি নীতি-আদর্শ স্লোগানধারী এ সংগঠন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির নিউক্লিয়াসের সৃষ্টি এ সংগঠনের হাতে। এ সংগঠনের নেতার হাতে প্রথম উড়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছেন এ সংগঠনেরই এক নেতা। মুক্তিযুদ্ধের ‘জয়বাংলা’ স্লোগান এখনও ছাত্রলীগের স্লোগান। এখনও তোফায়েল আহমদ থেকে শুরু করে ওবায়দুল কাদেরকেও মানুষ চেনে-জানে ‘ছাত্রলীগের তোফায়েল’, ‘ছাত্রলীগের কাদের’ নামে।
এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী সেই তুমুল আলোড়নের মান্না-আখতাররাও আওয়ামী লীগের নেতা। তবে বঞ্চিত নেতা! সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকী, সদ্য প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ থেকে শুরু করে হাসানুল হক ইনু, শেখ শহিদুল ইসলাম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, শিরিন আখতার প্রমুখ ছাত্রলীগের প্রোডাক্ট হলেও মূলধারার জায়গাগুলো থেকে ছিটকে নানা বদনাম-বঞ্চনা নিলেও কেউ অন্তত বলতে পারবে না, তারা কেউ ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডা ছিলেন।
এক সময় শেখ হাসিনার হয়ে ছাত্রলীগ দেখতেন আমির হোসেন আমু। তোফায়েলগং তখন থেকেই কোনঠাসা। বলা হয়, তখন থেকে সাংগঠনিক-রাজনৈতিক ছাত্রলীগ-আদর্শের আনুগত্যের বদলে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এর নেতৃত্ব আসার-থাকার উপায় হয়ে দাঁড়ায়। ঐতিহ্য, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বকীয়তা হারিয়ে ড্রইংরুম পলিটিক্সে ঢুকে যায় ছাত্রলীগ। দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের অগ্রসর শক্তি আর সাধারণ ছাত্রদের দাবি-দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে থেকে যে সংগঠনের বিকাশ-ব্যপ্তি, সে সংগঠনের নেতারা নির্দিষ্ট কিছু ড্রইংরুম চিনে ফেলেন। তারা জেনে ফেলেন নতুন ঘরানার এক গ্রুপিং রাজনীতির ফর্মূলা!
ছাত্রলীগের নেতা হতে-থাকতে শুধু ক্যাম্পাসের সঙ্গে না, এসব ড্রইংরূমের সঙ্গেও সুসম্পর্ক থাকা চাই। এভাবেই দিনে দিনে সংগ্রামী সংগঠনের ঐতিহ্যটিও গেছে ছাত্রলীগের। এসবে তখন একটি রসাত্মক স্লোগানও জনপ্রিয় হয়, ‘ছাত্রলীগ খাইছি, যুবলীগ খাইছি এখন আওয়ামী লীগ খামু আমার নাম--!’ ১/১১’ ঝড়ে আওয়ামী লীগে আমির হোসেন আমুর প্রভাব বলয়ের সোনার খাঁচার দিনগুলো আর নেই। ওকে কমিশন অথবা এক সময়ের প্রভাবশালী ওবায়দুল কাদেরের অনুগতও নেই আর ছাত্রলীগ। এমনকি এরশাদ শাসন পরবর্তী মইনুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর মতো পরিশ্রমী-আদর্শিক-সততার প্রতিচ্ছবি কেউও আর ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্বে আসতে পারছেন না। আরও কী কী কারণে ছাত্রলীগ এর পথ হারিয়েছে তা সংগঠনটির সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ জড়িতরা আরও বিস্তারিত বলতে পারবেন।
এটি এখন সরাসরি শেখ হাসিনার বাড়ি থেকে নিয়ন্ত্রিত-পরিচালিত হয়। শেখ হাসিনার হয়ে অথবা তার নামে কারা এই নিয়ন্ত্রণ পরিচালনার দায়িত্বটি পালন করেন, তাও মোটামুটি সবাই জানেন।
অতএব আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহ্য হারিয়ে ছাত্রলীগ এখন মোটামুটি একটি পাওয়ার গ্রুপের রূপ নিয়েছে। ছাত্রলীগ বা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ পরিষ্কার জানাশুনা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী খুঁজে বের করতে এখন অনুবীক্ষণযন্ত্র লাগবে। কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃ্ত্ব নির্বাচনের কথা বলা হলেও এটি কি রকম নেত্রীর ইচ্ছা নির্ধারিত তা ওয়াকিবহালরা জানেন। সবশেষ এ সংগঠনের নেতা নির্বাচনের ভালো একটি দিক আদুভাই ছাত্র নেতাদের বাদ দিয়ে নিয়মিত ছাত্র, নতুন প্রজন্মের অগ্রাধিকার। কিন্তু নির্বাচিতদের নৈতিকতা বহাল অথবা ক্ষমতার দাপুটে লোভ রক্ষা করে চলবার বা চালাবার কোনো যোগসূত্রও যেন নেই অথবা সে বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের নেতৃ্ত্ব কেনার, কমিটি অনুমোদনেরও অভিযোগ আছে। এমন সবশেষ অভিযোগটি হচ্ছে সাতক্ষীরার ধর্ষক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নেতৃ্ত্বাধীন জেলা কমিটির অনুমোদন টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়।
