একটি স্বীকারোক্তি এবং রাষ্ট্রের দায় by কাবেরী গায়েন
বিজ্ঞানলেখক
অভিজিৎ রায় হত্যার এক মাস পার না হতেই নির্মমভাবে খুন হলেন ব্লগার
ওয়াশিকুর রহমান। গত ৩০ মার্চ ওয়াশিকুর রহমান তাঁর বেগুনবাড়ীর বাসা থেকে
অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলে বাসার সামনেই তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা
করা হয়। এর আগে একই কায়দায় হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার,
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী; চাপাতির কোপে বিক্ষত হয়েছেন লেখক হুমায়ুন
আজাদ, ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিন, আঘাতের চেষ্টা হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের
ওপর। এসব হত্যাকাণ্ড ও হত্যাচেষ্টার বিচার হয়নি।
তবে অতীতের ঘটনাগুলোর সঙ্গে এবার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যে তিনজন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে দুজনকে এলাকার মানুষ—যাঁদের দুজন তৃতীয় লিঙ্গের—হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন রক্তমাখা চাপাতিসহ ঘটনাস্থল থেকে। এরা দুজন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ ও মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। অপরজনের নাম জানা গেছে আবু তাহের, যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি ছাপা হয়েছে সব গণমাধ্যমে। তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ীই ‘বড় ভাই’ ‘নির্দেশনা দানকারী হুজুরের’ বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। এই স্বীকারোক্তি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যেমন চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে, একই সঙ্গে কতগুলো বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রকে।
এক. স্বীকারোক্তি
‘ব্লগ কী বুঝি না, তার লেখাও আমরা দেখিনি, হুজুরের পরামর্শ, সে ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। আর সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতে ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।’ (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ৩০ মার্চ ২০১৫)—এমনই সহজ স্বীকারোক্তি জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের। তারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে ‘সওয়াব হবে’, ‘বেহেশত নিশ্চিত’ বলে জানিয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৩১ মার্চ ২০১৫)। এমনকি ‘গুলির চেয়ে চাপাতির কোপে মারলে সওয়াব বেশি’ বলেও জানিয়েছে।
দুই. নির্দেশনা দানকারী হুজুর
কে এই হুজুর, যে নির্দেশ দিয়েছে বলেই সুদূর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে চলে এসেছে জিকরুল্লাহ? আরিফুল ও জিকরুল্লাহর জবানবন্দি অনুযায়ী, ‘বড় ভাই’, ‘নির্দেশনা দানকারী’, ‘হুজুর’ বা মাসউলকে (মাসউল কোনো ব্যক্তি নয়, তত্ত্বাবধায়ক) তারা শুধু নামে চেনে, হত্যাকাণ্ডের আগে ঢাকায় কয়েকবার তার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং ‘প্রটেক্ট’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রাখত। মাসউল তাদের দুজনকে চিনিয়েছে ওয়াশিকুরের বাসা, দিয়েছে হত্যাকাণ্ডের ট্রেনিং ও ওয়াশিকুরের ছবি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, যা এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে এসেছে সে অনুযায়ী, মাসউলকে নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম নেতা রেদোয়ানুল আজাদ রানা বলে ধারণা করা হচ্ছে (নয়া দিগন্ত, ২ এপ্রিল ২০১৫) এবং এরা সবাই এই টিমের স্লিপার সেল-এর সদস্য। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল কেউই পরস্পরকে চিনত না, চিনত না পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়া তাহেরকে, এমনকি ‘নির্দেশনা দানকারী’ মাসউলকেও। অর্থাৎ, স্তরবিন্যস্ত এই নেটওয়ার্কে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল অন্ধভাবে নির্দেশ পালনকারী মাত্র (যুগান্তর, ৫ এপ্রিল ২০১৫)। এর আগেও তারা জেএমবি-সংশ্লিষ্টতার কারণে ধরা পড়েছে।
