সিটি নির্বাচন কি একটা ধূম্রজাল? by মশিউল আলম
বিএনপিপন্থী
শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, সিটি
করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ খুলে যাবে;
স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। সংবাদমাধ্যমের লেখালেখি খেয়াল
করলে এখন এ রকম একটা আশাবাদের দেখা পাওয়া যায়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা
জিয়ার বাসায় ফিরে যাওয়া, রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হওয়া এবং তিনটি সিটি
করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে আশাবাদী মানুষেরা স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলছেন। তাঁরা এমন আশা করছেন যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে
স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরে আসবে।
কিন্তু এই আশাবাদের পক্ষে কোনো সায় পাচ্ছেন না নিউ ইস্কাটনের মুদি দোকানদার জসিম মিয়া। তিনি মনে করেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটা নিতান্তই সাময়িক উদ্দীপনার বিষয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই উত্তেজনা মিলিয়ে যাবে এবং জাতীয় রাজনীতির গভীর সংকট যথারীতি ফিরে আসবে।
জসিম মিয়ার সঙ্গে আলাপ করে তাঁর যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির আভাস পেয়েছি, সে প্রসঙ্গে একটু পরে ফিরে আসছি। তার আগে আরও তিনজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপের কিছু বিষয় তুলে ধরা যাক।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে চৈত্রের খররোদে পুড়তে পুড়তে, ঘামতে ঘামতে আখের রস বিক্রি করছিলেন মাদারীপুরের যুবক মোহাম্মদ দুলাল মিয়া, যিনি প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা কিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, দেশের অবস্থা এখন তাঁর কাছে কেমন বলে মনে হচ্ছে। একগাল হেসে তিনি বললেন, ‘ভালোই তো দেখা যায়। পেট্রলবোমা থামছে। অবরোধ-টবরোধ আর নাই, খালেদা জিয়া পারে নাই, ব্যর্থ হইছে।’
‘কেন এ কথা বলছেন? খালেদা জিয়া কীভাবে ব্যর্থ হলেন?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল মিয়া বললেন, ‘উনার আন্দোলন ব্যর্থ হইছে। উনি মানুষ মারছে, সেই জন্য পাবলিক উনারে সাপোর্ট দেয় নাই। মানুষ মাইরা আর কত দিন আন্দোলন চালাইব? তাই এখন থামছে, না থাইমা উপায় ছিল না।’
আমি জানতে চাইলাম, খালেদা জিয়া কী উপায়ে আন্দোলন করলে সফল হতেন? দুলাল মিয়া বললেন, ‘জনগণরে সঙ্গে নিয়া আন্দোলন করতে হয়, মানুষ মাইরা আন্দোলন হয় না। মানুষ মারলে জনগণ সাপোর্ট দেয় না। খালেদা জিয়া যদি হাজার হাজার মানুষ নিয়া রাস্তায় নামতে পারত, তাইলে দেশের মানুষ দেখতে পাইত ওনার পিছে কত লোক আছে। কিন্তু উনি সেটা করতে পারে নাই। টোকাই ভাড়া কইরা পেট্রলবোমা দিয়া মানুষ মারছে। তাই উনি ব্যর্থ হইছে। ব্যর্থ হইয়া আস্তে কইরা বাসায় ফিরা গেছে গিয়া।’
আমি বললাম, ‘সরকার তো তাঁকে ও তাঁর দলের লোকজনকে রাস্তায় নামতে দেয়নি। তাহলে তাঁদের আর কী করার ছিল?’
দুলাল মিয়ার উত্তর: ‘লাখ লাখ লোক নিয়া যদি খালেদা জিয়া রাস্তায় নামত, তাইলে সরকারের বাপেরও ক্ষমতা ছিল না বাধা দেয়। উনি আসলে পারে নাই, পুরাই ব্যর্থ হইছে, এখন আপস কইরা আদালত থিকা জামিন নিয়া বাসায় ফিরা গেছে গিয়া।’
কিন্তু নড়াইল থেকে আসা সবজিবিক্রেতা শফিকুর রহমান মুরাদ মনে করেন না খালেদা জিয়া ব্যর্থ হয়েছেন। মুরাদের বিচারে তিনি
তাঁর অবস্থানে অটলই আছেন; ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড় দিছে, তাই দেশে শান্তি ফিরে আসছে,’ বললেন মুরাদ, যিনি একজন গ্র্যাজুয়েট এবং নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন ও টিভি দেখেন। নিউ ইস্কাটনে নূর মসজিদের এক কোণে রাস্তার পাশে তাঁর সবজির দোকান। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার কী ধারণা, প্রধানমন্ত্রী কেন এত দিন পরে হঠাৎ খালেদা জিয়াকে “ছাড়” দিলেন?’