এসব চরিত্রের ছাত্রলীগের এখনকার মূল বৈশিষ্ট্য আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এখানে জায়গা হয় না। ক্ষমতা থেকে বিদায় হলে ভালো একটি মিছিল-সমাবেশ করার নেতা-কর্মীও জোগাড় করা কষ্ট হয়! বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ চিত্রটি প্রকাশ পায় সবার আগে। বলা হয়, সাংগঠনিক নীতি-আদর্শের চর্চার প্রবণতা-প্রয়োজনীয়তা কমে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এ ছাত্রলীগের নিচের স্তরের অনেক নেতা-কর্মী সমর্থকের ছাত্রদল হয়ে যেতে আবার ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল সমর্থক এমন অনেকের ছাত্রলীগ হয়ে যেতেও সময় লাগে না! এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যখন ছাত্রলীগের নামে মস্তানি-গুণ্ডামি-টেন্ডারবাজি এসব ভীষণ বেড়ে গেল তখন দলের কোনো কোনো নেতা ছাত্রলীগে ছাত্রদল-ছাত্র শিবিরের কর্মী-এজেন্টদের ঢুকে পড়ার কথা তুলেছিলেন।
কিন্তু এ দাবিটি বেশিক্ষণ টেকেনি। অথচ তারা দেশ চালান, প্রশাসন চালান তবু এসব এজেন্ট ধরতে বা শনাক্ত করতে পারেন না। কেন পারেন না --এ প্রশ্ন আসলে তারা চুপ মেরে যান! অতএব ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের মস্তানি-টেন্ডারবাজিও সমানে চলতে থাকে।
এসব নিয়ে সমালোচনা তীব্র হলে ক্ষুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়ান। ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকেও বিরত থাকেন কিছুদিন। কিন্তু ছাত্রলীগের নামে গুণ্ডামি-মস্তানি কিন্তু তাতেও থামেনি। অথবা হাসিনা থাকলেন কিনা সে পরোয়াও তারা করেনি।
দলের কিছু লোক তখন প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের সঙ্গে ভিন্নমত দেখিয়ে বলেন, ছাত্রলীগকে দূরে সরিয়ে রেখে নয়, কাছে রেখে সংশোধন করতে হবে। এরপর সংগঠনের নতুন একটি কমিটি করে দিয়ে আবার এর সঙ্গে বসা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এর গুণ্ডামি-মস্তানিও থামলো না, নিয়ন্ত্রণেও এলো না! সবশেষ ধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ আমলে নিয়ে এর সাতক্ষীরা জেলা কমিটি বাতিল করতে হয়েছে।
কিন্তু ওই ঘটনার পরপর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে গণভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃ্ত্বের সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বিরোধীদলের নেত্রীকে অনেক গাল দিয়েছেন। কিন্তু ধর্ষণের ঘটনাটির জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটু বকেছেন, এমনও শোনা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ঘটনার পর বলা হয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। তাই ঘটনার দায়-দায়িত্বও ছাত্রলীগের নয়। দায়-দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আর পুলিশের। কিন্তু একটা খুনের পরতো এভাবে বললেই পার পাওয়া যাবে না। এর আগে কি ছাত্রলীগ একবারও তার নামধারী সেখানকার একটা গুণ্ডাকেও পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে? না পুলিশকে কখনো বলেছে, সেখানে অমুক অমুক ছাত্রলীগের নামে গুণ্ডামি করছে, তাদেরকে ধরুন। সাতক্ষীরার ধর্ষণের মতো জাহাঙ্গীরনগরের খুনের ঘটনার দায়িত্বও ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃ্ত্বকে নিতে হবে।