কথিত মাসউলের খোঁজ পাওয়াটা জরুরি। তাহলে হয়তো জানা যাবে সেই-ই মূল হোতা, নাকি সেও আসলে পালন করেছে অন্য কারও নির্দেশ। সে নিজেই কি জানে ব্লগ কী, নাকি সেও শুনেছে অন্য কারও কাছে। কী তার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয়? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি এ জন্যও যে হয়তো দেখা যাবে, যারা ওয়াশিকুরের বিষয়ে খবর দিয়েছে, তারা আমাদের সঙ্গেই ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে সংযুক্ত।
তিন. রাষ্ট্রের দায়
আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রায় এক কোটির মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। কিছু ঝাঁ-চকচকে ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসা বাদ দিলে এসব মাদ্রাসা দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্যই বানানো। তাদের সিলেবাস মূলত বিশ্বাসনির্ভর। বিশ্বাস ও মান্যতা যেমন অধীত সিলেবাসে, তেমনি ‘হুজুর’দের প্রতিও। এই মান্যতার স্বরূপটি আমরা দেখেছি ৫ মে ২০১৩ সালে। হুজুরের নির্দেশমতো যেমন তারা এসেছিল শাপলা চত্বরে, তেমনি হুজুরের নির্দেশ অনুযায়ী বেরিয়েও গিয়েছিল।
এই মান্যতার কারণ আছে। খাওয়া-পরা-শিক্ষা-সামাজিক মর্যাদা যতটুকুই তারা পায়, সে তো এই মাদ্রাসার কারণেই, রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব নেয়নি। রয়েছে পরকালে বেহেশত লাভের নিশ্চয়তামূলক সরল পাঠ। সমস্যার জায়গা হলো, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নানা জঙ্গি নেটওয়ার্কের অর্থে রাজনৈতিক ইসলাম কায়েমের জন্য কোনো কোনো মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর এই সরল বিশ্বাসকে এমনভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব হয় যে তাদের পক্ষে ধর্মের জন্য জীবন দেওয়া ও ধর্মের ‘বিরোধিতাকারী’দের জীবন নেওয়া দুই-ই অশেষ পুণ্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন বলেছে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল যে তারা তাদের ‘ইমানি দায়িত্ব’ পালন করেছে এবং তাদের ‘সওয়াব’ ও ‘বেহেশত’ লাভ হবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষা-কাঠামোর কোনো অংশেই এমন প্রশ্নহীন বিশ্বাস তৈরির ব্যবস্থা এত বিপুল আয়তনে চালু রাখার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবার সময় বোধ হয় হয়েছে রাষ্ট্রের। অথচ বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, তিরাশির শিক্ষা আন্দোলন, এমনকি ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা দাবিতেও বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার দাবি ছিল।
রাষ্ট্র জানে যে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে কীভাবে নারী নেতৃত্ব, ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ ছোট–বড় নানা দল গজিয়েছে, যারা ফেসবুকে তালিকা দিয়ে দিচ্ছে খুন করার, খুন করার পরে তারা ফেসবুকে তাদের জয়োল্লাস প্রকাশ করছে। হত্যা করার জন্য ৮৪ জন লেখক ও ব্লগারের তালিকা থেকে ইতিমধ্যে আটজনকে খুন করতে এসব উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী সক্ষম হয়েছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা-পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে বলতেই হয়। কারণ, এখন পর্যন্ত কাউকে তারা দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। অভিজিৎ হত্যার সময় কাছেই থাকা পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছেন তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ।