‘কারণ, প্রধানমন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হইছে,’ বললেন মুরাদ, ‘উনি বুঝতে পারছেন, এইভাবে আর চলতে পারে না। উনি পুলিশ বাহিনীকে বিএনপির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করছেন, সেটা এরশাদের আমলেও আমরা দেখি নাই। প্রধানমন্ত্রী এখন বুঝতে পারছেন, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এত বাড়াবাড়ি তো ভালো না। দেশের সব মানুষ মনে মনে বিরুদ্ধে চলে গেলে শুধু স্বৈরাচারী পন্থায় তো বেশি দিন চালানো যাবে না। আর একটা কথা হলো, তাঁর ওপর বিদেশিদের চাপ আছে। সব দিক মিলায়া তাঁকে ছাড় দিতে হইছে।’
‘এই ছাড় দেওয়াটা কি ভালো হয়েছে?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মুরাদ বললেন, ‘অবশ্যই, হানড্রেড পারসেন্ট ভালো হইছে। এখন দেশের ভালো হবে। শান্তি ফিরে আসবে। এই যে সিটি নির্বাচন হইতে যাইতাছে, এর ফলে আরও ভালো হবে, মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে হ্যাঁ, এখানে একটা কথা আছে, সিটি নির্বাচন কিন্তু সুষ্ঠু হইতে হবে, নিরপেক্ষ হইতে হবে। কারচুপি হইলে বা বিএনপির প্রার্থীদের জোর করে হারানো হলে কিন্তু আবার অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।’
আর অশান্তি চান না ৫২ বছর বয়সী মোহাম্মদ কাল্লু মিয়া। কারণ, দেশজুড়ে গত তিন মাসের অশান্তিতে তাঁর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, প্রায়-অচল হতে বসেছে জীবন-জীবিকা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শান্তি-অশান্তির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল তাঁর জীবিকা। তিনি বাস করেন বাংলামোটরের উত্তর পাশের এক ঘিঞ্জি গলির ভেতরে। লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি, কিন্তু কাজ চালানোর মতো ভাষা শিখে নিয়েছেন প্রায় ডজন খানেক। প্রতিদিন সকালে তিনি এসে দাঁড়ান সোনারগাঁও হোটেলের গেটে। হোটেল থেকে পর্যটকেরা যখন বেরিয়ে আসেন, তখন তিনি নিজেকে একজন ‘ইন্টারপ্রেটার’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, জানতে চান তাঁর সাহায্য তাঁদের দরকার কি না। তিনি তাঁদের নিয়ে যেতে পারেন কোনো বিপণিকেন্দ্রে, জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল বা অন্য কোনো দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানে। পর্যটকদের কেউ কেউ তাঁকে সঙ্গে নেন। দিন শেষে তাঁকে ৫০০ বা এক হাজার টাকা দেন। কোনো কোনো হৃদয়বান দেন আরও বেশি। কিন্তু প্রতিদিন তিনি এই কাজ পান না। আমার সঙ্গে দেখা হলেই মলিন মুখে বলেন, ‘স্যার, হোটেলে গেস্ট কম, আমার রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ হইয়া গেছে। দেশের অবস্থা কি ভালো হইব না?’
সেদিন জসিম মিয়ার মুদি দোকানের সামনে কাল্লু মিয়ার সঙ্গে দেখা। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, দেশের অবস্থা তো ভালো, খালেদা জিয়া বাসায় ফিরা গেছে। এখন দেশে শান্তি হইব। বেশি বেশি বিদেশি গেস্ট আইব।’
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জসিম মিয়া বললেন, ‘দ্যাশের অবস্থা ভালো এইডা তোরে কে কইছে, কাল্লু? তুই রাজনীতি কিছু বোজছ?’