আজকাল মাঝে মাঝেই বলা হয়, ছাত্রলীগের নামে কেউ গুণ্ডামি করলেও তাকে ছাড়া হচ্ছে না, ধরা হচ্ছে। এ সম্পর্কে মিডিয়ার প্রচারণা ঠিক নয়। হলুদ সাংবাদিকতা ইত্যাদি। ক্ষমতায় যেতে মিডিয়াসহ সব কিছু লাগে। আর একবার ক্ষমতায় চলে যেতে পারলে, প্রচারণা একটু বিপক্ষে চলে গেলে সব কিছু যেন একটু বেশি হলুদ হলুদ, টকশোগুলোকে বেশি টক টক মনে হয়।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মী নামধারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেবার দাবি সত্যি হয় তাহলে সরকার কি দেশের মানুষকে এর একটি তালিকা দিয়ে বলতে পারবে, এবার তারা ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নামে এতগুলো গুণ্ডামির ঘটনায় মোট এতোজনকে আটক করা হয়েছে, এবং এতোজন এখন জেলে আছে! তাহলে তো মানুষ অন্তত বুঝতো, সরকার এই গুণ্ডামি বন্ধে আন্তরিক। বা এমন আটক থাকলেতো দেশের ধারণ ক্ষমতার তিনগুণ বন্দীওয়ালা জেলখানাগুলোতে চার-পাঁচগুণ বন্দী থাকার কথা উঠতো।
কিন্তু নীতি যদি হয়, বেশি বিপাকে পড়ে গেলে একদিকে একটারে ধরলাম আর পরিস্থিতি চুপচাপ হয়ে গেলে ‘আর দুষ্টামি করিস না, ছেড়ে দিলাম’! এভাবে কী এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব?
মাঝে কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টেন্ডারবাজি বন্ধে তার সরকার পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ নিয়েছে। খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কিন্তু সরকারি পরিচয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামের যারা চলমান এনালগ পদ্ধতিতে টেন্ডারবাজি করেই যাচ্ছে তাদের কেন ঠেকানো যাচ্ছে না বা ঠেকানো হচ্ছে না, এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বা এ দলের কারোরই কোনো সাফ বক্তব্য নেই। দলের কিছু লোকজনকে একটি অর্থনৈতিক ভিত্তি করে দিতেই কী এসব কিছুতে দেখেও না দেখার ভান করা হচ্ছে? এটি কী তার সঠিক প্রক্রিয়া? একটা দল সরকার চালাতে পারবে, আর দলের নামধারী কিছু গুণ্ডাকে আটকাতে থামাতে পারবে না এটি যদি দেশের মানুষকে বিশ্বাস করতে বলা হয়, তাহলেতো মানুষ উল্টো বলবে, ‘অনেক হয়েছে, আর লাগবে না যান।’
অতএব, সরকারি লোকজনের কাছে সোজা চাওয়াটি হলো, আল্লাহর ওয়াস্তে এবার ক্ষান্ত দিন। ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাগুলোকে সামলান। ছাত্রলীগের একটা গতি করুন। তিন বছর ধরে এক ছাত্রলীগ যদি আপনারা না সামলাতে পারেন, তাহলে দেশের মানুষকে কী সুশাসন দেবেন?
জামায়াতে ইসলামীর বাচ্চা সংগঠন ছাত্র শিবিরের নাম দেশের মানুষজনের কাছে রগকাটা শিবির। ছাত্রদলেরও গুণ্ডামি-নৃশংস অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু ছাত্রলীগও যে সে রকম হয়ে গেছে অথবা তাদের ছাড়িয়ে গেছে এটিতো এখন সাচ্চা সত্য। এটা যদি স্বীকার না করে উটপাখির মতো মাথা বালিতে গুঁজে থাকার চলতি প্রবণতা চলে, তাহলে চরম ভুল।
ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের মাস্তানি-গুণ্ডামিতে ভয় বেশি আমাদের, যারা আওয়ামী লীগ করি না অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এ সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। ছাত্রলীগের গুণ্ডামি অথবা কোনো কারণে যদি এ বিচার কোনো বিলম্বিত-বিঘ্নিত হয়, আমাদের যাওয়ার-চাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
এর জন্য বারবার করে বলছি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ, এদের থামান, গুণ্ডা ধরুন। নইলে কিন্তু পাবলিকই এদের একদিন ধরা শুরু করে দেবে।
No comments