এমন সব ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ট্রেনিংয়ের বিপরীতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত প্রমাণিত, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েও ভাবা দরকার।
ভয়াবহ আরেকটি বিষয় দেখি, কোনো খুনের পরে খুনির পক্ষে সাফাই গাওয়ার মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব খুন ও খুনের সাফাইয়ের বিপরীতে ধর্মীয় নেতারা কি এগিয়ে আসবেন না? তাঁরা কি বলবেন না, এসব হত্যাকাণ্ড পবিত্র ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না, যারা এসব করছে তারা খুনি? প্রতিরোধ কি করবেন না মানবতাবাদী সব মানুষ যে ‘লেখার প্রতিবাদ হোক লেখনী দিয়ে, চাপাতি কোনো পথ হতে পারে না’।
যে কাউকে হত্যা করে তার নামের সঙ্গে ব্লগার শব্দটি জুড়ে দিতে পারলেই তাকে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেটি ভয়াবহ। আর এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন ওয়াশিকুর রহমানের বোন আফসারী সুলতানা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, ‘মানুষের মনে তো কত কথাই আসে...সে যদি খারাপ কিছু লেখেও, তার বিচার বিধাতা করবেন। আল্লাহ আছেন। পৃথিবীতে ওরা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কে?’ ধর্ম, যুক্তি ও মানবতা যাই-ই বলি, এর ওপরে কথা চলে না। তিনি তাঁর ভাইয়ের খুনিদের ফাঁসির দাবি করেছেন যেন ‘তারা ভবিষ্যতে এমন করতে না পারে’। আমার ধারণা, এই দাবি এ দেশের শান্তিকামী সব মানুষের।
হাতেনাতে ধরে ফেলায় খুনিদের নেটওয়ার্ক বের করা এখন সরকারি সদিচ্ছার ব্যাপার। সরকার হুকুম দানকারী, হত্যাকাণ্ড পরিচালনাকারী, ব্লগ ঘেঁটে ব্লগারদের পরিচিতিকারী, খুনিদের সমন্বয়কারী, অর্থাৎ নেটওয়ার্কের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের খুঁজে বের করে প্রাপ্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সেই আশা করি। অনুরোধ করি তৃতীয় লিঙ্গের যে দুজন মানুষ এই খুনিদের ধরেছেন, তাঁদেরসহ প্রান্তিক এই কমিউনিটির নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখার।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি যে বহু ধর্মের, বহু জাতিসত্তার, বহু মতের মানুষের—সেই বিষয়টি শিশুশিক্ষার ভেতরেই যেন প্রোথিত করা যায়, চেষ্টাটি সেখানেও থাকা চাই। রাষ্ট্রের দায়টিও সেখানেই। নয়তো হেরে যাবে বাংলাদেশ।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে অতীতের ঘটনাগুলোর সঙ্গে এবার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যে তিনজন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের মধ্যে দুজনকে এলাকার মানুষ—যাঁদের দুজন তৃতীয় লিঙ্গের—হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন রক্তমাখা চাপাতিসহ ঘটনাস্থল থেকে। এরা দুজন হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র জিকরুল্লাহ ও মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আরিফুল ইসলাম। অপরজনের নাম জানা গেছে আবু তাহের, যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের স্বীকারোক্তি ছাপা হয়েছে সব গণমাধ্যমে। তাদের সাক্ষ্য অনুযায়ীই ‘বড় ভাই’ ‘নির্দেশনা দানকারী হুজুরের’ বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। এই স্বীকারোক্তি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যেমন চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে, একই সঙ্গে কতগুলো বাস্তব সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রকে।
এক. স্বীকারোক্তি
‘ব্লগ কী বুঝি না, তার লেখাও আমরা দেখিনি, হুজুরের পরামর্শ, সে ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। আর সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতে ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।’ (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ৩০ মার্চ ২০১৫)—এমনই সহজ স্বীকারোক্তি জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলামের। তারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে ‘সওয়াব হবে’, ‘বেহেশত নিশ্চিত’ বলে জানিয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৩১ মার্চ ২০১৫)। এমনকি ‘গুলির চেয়ে চাপাতির কোপে মারলে সওয়াব বেশি’ বলেও জানিয়েছে।
দুই. নির্দেশনা দানকারী হুজুর
কে এই হুজুর, যে নির্দেশ দিয়েছে বলেই সুদূর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে চলে এসেছে জিকরুল্লাহ? আরিফুল ও জিকরুল্লাহর জবানবন্দি অনুযায়ী, ‘বড় ভাই’, ‘নির্দেশনা দানকারী’, ‘হুজুর’ বা মাসউলকে (মাসউল কোনো ব্যক্তি নয়, তত্ত্বাবধায়ক) তারা শুধু নামে চেনে, হত্যাকাণ্ডের আগে ঢাকায় কয়েকবার তার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে এবং ‘প্রটেক্ট’ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রাখত। মাসউল তাদের দুজনকে চিনিয়েছে ওয়াশিকুরের বাসা, দিয়েছে হত্যাকাণ্ডের ট্রেনিং ও ওয়াশিকুরের ছবি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, যা এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে এসেছে সে অনুযায়ী, মাসউলকে নিষিদ্ধঘোষিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অন্যতম নেতা রেদোয়ানুল আজাদ রানা বলে ধারণা করা হচ্ছে (নয়া দিগন্ত, ২ এপ্রিল ২০১৫) এবং এরা সবাই এই টিমের স্লিপার সেল-এর সদস্য। জিকরুল্লাহ ও আরিফুল কেউই পরস্পরকে চিনত না, চিনত না পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়া তাহেরকে, এমনকি ‘নির্দেশনা দানকারী’ মাসউলকেও। অর্থাৎ, স্তরবিন্যস্ত এই নেটওয়ার্কে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল অন্ধভাবে নির্দেশ পালনকারী মাত্র (যুগান্তর, ৫ এপ্রিল ২০১৫)। এর আগেও তারা জেএমবি-সংশ্লিষ্টতার কারণে ধরা পড়েছে।
কথিত মাসউলের খোঁজ পাওয়াটা জরুরি। তাহলে হয়তো জানা যাবে সেই-ই মূল হোতা, নাকি সেও আসলে পালন করেছে অন্য কারও নির্দেশ। সে নিজেই কি জানে ব্লগ কী, নাকি সেও শুনেছে অন্য কারও কাছে। কী তার রাজনৈতিক-সামাজিক পরিচয়? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি এ জন্যও যে হয়তো দেখা যাবে, যারা ওয়াশিকুরের বিষয়ে খবর দিয়েছে, তারা আমাদের সঙ্গেই ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে সংযুক্ত।
তিন. রাষ্ট্রের দায়
আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রায় এক কোটির মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। কিছু ঝাঁ-চকচকে ইংরেজি মাধ্যম মাদ্রাসা বাদ দিলে এসব মাদ্রাসা দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্যই বানানো। তাদের সিলেবাস মূলত বিশ্বাসনির্ভর। বিশ্বাস ও মান্যতা যেমন অধীত সিলেবাসে, তেমনি ‘হুজুর’দের প্রতিও। এই মান্যতার স্বরূপটি আমরা দেখেছি ৫ মে ২০১৩ সালে। হুজুরের নির্দেশমতো যেমন তারা এসেছিল শাপলা চত্বরে, তেমনি হুজুরের নির্দেশ অনুযায়ী বেরিয়েও গিয়েছিল।
এই মান্যতার কারণ আছে। খাওয়া-পরা-শিক্ষা-সামাজিক মর্যাদা যতটুকুই তারা পায়, সে তো এই মাদ্রাসার কারণেই, রাষ্ট্র তাদের দায়িত্ব নেয়নি। রয়েছে পরকালে বেহেশত লাভের নিশ্চয়তামূলক সরল পাঠ। সমস্যার জায়গা হলো, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নানা জঙ্গি নেটওয়ার্কের অর্থে রাজনৈতিক ইসলাম কায়েমের জন্য কোনো কোনো মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর এই সরল বিশ্বাসকে এমনভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব হয় যে তাদের পক্ষে ধর্মের জন্য জীবন দেওয়া ও ধর্মের ‘বিরোধিতাকারী’দের জীবন নেওয়া দুই-ই অশেষ পুণ্যের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন বলেছে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল যে তারা তাদের ‘ইমানি দায়িত্ব’ পালন করেছে এবং তাদের ‘সওয়াব’ ও ‘বেহেশত’ লাভ হবে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষা-কাঠামোর কোনো অংশেই এমন প্রশ্নহীন বিশ্বাস তৈরির ব্যবস্থা এত বিপুল আয়তনে চালু রাখার ব্যাপারটি নিয়ে ভাবার সময় বোধ হয় হয়েছে রাষ্ট্রের। অথচ বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, তিরাশির শিক্ষা আন্দোলন, এমনকি ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা দাবিতেও বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার দাবি ছিল।
রাষ্ট্র জানে যে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে কীভাবে নারী নেতৃত্ব, ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ ছোট–বড় নানা দল গজিয়েছে, যারা ফেসবুকে তালিকা দিয়ে দিচ্ছে খুন করার, খুন করার পরে তারা ফেসবুকে তাদের জয়োল্লাস প্রকাশ করছে। হত্যা করার জন্য ৮৪ জন লেখক ও ব্লগারের তালিকা থেকে ইতিমধ্যে আটজনকে খুন করতে এসব উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী সক্ষম হয়েছে।
এসব হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা-পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে বলতেই হয়। কারণ, এখন পর্যন্ত কাউকে তারা দোষী সাব্যস্ত করতে পারেনি। অভিজিৎ হত্যার সময় কাছেই থাকা পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছেন তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ।
এমন সব ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে, এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ট্রেনিংয়ের বিপরীতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত প্রমাণিত, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েও ভাবা দরকার।
ভয়াবহ আরেকটি বিষয় দেখি, কোনো খুনের পরে খুনির পক্ষে সাফাই গাওয়ার মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। এসব খুন ও খুনের সাফাইয়ের বিপরীতে ধর্মীয় নেতারা কি এগিয়ে আসবেন না? তাঁরা কি বলবেন না, এসব হত্যাকাণ্ড পবিত্র ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না, যারা এসব করছে তারা খুনি? প্রতিরোধ কি করবেন না মানবতাবাদী সব মানুষ যে ‘লেখার প্রতিবাদ হোক লেখনী দিয়ে, চাপাতি কোনো পথ হতে পারে না’।
যে কাউকে হত্যা করে তার নামের সঙ্গে ব্লগার শব্দটি জুড়ে দিতে পারলেই তাকে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেটি ভয়াবহ। আর এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন ওয়াশিকুর রহমানের বোন আফসারী সুলতানা বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, ‘মানুষের মনে তো কত কথাই আসে...সে যদি খারাপ কিছু লেখেও, তার বিচার বিধাতা করবেন। আল্লাহ আছেন। পৃথিবীতে ওরা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কে?’ ধর্ম, যুক্তি ও মানবতা যাই-ই বলি, এর ওপরে কথা চলে না। তিনি তাঁর ভাইয়ের খুনিদের ফাঁসির দাবি করেছেন যেন ‘তারা ভবিষ্যতে এমন করতে না পারে’। আমার ধারণা, এই দাবি এ দেশের শান্তিকামী সব মানুষের।
হাতেনাতে ধরে ফেলায় খুনিদের নেটওয়ার্ক বের করা এখন সরকারি সদিচ্ছার ব্যাপার। সরকার হুকুম দানকারী, হত্যাকাণ্ড পরিচালনাকারী, ব্লগ ঘেঁটে ব্লগারদের পরিচিতিকারী, খুনিদের সমন্বয়কারী, অর্থাৎ নেটওয়ার্কের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের খুঁজে বের করে প্রাপ্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সেই আশা করি। অনুরোধ করি তৃতীয় লিঙ্গের যে দুজন মানুষ এই খুনিদের ধরেছেন, তাঁদেরসহ প্রান্তিক এই কমিউনিটির নিরাপত্তার দিকটি খেয়াল রাখার।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি যে বহু ধর্মের, বহু জাতিসত্তার, বহু মতের মানুষের—সেই বিষয়টি শিশুশিক্ষার ভেতরেই যেন প্রোথিত করা যায়, চেষ্টাটি সেখানেও থাকা চাই। রাষ্ট্রের দায়টিও সেখানেই। নয়তো হেরে যাবে বাংলাদেশ।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments