স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরে আসার প্রত্যাশা by গোলাম মোহাম্মদ কাদের
সবার
অংশগ্রহণে ২৮ এপ্রিল তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এই নির্বাচন কি ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, নাকি ফের
সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে নিজ নিজ দলীয় অবস্থান
ব্যাখ্যা করেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির তিনজন শীর্ষস্থানীয়
রাজনীতিক। প্রথম আলোয় পর্যায়ক্রমে তাঁদের লেখা প্রকাশিত হবে। আজ ছাপা হলো
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নিবন্ধ
দেশে এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাওয়া বইছে। ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রার্থী যাচাই-বাছাই শেষ, প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থিত একক প্রার্থী মনোনয়নের মাধ্যমে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীও।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন এবং আইনগতভাবে নির্দলীয় হওয়ার কথা। তবে রাজনীতিতে দলীয়করণের সুনামিতে পড়ে অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনও অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় ব্যানারেই হচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দলীয় সমর্থনপুষ্ট একজন করে প্রার্থী মনোনীত করেছে। সেই দলের অন্য প্রত্যাশীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়েছে। অস্বীকৃতি জানালে সেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। দল-সমর্থিত প্রার্থীরা আইনগত কারণে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করতে পারলেও দলীয় নেতাদের ছবি নির্বাচনী প্রচার ফেস্টুনে ব্যবহার করছেন।
উন্নত বিশ্বের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহের তুলনায় আমাদের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর দায়িত্ব কম ও কর্তৃত্ব দুর্বল। তথাপি আমাদের মতো জনবহুল ও সীমিত সুযোগের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করে, ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়া বাঞ্ছনীয় কি না, সে বিষয়ে বিতর্কও অধুনা শোনা যাচ্ছে। এই নির্বাচন নির্দলীয় করার পক্ষে প্রধান যুক্তি, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন। তাঁদের মাধ্যমে ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড গৃহীত ও বাস্তবায়িত হবে। এ ধরনের কার্য সম্পাদনে সার্বিক জনস্বার্থে প্রাধান্য দেওয়া হবে, এ প্রত্যাশা থাকে। এ লক্ষ্যে কারও বা কোনো কিছুর প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করা সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। সুশাসন নিশ্চিত করার স্বার্থে সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে আড়াল বা পৃথক্করণের আবশ্যকতা এ কারণেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়।
সরকারি দলের ব্যক্তিদের সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কার্যনির্বাহী কর্মকাণ্ডে নিয়োগ দেওয়া হলে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তাঁদের নিরপেক্ষতা ও নির্দলীয়ভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করে শপথ নিতে হয়। এ বিধান আমাদের সংবিধানে আছে। যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন চোখে পড়ে না। বরং সরকারি দলের বা দলীয় ব্যক্তিদের স্বার্থে কাজ করার জন্য নির্বাহী বিভাগকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করার রেওয়াজ দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা শুধু সংবিধানবিরোধী নয়, সুশাসন ও আইনের শাসনের পরিপন্থী এবং সে কারণে জনস্বার্থবিরোধী। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে, বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি দৃষ্টে বলা যায়, নির্বাচিত ব্যক্তিরা শপথ ভঙ্গকারী মন্ত্রীদের মতো গণস্বার্থের স্থলে দলীয় ব্যক্তিদের স্বার্থে অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে দলীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নেবেন বা নিতে তাঁদের বাধ্য করা হবে।
সমাজের প্রতিটি স্তরে দলীয়করণের কালো মেঘ বাংলাদেশের মানুষের মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তার নীলাকাশকে ক্রমেই গ্রাস করছে। আশঙ্কা হয়, এভাবে চলতে থাকলে বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতার দাপটে একদিন মানুষের সব ধরনের বিচার-বিবেচনা ও বিবেকপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তদীয় নেতাদের খামখেয়ালিপনার বৃত্তে আটকে ফেলবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতো মোটামুটি সময়মতো মেয়াদান্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচিত মেয়র দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। যেমন চট্টগ্রামের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন মনজুর আলম। তিনি ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ইতিপূর্বে, ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের শাসনকালে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী বিপুল ভোটে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সমস্যা দেখা গেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে। এখানে নির্বাচন সময়মতো হয়নি এবং অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ২৫ এপ্রিল, ২০০২ সালে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই নির্বাচন হয় বিএনপি যখন ক্ষমতায়। তাঁর মেয়াদ শেষে ২০০৭ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা। সে সময় নানা জটিলতার কারণ দেখিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। আইনগত কারণে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব হস্তান্তর সম্ভব না হওয়ায় তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটÿ ক্ষমতায় আসে। যথাশিগগির সম্ভব ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই তখন মানুষের প্রত্যাশা ছিল। বাস্তবে তা হলো না। নানা ধরনের জটিলতার কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে বলা হলো। জনগণ কারণটিকে সরকার সৃষ্ট অজুহাত হিসেবে চিহ্নিত করে। আসল কারণ, নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবির আশঙ্কা। এভাবে তৎকালীন মেয়রের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে থাকল।
বিষয়টি সাধারণভাবে জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে। একপর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই মেয়রকে নির্বাচন ছাড়া অন্যভাবে সরানোর সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২৯ নভেম্বর, ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন আইনে সংশোধনী আনে। সেই মোতাবেক অনির্বাচিত সরকার মনোনীত ব্যক্তির কাছে দায়িত্ব অর্পণের বিধান করা হয়। অবশেষে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ক্ষমতা গ্রহণের সাড়ে নয় বছর ও মেয়াদ শেষের প্রায় সাড়ে চার বছর পর ২৯ নভেম্বর, ২০১১ তারিখ দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
একই সংশোধনীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়। এ বিষয়টিও বিভিন্ন মহলে অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হয়। সে সময়কার পরিস্থিতিতে আওয়ামী-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয় লাভ সহজতর হবে মনে করেই করা হয়েছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। তখন থেকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য দিন-তারিখ নিয়ে আকার-ইঙ্গিতে আভাস দেখা যেতে থাকে। কিন্তু ২৯ নভেম্বর, ২০১১ থেকে আজ অবধি এই দীর্ঘ সময় আমলাদের মাধ্যমেই ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত মার্চ মাসের শেষ পর্যায়ে ওই সিটি করপোরেশনসমূহের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। হঠাৎ করে এমন একটি সময়ে নির্বাচন ঘোষণার কারণ কী হতে পারে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না—এ বিষয়গুলো এখন জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করছে, আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
কারও কারও মতে, উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে কৌশল হিসেবে সরকার এ চাল দিয়েছে। তাঁদের মতে, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের জন্য এটি একটি ফাঁদ। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে আন্দোলনের ইস্যুসমূহ চাপা পড়ে যাবে এবং দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে নির্বাচন ঘোষণার কিছুদিন আগে থেকে এমনিতেই আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল নানা কারণে।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করতে পারবেন না—এ আশঙ্কা থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বারবার বিলম্বিত করা হয়েছে, নির্বাচনী আইন সংস্কার করা হয়েছে, এমনকি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে—এই অভিযোগসমূহকে গ্রহণযোগ্য মনে করলে, যেকোনোভাবেই হোক নির্বাচনে (বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনসমূহের) জয়লাভ করতে হবে, আওয়ামী লীগ এ নীতিতে বিশ্বাসী বলা যায়। সেই পেরিপ্রেক্ষিতে কিছু মানুষের বক্তব্য, চরম আন্দোলনের মধ্যে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করবে এবং আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে—এ ধারণা থেকেই নির্বাচনের ঘোষণা। সেই বিবেচনায় বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলেছে। তাদের ধারণা, এখন অনুগত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সহায়তায় যেনতেন প্রকারে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
এ ধরনের চিন্তাধারা যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হবে দুঃখজনক। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি ও সহিংসতার পুনরাবৃত্তি দেশবাসীর জন্য বয়ে আনতে পারে দুর্ভোগ। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পরাজিত হবে গণতন্ত্র। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করা হবে। অবশ্য অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের জন্য ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের পথ থেকে বেরিয়ে আসার সম্মানজনক বহির্গমনের একটি রাস্তা হতে পারে এ নির্বাচন। সে উদ্দেশ্য নিয়েই সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলনরত দলসমূহ স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। দেশে শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনের পথ উন্মুক্ত হবে।
উদ্দেশ্য যদি এই হয়, তা নিঃসন্দেহে দেশবাসীর জন্য সুখবর। তবে, সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হবে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে বিরোধী মহলে আস্থা সৃষ্টি করা। পরে সুবিধাজনক সময়ে সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমস্যা ও বিরোধ মীমাংসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়াই হবে বাঞ্ছনীয়।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের: সাবেক মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় পার্টি।
দেশে এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হাওয়া বইছে। ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রার্থী যাচাই-বাছাই শেষ, প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থিত একক প্রার্থী মনোনয়নের মাধ্যমে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীও।
সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন এবং আইনগতভাবে নির্দলীয় হওয়ার কথা। তবে রাজনীতিতে দলীয়করণের সুনামিতে পড়ে অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো এ নির্বাচনও অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় ব্যানারেই হচ্ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই দলীয় সমর্থনপুষ্ট একজন করে প্রার্থী মনোনীত করেছে। সেই দলের অন্য প্রত্যাশীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়েছে। অস্বীকৃতি জানালে সেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। দল-সমর্থিত প্রার্থীরা আইনগত কারণে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করতে পারলেও দলীয় নেতাদের ছবি নির্বাচনী প্রচার ফেস্টুনে ব্যবহার করছেন।
উন্নত বিশ্বের এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহের তুলনায় আমাদের স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর দায়িত্ব কম ও কর্তৃত্ব দুর্বল। তথাপি আমাদের মতো জনবহুল ও সীমিত সুযোগের দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করে, ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়া বাঞ্ছনীয় কি না, সে বিষয়ে বিতর্কও অধুনা শোনা যাচ্ছে। এই নির্বাচন নির্দলীয় করার পক্ষে প্রধান যুক্তি, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন। তাঁদের মাধ্যমে ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড গৃহীত ও বাস্তবায়িত হবে। এ ধরনের কার্য সম্পাদনে সার্বিক জনস্বার্থে প্রাধান্য দেওয়া হবে, এ প্রত্যাশা থাকে। এ লক্ষ্যে কারও বা কোনো কিছুর প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করা সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে স্বীকৃত। সুশাসন নিশ্চিত করার স্বার্থে সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে আড়াল বা পৃথক্করণের আবশ্যকতা এ কারণেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়।
সরকারি দলের ব্যক্তিদের সরকারের মন্ত্রী হিসেবে কার্যনির্বাহী কর্মকাণ্ডে নিয়োগ দেওয়া হলে দায়িত্ব গ্রহণের আগে তাঁদের নিরপেক্ষতা ও নির্দলীয়ভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করে শপথ নিতে হয়। এ বিধান আমাদের সংবিধানে আছে। যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন চোখে পড়ে না। বরং সরকারি দলের বা দলীয় ব্যক্তিদের স্বার্থে কাজ করার জন্য নির্বাহী বিভাগকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করার রেওয়াজ দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা শুধু সংবিধানবিরোধী নয়, সুশাসন ও আইনের শাসনের পরিপন্থী এবং সে কারণে জনস্বার্থবিরোধী। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে হলে, বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতি দৃষ্টে বলা যায়, নির্বাচিত ব্যক্তিরা শপথ ভঙ্গকারী মন্ত্রীদের মতো গণস্বার্থের স্থলে দলীয় ব্যক্তিদের স্বার্থে অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী হয়ে দলীয়ভাবে পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নেবেন বা নিতে তাঁদের বাধ্য করা হবে।
সমাজের প্রতিটি স্তরে দলীয়করণের কালো মেঘ বাংলাদেশের মানুষের মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তার নীলাকাশকে ক্রমেই গ্রাস করছে। আশঙ্কা হয়, এভাবে চলতে থাকলে বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতার দাপটে একদিন মানুষের সব ধরনের বিচার-বিবেচনা ও বিবেকপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তদীয় নেতাদের খামখেয়ালিপনার বৃত্তে আটকে ফেলবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য সিটি করপোরেশনের মতো মোটামুটি সময়মতো মেয়াদান্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচিত মেয়র দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। যেমন চট্টগ্রামের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন মনজুর আলম। তিনি ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। ইতিপূর্বে, ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের শাসনকালে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী বিপুল ভোটে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সমস্যা দেখা গেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে। এখানে নির্বাচন সময়মতো হয়নি এবং অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকা। তিনি ২৫ এপ্রিল, ২০০২ সালে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই নির্বাচন হয় বিএনপি যখন ক্ষমতায়। তাঁর মেয়াদ শেষে ২০০৭ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা। সে সময় নানা জটিলতার কারণ দেখিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। আইনগত কারণে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব হস্তান্তর সম্ভব না হওয়ায় তাঁর মেয়াদ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটÿ ক্ষমতায় আসে। যথাশিগগির সম্ভব ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এটাই তখন মানুষের প্রত্যাশা ছিল। বাস্তবে তা হলো না। নানা ধরনের জটিলতার কারণে নির্বাচন বিলম্বিত হচ্ছে বলা হলো। জনগণ কারণটিকে সরকার সৃষ্ট অজুহাত হিসেবে চিহ্নিত করে। আসল কারণ, নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবির আশঙ্কা। এভাবে তৎকালীন মেয়রের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে থাকল।
বিষয়টি সাধারণভাবে জনগণের সমালোচনার মুখে পড়ে। একপর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই মেয়রকে নির্বাচন ছাড়া অন্যভাবে সরানোর সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২৯ নভেম্বর, ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন আইনে সংশোধনী আনে। সেই মোতাবেক অনির্বাচিত সরকার মনোনীত ব্যক্তির কাছে দায়িত্ব অর্পণের বিধান করা হয়। অবশেষে ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ক্ষমতা গ্রহণের সাড়ে নয় বছর ও মেয়াদ শেষের প্রায় সাড়ে চার বছর পর ২৯ নভেম্বর, ২০১১ তারিখ দায়িত্ব ছেড়ে দেন।
একই সংশোধনীতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ নামে দুটি সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়। এ বিষয়টিও বিভিন্ন মহলে অপ্রয়োজনীয় বলে গণ্য হয়। সে সময়কার পরিস্থিতিতে আওয়ামী-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয় লাভ সহজতর হবে মনে করেই করা হয়েছে বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেন। তখন থেকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য দিন-তারিখ নিয়ে আকার-ইঙ্গিতে আভাস দেখা যেতে থাকে। কিন্তু ২৯ নভেম্বর, ২০১১ থেকে আজ অবধি এই দীর্ঘ সময় আমলাদের মাধ্যমেই ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী সহিংসতা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত মার্চ মাসের শেষ পর্যায়ে ওই সিটি করপোরেশনসমূহের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। হঠাৎ করে এমন একটি সময়ে নির্বাচন ঘোষণার কারণ কী হতে পারে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না—এ বিষয়গুলো এখন জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করছে, আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
কারও কারও মতে, উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঠান্ডা করার উদ্দেশ্যে কৌশল হিসেবে সরকার এ চাল দিয়েছে। তাঁদের মতে, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের জন্য এটি একটি ফাঁদ। তারা নির্বাচনে অংশ নিলে আন্দোলনের ইস্যুসমূহ চাপা পড়ে যাবে এবং দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে নির্বাচন ঘোষণার কিছুদিন আগে থেকে এমনিতেই আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল নানা কারণে।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করতে পারবেন না—এ আশঙ্কা থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বারবার বিলম্বিত করা হয়েছে, নির্বাচনী আইন সংস্কার করা হয়েছে, এমনকি ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে—এই অভিযোগসমূহকে গ্রহণযোগ্য মনে করলে, যেকোনোভাবেই হোক নির্বাচনে (বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনসমূহের) জয়লাভ করতে হবে, আওয়ামী লীগ এ নীতিতে বিশ্বাসী বলা যায়। সেই পেরিপ্রেক্ষিতে কিছু মানুষের বক্তব্য, চরম আন্দোলনের মধ্যে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করবে এবং আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে—এ ধারণা থেকেই নির্বাচনের ঘোষণা। সেই বিবেচনায় বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগকে বিপাকে ফেলেছে। তাদের ধারণা, এখন অনুগত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের সহায়তায় যেনতেন প্রকারে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
এ ধরনের চিন্তাধারা যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তা হবে দুঃখজনক। এতে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি ও সহিংসতার পুনরাবৃত্তি দেশবাসীর জন্য বয়ে আনতে পারে দুর্ভোগ। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও পরাজিত হবে গণতন্ত্র। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত করা হবে। অবশ্য অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের জন্য ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের পথ থেকে বেরিয়ে আসার সম্মানজনক বহির্গমনের একটি রাস্তা হতে পারে এ নির্বাচন। সে উদ্দেশ্য নিয়েই সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আন্দোলনরত দলসমূহ স্বাভাবিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। দেশে শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনের পথ উন্মুক্ত হবে।
উদ্দেশ্য যদি এই হয়, তা নিঃসন্দেহে দেশবাসীর জন্য সুখবর। তবে, সে ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হবে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করে বিরোধী মহলে আস্থা সৃষ্টি করা। পরে সুবিধাজনক সময়ে সমঝোতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমস্যা ও বিরোধ মীমাংসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়াই হবে বাঞ্ছনীয়।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের: সাবেক মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য জাতীয় পার্টি।
No comments