কাল্লু মিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান, খানিক অপমানও বোধ করেন সম্ভবত। তিনি জসিম মিয়াকে বলেন, ‘ক্যান? পেট্রলবোমা বন্ধ হয় নাই? সিটির ইলেকশান হইতেছে না? অখন কুনোখানে মারামারি হইতাছে? ’
জসিম মিয়া কাল্লুকে পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলেন, ‘শান্তি দেখতাছেন, এইটা সিটি ইলেকশান বইল্যা। কিন্তু সিটি ইলেকশান দিয়া আসল সমস্যারে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হইতাছে। কিন্তু লাভ নাই। সামনে আরও খারাপ দিন আইতাছে।’
আমি জসিম মিয়ার কাছে তাঁর এই আশঙ্কার ব্যাখ্যা চাইলাম। তিনি বললেন, ‘প্রথম খারাপ কথা হইল, সিটি ইলেকশানে আওয়ামী লীগ সবগুলা মেয়র পদে জিতবার চায়। হেগো মন্ত্রী কইয়া দিছে, যেকোনো প্রকারে হোক জিততেই হইব। হেরা জোর কইরা ব্যাকটি জিত্যা নিলে বিএনপি কি বইয়া থাকব? গন্ডগোল শুরু হইব না? সিটি ইলেকশানের পরেই দেইখেন, কী শুরু হইয়া যায়।’
আমি বললাম, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপি করা বা জবরদস্তি খাটানো সম্ভব হবে না। এই সরকারের অধীনেই এর আগে পাঁচটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতিটাতেই বিএনপির প্রার্থীরা জিতেছেন। জসিম মিয়া বললেন, ‘ভালো কথা, এইবারও যদি ঠিকঠাক মতন ইলেকশান হয়, বিএনপির অন্তত দুইজন প্রার্থী মেয়র হইব। আচ্ছা হইল, সিটি ইলেকশানের ব্যাপার শ্যাষ হইল, কিন্তু তার পরে কী? দ্যাশ কি এইভাবেই চলব? সরকার যে কইয়া দিছে, উনিশ সালের আগে সংসদ নির্বাচন নাই, তো এই কয় বছর বিএনপি কী করব? বইয়া বইয়া হুক্কা খাইব? জে না, হেরা আবার আন্দোলন শুরু করব, এইবার আরও জোরেশোরে! আর সরকারও বইয়া থাকব না। তার মানে দুই পক্ষে মিল্যা যা শুরু করব, দ্যাশের এক্করে বারোটা বাইজ্জ্যা যাইব।’
যাঁরা দুই বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষের সাময়িক নমনীয়তা দেখে স্থিতিশীল ও শান্তিময় রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধছেন, তাঁদের মনে হতে পারে জসিম মিয়া অতিরিক্ত হতাশাবাদী লোক। কিন্তু তাঁর শঙ্কাটা সত্যিই বিবেচনার যোগ্য। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন কখন, কী পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ না মেটা পর্যন্ত প্রকৃত রাজনৈতিক সংকট থেকেই যাবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
কিন্তু এই আশাবাদের পক্ষে কোনো সায় পাচ্ছেন না নিউ ইস্কাটনের মুদি দোকানদার জসিম মিয়া। তিনি মনে করেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটা নিতান্তই সাময়িক উদ্দীপনার বিষয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই উত্তেজনা মিলিয়ে যাবে এবং জাতীয় রাজনীতির গভীর সংকট যথারীতি ফিরে আসবে।
জসিম মিয়ার সঙ্গে আলাপ করে তাঁর যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির আভাস পেয়েছি, সে প্রসঙ্গে একটু পরে ফিরে আসছি। তার আগে আরও তিনজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপের কিছু বিষয় তুলে ধরা যাক।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে চৈত্রের খররোদে পুড়তে পুড়তে, ঘামতে ঘামতে আখের রস বিক্রি করছিলেন মাদারীপুরের যুবক মোহাম্মদ দুলাল মিয়া, যিনি প্রতিদিন পাঁচ টাকা দিয়ে একটি দৈনিক পত্রিকা কিনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, দেশের অবস্থা এখন তাঁর কাছে কেমন বলে মনে হচ্ছে। একগাল হেসে তিনি বললেন, ‘ভালোই তো দেখা যায়। পেট্রলবোমা থামছে। অবরোধ-টবরোধ আর নাই, খালেদা জিয়া পারে নাই, ব্যর্থ হইছে।’
‘কেন এ কথা বলছেন? খালেদা জিয়া কীভাবে ব্যর্থ হলেন?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল মিয়া বললেন, ‘উনার আন্দোলন ব্যর্থ হইছে। উনি মানুষ মারছে, সেই জন্য পাবলিক উনারে সাপোর্ট দেয় নাই। মানুষ মাইরা আর কত দিন আন্দোলন চালাইব? তাই এখন থামছে, না থাইমা উপায় ছিল না।’
আমি জানতে চাইলাম, খালেদা জিয়া কী উপায়ে আন্দোলন করলে সফল হতেন? দুলাল মিয়া বললেন, ‘জনগণরে সঙ্গে নিয়া আন্দোলন করতে হয়, মানুষ মাইরা আন্দোলন হয় না। মানুষ মারলে জনগণ সাপোর্ট দেয় না। খালেদা জিয়া যদি হাজার হাজার মানুষ নিয়া রাস্তায় নামতে পারত, তাইলে দেশের মানুষ দেখতে পাইত ওনার পিছে কত লোক আছে। কিন্তু উনি সেটা করতে পারে নাই। টোকাই ভাড়া কইরা পেট্রলবোমা দিয়া মানুষ মারছে। তাই উনি ব্যর্থ হইছে। ব্যর্থ হইয়া আস্তে কইরা বাসায় ফিরা গেছে গিয়া।’
আমি বললাম, ‘সরকার তো তাঁকে ও তাঁর দলের লোকজনকে রাস্তায় নামতে দেয়নি। তাহলে তাঁদের আর কী করার ছিল?’
দুলাল মিয়ার উত্তর: ‘লাখ লাখ লোক নিয়া যদি খালেদা জিয়া রাস্তায় নামত, তাইলে সরকারের বাপেরও ক্ষমতা ছিল না বাধা দেয়। উনি আসলে পারে নাই, পুরাই ব্যর্থ হইছে, এখন আপস কইরা আদালত থিকা জামিন নিয়া বাসায় ফিরা গেছে গিয়া।’
কিন্তু নড়াইল থেকে আসা সবজিবিক্রেতা শফিকুর রহমান মুরাদ মনে করেন না খালেদা জিয়া ব্যর্থ হয়েছেন। মুরাদের বিচারে তিনি
তাঁর অবস্থানে অটলই আছেন; ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড় দিছে, তাই দেশে শান্তি ফিরে আসছে,’ বললেন মুরাদ, যিনি একজন গ্র্যাজুয়েট এবং নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন ও টিভি দেখেন। নিউ ইস্কাটনে নূর মসজিদের এক কোণে রাস্তার পাশে তাঁর সবজির দোকান। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার কী ধারণা, প্রধানমন্ত্রী কেন এত দিন পরে হঠাৎ খালেদা জিয়াকে “ছাড়” দিলেন?’
‘কারণ, প্রধানমন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হইছে,’ বললেন মুরাদ, ‘উনি বুঝতে পারছেন, এইভাবে আর চলতে পারে না। উনি পুলিশ বাহিনীকে বিএনপির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে যেভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করছেন, সেটা এরশাদের আমলেও আমরা দেখি নাই। প্রধানমন্ত্রী এখন বুঝতে পারছেন, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এত বাড়াবাড়ি তো ভালো না। দেশের সব মানুষ মনে মনে বিরুদ্ধে চলে গেলে শুধু স্বৈরাচারী পন্থায় তো বেশি দিন চালানো যাবে না। আর একটা কথা হলো, তাঁর ওপর বিদেশিদের চাপ আছে। সব দিক মিলায়া তাঁকে ছাড় দিতে হইছে।’
‘এই ছাড় দেওয়াটা কি ভালো হয়েছে?’ আমার এই প্রশ্নের উত্তরে মুরাদ বললেন, ‘অবশ্যই, হানড্রেড পারসেন্ট ভালো হইছে। এখন দেশের ভালো হবে। শান্তি ফিরে আসবে। এই যে সিটি নির্বাচন হইতে যাইতাছে, এর ফলে আরও ভালো হবে, মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে হ্যাঁ, এখানে একটা কথা আছে, সিটি নির্বাচন কিন্তু সুষ্ঠু হইতে হবে, নিরপেক্ষ হইতে হবে। কারচুপি হইলে বা বিএনপির প্রার্থীদের জোর করে হারানো হলে কিন্তু আবার অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।’
আর অশান্তি চান না ৫২ বছর বয়সী মোহাম্মদ কাল্লু মিয়া। কারণ, দেশজুড়ে গত তিন মাসের অশান্তিতে তাঁর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, প্রায়-অচল হতে বসেছে জীবন-জীবিকা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শান্তি-অশান্তির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল তাঁর জীবিকা। তিনি বাস করেন বাংলামোটরের উত্তর পাশের এক ঘিঞ্জি গলির ভেতরে। লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি, কিন্তু কাজ চালানোর মতো ভাষা শিখে নিয়েছেন প্রায় ডজন খানেক। প্রতিদিন সকালে তিনি এসে দাঁড়ান সোনারগাঁও হোটেলের গেটে। হোটেল থেকে পর্যটকেরা যখন বেরিয়ে আসেন, তখন তিনি নিজেকে একজন ‘ইন্টারপ্রেটার’ হিসেবে উপস্থাপন করেন, জানতে চান তাঁর সাহায্য তাঁদের দরকার কি না। তিনি তাঁদের নিয়ে যেতে পারেন কোনো বিপণিকেন্দ্রে, জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল বা অন্য কোনো দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানে। পর্যটকদের কেউ কেউ তাঁকে সঙ্গে নেন। দিন শেষে তাঁকে ৫০০ বা এক হাজার টাকা দেন। কোনো কোনো হৃদয়বান দেন আরও বেশি। কিন্তু প্রতিদিন তিনি এই কাজ পান না। আমার সঙ্গে দেখা হলেই মলিন মুখে বলেন, ‘স্যার, হোটেলে গেস্ট কম, আমার রুজিরোজগার প্রায় বন্ধ হইয়া গেছে। দেশের অবস্থা কি ভালো হইব না?’
সেদিন জসিম মিয়ার মুদি দোকানের সামনে কাল্লু মিয়ার সঙ্গে দেখা। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, দেশের অবস্থা তো ভালো, খালেদা জিয়া বাসায় ফিরা গেছে। এখন দেশে শান্তি হইব। বেশি বেশি বিদেশি গেস্ট আইব।’
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জসিম মিয়া বললেন, ‘দ্যাশের অবস্থা ভালো এইডা তোরে কে কইছে, কাল্লু? তুই রাজনীতি কিছু বোজছ?’
কাল্লু মিয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান, খানিক অপমানও বোধ করেন সম্ভবত। তিনি জসিম মিয়াকে বলেন, ‘ক্যান? পেট্রলবোমা বন্ধ হয় নাই? সিটির ইলেকশান হইতেছে না? অখন কুনোখানে মারামারি হইতাছে? ’
জসিম মিয়া কাল্লুকে পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলেন, ‘শান্তি দেখতাছেন, এইটা সিটি ইলেকশান বইল্যা। কিন্তু সিটি ইলেকশান দিয়া আসল সমস্যারে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হইতাছে। কিন্তু লাভ নাই। সামনে আরও খারাপ দিন আইতাছে।’
আমি জসিম মিয়ার কাছে তাঁর এই আশঙ্কার ব্যাখ্যা চাইলাম। তিনি বললেন, ‘প্রথম খারাপ কথা হইল, সিটি ইলেকশানে আওয়ামী লীগ সবগুলা মেয়র পদে জিতবার চায়। হেগো মন্ত্রী কইয়া দিছে, যেকোনো প্রকারে হোক জিততেই হইব। হেরা জোর কইরা ব্যাকটি জিত্যা নিলে বিএনপি কি বইয়া থাকব? গন্ডগোল শুরু হইব না? সিটি ইলেকশানের পরেই দেইখেন, কী শুরু হইয়া যায়।’
আমি বললাম, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপি করা বা জবরদস্তি খাটানো সম্ভব হবে না। এই সরকারের অধীনেই এর আগে পাঁচটা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রতিটাতেই বিএনপির প্রার্থীরা জিতেছেন। জসিম মিয়া বললেন, ‘ভালো কথা, এইবারও যদি ঠিকঠাক মতন ইলেকশান হয়, বিএনপির অন্তত দুইজন প্রার্থী মেয়র হইব। আচ্ছা হইল, সিটি ইলেকশানের ব্যাপার শ্যাষ হইল, কিন্তু তার পরে কী? দ্যাশ কি এইভাবেই চলব? সরকার যে কইয়া দিছে, উনিশ সালের আগে সংসদ নির্বাচন নাই, তো এই কয় বছর বিএনপি কী করব? বইয়া বইয়া হুক্কা খাইব? জে না, হেরা আবার আন্দোলন শুরু করব, এইবার আরও জোরেশোরে! আর সরকারও বইয়া থাকব না। তার মানে দুই পক্ষে মিল্যা যা শুরু করব, দ্যাশের এক্করে বারোটা বাইজ্জ্যা যাইব।’
যাঁরা দুই বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষের সাময়িক নমনীয়তা দেখে স্থিতিশীল ও শান্তিময় রাজনৈতিক ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধছেন, তাঁদের মনে হতে পারে জসিম মিয়া অতিরিক্ত হতাশাবাদী লোক। কিন্তু তাঁর শঙ্কাটা সত্যিই বিবেচনার যোগ্য। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর সপ্তাহ তিনেকের মধ্যেই মিলিয়ে যাবে। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন কখন, কী পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধ না মেটা পর্যন্ত প্রকৃত রাজনৈতিক সংকট থেকেই যাবে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments