রাজনীতিকে যে বাস্তবতা বুঝতে হবে
ড. বিনায়ক সেন অর্থনীতিবিদ। এখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট। ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক কমিটির সদস্য (১৯৯৭-২০০১), সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশনের সদস্য (২০০২-০৩)। বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (আইপিআরএসপি) প্রণয়নে জড়িত ছিলেন, ছিলেন ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্যানেল অব ইকোনমিস্টের সদস্য এবং বর্তমানে বেতন ও চাকরি কমিশনের সদস্য। দারিদ্র্য, বৈষম্য, মানব উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি তাঁর গবেষণার বিষয়। এ নিয়ে তাঁর ৫০টিরও বেশি প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের গ্রন্থ ও জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যে তাঁর অনুরাগের প্রকাশ হিসেবে লিখছেন সাহিত্য-ঘেঁষা প্রবন্ধ। তাঁর লেখালেখির ই-ঠিকানা binayaksenbd.com সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি যতটা, রাজনীতি তার বিপরীতে চলছে কেন?
বিনায়ক সেন রাজনৈতিক উন্নতি কখনোই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেনি কোনো দেশে। আমি সেই আদি মার্ক্সীয় ধারণার বিশ্বাসী যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি অনেকটা ঘটার পরই রাজনৈতিক উন্নতি আসে। উন্নত দেশগুলোয় উনিশ শতকজুড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আজকের অর্থে সর্বজনীন ভোটাধিকারের গণতন্ত্র তখন ছিল না। পূর্ব এশিয়ার উত্থিত দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতির পরই গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথমত, এখন বেশি করে গণতন্ত্রের প্রশ্নটা সর্বত্র উঠছে কেন? বাংলাদেশে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, যখন আমরা সত্যি সত্যি রাজনৈতিক উন্নতি আশা করতে পারি? আমার চলতি গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি, ১৯৯১-২০১০ পর্বে অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে (যাদের আয় মাথাপিছু দৈনিক দুই থেকে চার পিপিপি ডলারের মধ্যে)। প্রায় তিন গুণের মতো বৃদ্ধি পাওয়া এই মধ্যবিত্তের একটা অংশ আবার গত দুই দশকে শহরমুখী ও বিদেশমুখী হয়েছে। এই বিস্তৃত ও সক্রিয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এরা পরিবর্তনের সামাজিক ভরকেন্দ্র। এদের মধ্যে রাজনীতির উন্নতি দেখার বাড়তি প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যানুপাতে মধ্যবিত্ত থাকার পরও তো রাজনীতি বিকশিত হয়েছিল।
বিনায়ক সেন হ্যাঁ, স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে ‘সংখ্যানুপাতের স্বল্পতা’ রাজনৈতিক উন্নতির বাধা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত তখন ও এখনকার মধ্যবিত্তের চরিত্রের গুণগত পার্থক্য। তখনকার মধ্যবিত্ত ছিল প্রথম প্রজন্মের কৃষক সন্তান। তাদের পক্ষে কৃষকের জাতীয়তাবাদকে, তার আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করা সহজতর ছিল। গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত যতই এগিয়েছে, কৃষকের সঙ্গে তার যোগসূত্র ততই দুর্বল হয়েছে। এই নতুন মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠা শহরে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবহে তারা লালিত। তারা থাকছে ঢাকা শহরে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি ও প্যারিসে। কৃষক বিচ্ছিন্নতা এদের কুল-লক্ষণ। তার পরও যতটা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য তারা সোচ্চার হতে পারত, সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না বিলাসবহুল জীবনচর্চার কারণে। আমাদের এখানে চরিত্রের স্থিরতা নেই, শ্রেণী-চরিত্রেরও স্থিরতা নেই। শ্রেণী-বিভাজন ও সামাজিক সচলতা এত দ্রুত হলে বোধ করি এই হয়। এখানে বুদ্ধিজীবীরা আমলা হতে চায়, আমলারা হতে চায় ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। এ অবস্থায় দ্রুত রাজনৈতিক উন্নতি আশা করা যায় না।
প্রথম আলো তাহলে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার রাজনৈতিক পূর্বশর্ত কীভাবে তৈরি হবে? স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্য কী ধরনের পরিবর্তন দরকার হবে?
বিনায়ক সেন আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নজর কেড়েছি; কিন্তু রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে হুতু-তুতসি ধরনের বিরোধাত্মক সমাজে পরিণত হতে পারি। এরও মূলে রয়েছে দ্রুত হারে ও অবৈধ পন্থায় সংগৃহীত অর্থবিত্তের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য। এই অবৈধ বৈষম্যই রাজনৈতিক বিরোধাত্মক সমাজের মূলে প্ররোচনা জোগাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে প্রতিষ্ঠা করে এই অবৈধ বৈষম্যের মোকাবিলা করা যাবে না। যিনি আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে যাবেন, তাঁর শাসনের নৈতিক বৈধতা থাকা জরুরি। মানুষ অবৈধ শাসনের আইন ও শৃঙ্খলার যুক্তি মানতে চায় না। এ অবস্থায় দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় যেখানেই অবৈধ ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ দানা বাঁধে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসন। এমন ছিল ষাট-সত্তরের দশকের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বা যেমনটা এখনো আছে চীনে ও ভিয়েতনামে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পূর্ণতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসন, যা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দিতে পারে। এটি অবশ্যই শ্রেয়তর সমাধান, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে এটা কার্যকর হতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী শাসন বেশি দিন টেকে না, আবার পূর্ণ গণতন্ত্রেও হঠাৎ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই একধরনের মাঝামাঝি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও কেউ বলেছেন একে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র, আবার কেউ বলেছেন সংকর গণতন্ত্র। এর নানা প্রকারভেদ আছে। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ এক দলই ক্ষমতায় ছিল। ভারতে কংগ্রেস প্রথম দিকে প্রায় টানা ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন মিশ্র গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উন্নতির পথ-বিকল্প খোঁজার সুযোগ রয়ে গেছে। আমাদের দেশে গত দুই দশকে যা ছিল তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। একে নির্জলা কর্তৃত্ববাদী শাসন বলাও ভুল, আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র বলাও ভুল। উন্নয়নের এই পর্যায়ে এটাই আমাদের বিধিলিপি। এই ধারাকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে সহনীয় ধারার মিশ্র বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তা করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি আরও বেগবান হবে। এ ব্যাপারে আমরাই হতে পারি তৃতীয় বিশ্বের কাছে মিশ্র গণতন্ত্রের এক নতুন রোল মডেল। কিন্তু ব্যর্থ হলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমরাও অসহিঞ্চু বা অত্যাচারী গণতন্ত্রের স্থায়ী ঝুঁকিতে পড়ে যাব।
প্রথম আলো কিন্তু এই প্রক্রিয়া কি নির্বাচনকে এড়িয়ে চালানো সম্ভব? বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কি সম্ভব?
বিনায়ক সেন কারা ক্ষমতাসীন হবে, তার জন্য অবাধে নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার শাসনেরও রাজনৈতিক উন্নতি চাই। কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উন্নতি আনতে হলে দলীয় প্রার্থীদের গুণগত মান বৃদ্ধি করাই পরীক্ষিত পথ। নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় ও অর্থায়ন (ক্যামপেইন ফাইন্যান্স) ব্যবস্থার সংস্কার করা এর পূর্বশর্ত। ২০০৭ সালের দিকে এ নিয়ে আলাপ শুরু হলে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রাথমিক আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। সেই আগ্রহ আবার জাগানো দরকার। এখন তো মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর গুণগত মানের চেয়ে অর্থবিত্ত ও পেশিশক্তিকে প্রায়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর ফলে খারাপ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কাঠামোগতভাবে থেকে যায়। মনোনয়ন-বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে এই সূত্রেই। এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই হয় না, রাজনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হয়। সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের আরও একটি দিক হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল না হলেও কিছুটা পরিবর্তন। যেমন, দলে ধারাবাহিকভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা। আমরা গণমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার দৃশ্য দেখতে চাই—সেটা শুধু প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, নীতিমালা নিয়ে দলের ভেতরে বিতর্ক বা মতপার্থক্য বিষয়েও। কর্তৃত্ববাদী মিশ্র গণতন্ত্র মানে এককেন্দ্রিক শাসন নয়। ১৬ কোটি মানুষের দেশকে এক কেন্দ্র থেকে যথাযথ শাসন করা সম্ভব নয়। কেন উপজেলা-কাঠামো শুধু নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে থাকবে? কেন বিভাগীয় পার্লামেন্ট ধরনের কাঠামো গড়ে তোলা যাবে না? কেন শহর-প্রশাসনে আরও গভীরে বিকেন্দ্রীভবন হবে না? এর ফলে শুধু প্রশাসনের মানই বাড়বে না, জাতীয় সংসদেরও মান বাড়বে। আরেকটি অনালোচিত দিক হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। আওয়ামী লীগ জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, বিএনপি জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, আর বাদবাকি ২০ শতাংশ দলীয় সমর্থক নন—তাঁরা পারফরম্যান্স বুঝে ভোট দেন। এই সুইং ভোটাররাই সরকারের বদল আনেন। কিন্তু সংসদে আসনের ফলাফলে এটা প্রতিফলিত হয় না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটা প্রস্তাব হচ্ছে, ৩০০টি আসনে যেমন হচ্ছে তেমনই ধারার ভোট হোক; কিন্তু এর অতিরিক্ত আরও ১৫০টি আসনের বণ্টন বা নির্বাচন হোক জাতীয়ভাবে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এভাবে দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ‘মিশ্র’ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যেমন রাজনীতিতে ভারসাম্যআসবে, তেমনি দুই প্রধান দলের মধ্যে সাংঘর্ষিক উত্তাপও কমে আসবে বলে অনুমান করি। এককথায়, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও পূর্ণ গণতন্ত্রের মাঝামাঝি যে সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের কথা বললাম, সেখানে রাজনৈতিক উন্নতি ঘটানোর ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অনেক অবকাশ রয়ে গেছে।
প্রথম আলো দুটি ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে অন্তহীন শত্রুতার রাজনৈতিক ব্যাকরণ না বদলিয়ে তা কি সম্ভব?
বিনায়ক সেন কেবল ৪০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করা যেমন সম্ভব নয়, অন্যদিকে ৪০ শতাংশ নিয়ে বিএনপির পক্ষেও জাতির প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। এটি হচ্ছে মৌলিক সমকক্ষতার প্রশ্ন। এর থেকে চারটি কথা বলতে চাই। এক. আ.লীগকে যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও আলোচনা শুরু করতে হবে। এ পথেই দলের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিহিত। দুই. বিএনপিকে ইতিহাসের দাবিকে বুঝতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারারই অংশ। তাদের এই ক্ষেত্রটিকে পুনরায় অধিকার করতে হবে। গত দুই দশকে যে তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতার ধারায় বিকশিত হয়েছে, এটি তাদেরও প্রাণের দাবি। তিন. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একটি মাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যা হতে পারে না। ভারতে ১৯৪৭-র ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নিয়ে বিতর্ক নেই। সেখানে গান্ধীর পাশাপাশি ‘বামপন্থী’ নেহরু ও ‘ডানপন্থী’ প্যাটেলের চেতনাও আছে, দলিত প্রতিনিধি আম্বেদকরে নেতাজি সুভাষ বসুর চেতনাও আছে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাও আছে। সেভাবে আ.লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়াও বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুজিবের পাশাপাশি ভাসানীর চেতনার বিশিষ্টতার অবকাশ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর কোনো দলের একচেটিয়া চলতে পারে না। অন্যদিকে সব দলকেই দলীয় মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাবাদর্শিক জমিনেই দাঁড়াতে হবে। চার. জন রাউলস তাঁর ‘রিজনেবল প্লুরালিজম’-এর ধারণায় ধর্মীয় দল ও ধারাকেও স্থান দিয়েছেন—যদি তারা বর্ণবাদী, সামপ্রদায়িক বা জাতিবিদ্বেষী মতবাদ প্রচার না করে। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-বাস্তবতায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নির্যাতিতের পক্ষে যেমন দাঁড়িয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমাদের দেশে জামায়াতে ইসলামী ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর ধারায় রয়েছে এবং এর সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু একাত্তরকে অস্বীকার করে স্বীয় মতাদর্শের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দলটির পক্ষে কী করে সম্ভব? একাত্তরের কৃত অপরাধ ও ভুলত্রুটি এবং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধের স্বচ্ছ বিচারের বিষয়ে দলটিকে নতুন করে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত-সহিষ্ণুু সমাজের বিকাশের স্বার্থে এটাই তো কাম্য। দেশটা তো সবার—‘৩৬ জাতি না হলে নাকি রাজ্য চলে না।’ দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শান্তি নেমে আসুক, সেটা তো আমরা সবাই চাই। চাই কি?
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন ধন্যবাদ।
প্রথম আলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি যতটা, রাজনীতি তার বিপরীতে চলছে কেন?
বিনায়ক সেন রাজনৈতিক উন্নতি কখনোই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেনি কোনো দেশে। আমি সেই আদি মার্ক্সীয় ধারণার বিশ্বাসী যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি অনেকটা ঘটার পরই রাজনৈতিক উন্নতি আসে। উন্নত দেশগুলোয় উনিশ শতকজুড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আজকের অর্থে সর্বজনীন ভোটাধিকারের গণতন্ত্র তখন ছিল না। পূর্ব এশিয়ার উত্থিত দেশগুলোতেও অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নতির পরই গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রথমত, এখন বেশি করে গণতন্ত্রের প্রশ্নটা সর্বত্র উঠছে কেন? বাংলাদেশে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, যখন আমরা সত্যি সত্যি রাজনৈতিক উন্নতি আশা করতে পারি? আমার চলতি গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি, ১৯৯১-২০১০ পর্বে অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশ হয়েছে (যাদের আয় মাথাপিছু দৈনিক দুই থেকে চার পিপিপি ডলারের মধ্যে)। প্রায় তিন গুণের মতো বৃদ্ধি পাওয়া এই মধ্যবিত্তের একটা অংশ আবার গত দুই দশকে শহরমুখী ও বিদেশমুখী হয়েছে। এই বিস্তৃত ও সক্রিয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য অপরিহার্য। এরা পরিবর্তনের সামাজিক ভরকেন্দ্র। এদের মধ্যে রাজনীতির উন্নতি দেখার বাড়তি প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথম আলো পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যানুপাতে মধ্যবিত্ত থাকার পরও তো রাজনীতি বিকশিত হয়েছিল।
বিনায়ক সেন হ্যাঁ, স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের কালে ‘সংখ্যানুপাতের স্বল্পতা’ রাজনৈতিক উন্নতির বাধা হয়নি। এর কারণ সম্ভবত তখন ও এখনকার মধ্যবিত্তের চরিত্রের গুণগত পার্থক্য। তখনকার মধ্যবিত্ত ছিল প্রথম প্রজন্মের কৃষক সন্তান। তাদের পক্ষে কৃষকের জাতীয়তাবাদকে, তার আবেগ-অনুভূতিকে ধারণ করা সহজতর ছিল। গত ৫০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মধ্যবিত্ত যতই এগিয়েছে, কৃষকের সঙ্গে তার যোগসূত্র ততই দুর্বল হয়েছে। এই নতুন মধ্যবিত্তের বেড়ে ওঠা শহরে, পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আবহে তারা লালিত। তারা থাকছে ঢাকা শহরে, কিন্তু মনটা পড়ে আছে নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি ও প্যারিসে। কৃষক বিচ্ছিন্নতা এদের কুল-লক্ষণ। তার পরও যতটা রাজনৈতিক উন্নতির জন্য তারা সোচ্চার হতে পারত, সেটা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না বিলাসবহুল জীবনচর্চার কারণে। আমাদের এখানে চরিত্রের স্থিরতা নেই, শ্রেণী-চরিত্রেরও স্থিরতা নেই। শ্রেণী-বিভাজন ও সামাজিক সচলতা এত দ্রুত হলে বোধ করি এই হয়। এখানে বুদ্ধিজীবীরা আমলা হতে চায়, আমলারা হতে চায় ব্যবসায়ী আর ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ। এ অবস্থায় দ্রুত রাজনৈতিক উন্নতি আশা করা যায় না।
প্রথম আলো তাহলে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার রাজনৈতিক পূর্বশর্ত কীভাবে তৈরি হবে? স্থিতিশীলতা ও উন্নতির জন্য কী ধরনের পরিবর্তন দরকার হবে?
বিনায়ক সেন আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নজর কেড়েছি; কিন্তু রাজনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে না পারলে হুতু-তুতসি ধরনের বিরোধাত্মক সমাজে পরিণত হতে পারি। এরও মূলে রয়েছে দ্রুত হারে ও অবৈধ পন্থায় সংগৃহীত অর্থবিত্তের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য। এই অবৈধ বৈষম্যই রাজনৈতিক বিরোধাত্মক সমাজের মূলে প্ররোচনা জোগাচ্ছে। শুধু আইনশৃঙ্খলা শক্ত হাতে প্রতিষ্ঠা করে এই অবৈধ বৈষম্যের মোকাবিলা করা যাবে না। যিনি আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে যাবেন, তাঁর শাসনের নৈতিক বৈধতা থাকা জরুরি। মানুষ অবৈধ শাসনের আইন ও শৃঙ্খলার যুক্তি মানতে চায় না। এ অবস্থায় দার্শনিক মিশেল ফুকোর ভাষায় যেখানেই অবৈধ ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ দানা বাঁধে। এ অবস্থা থেকে বেরোনোর দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা রয়েছে। একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসন। এমন ছিল ষাট-সত্তরের দশকের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বা যেমনটা এখনো আছে চীনে ও ভিয়েতনামে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, পূর্ণতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুশাসন, যা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দিতে পারে। এটি অবশ্যই শ্রেয়তর সমাধান, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার নিরিখে এটা কার্যকর হতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী শাসন বেশি দিন টেকে না, আবার পূর্ণ গণতন্ত্রেও হঠাৎ করে যাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই একধরনের মাঝামাঝি রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সোনার পাথরবাটির মতো শোনালেও কেউ বলেছেন একে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র, আবার কেউ বলেছেন সংকর গণতন্ত্র। এর নানা প্রকারভেদ আছে। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘ ৫০ বছর যাবৎ এক দলই ক্ষমতায় ছিল। ভারতে কংগ্রেস প্রথম দিকে প্রায় টানা ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। মিশ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেমন মিশ্র গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক উন্নতির পথ-বিকল্প খোঁজার সুযোগ রয়ে গেছে। আমাদের দেশে গত দুই দশকে যা ছিল তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। একে নির্জলা কর্তৃত্ববাদী শাসন বলাও ভুল, আবার বিশুদ্ধ গণতন্ত্র বলাও ভুল। উন্নয়নের এই পর্যায়ে এটাই আমাদের বিধিলিপি। এই ধারাকে রাজনৈতিকভাবে আরও উন্নত করে সহনীয় ধারার মিশ্র বা কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। তা করা গেলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি আরও বেগবান হবে। এ ব্যাপারে আমরাই হতে পারি তৃতীয় বিশ্বের কাছে মিশ্র গণতন্ত্রের এক নতুন রোল মডেল। কিন্তু ব্যর্থ হলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো আমরাও অসহিঞ্চু বা অত্যাচারী গণতন্ত্রের স্থায়ী ঝুঁকিতে পড়ে যাব।
প্রথম আলো কিন্তু এই প্রক্রিয়া কি নির্বাচনকে এড়িয়ে চালানো সম্ভব? বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কি সম্ভব?
বিনায়ক সেন কারা ক্ষমতাসীন হবে, তার জন্য অবাধে নির্বাচন করাই যথেষ্ট নয়, ক্ষমতার শাসনেরও রাজনৈতিক উন্নতি চাই। কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উন্নতি আনতে হলে দলীয় প্রার্থীদের গুণগত মান বৃদ্ধি করাই পরীক্ষিত পথ। নির্বাচনী প্রচারণার ব্যয় ও অর্থায়ন (ক্যামপেইন ফাইন্যান্স) ব্যবস্থার সংস্কার করা এর পূর্বশর্ত। ২০০৭ সালের দিকে এ নিয়ে আলাপ শুরু হলে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রাথমিক আগ্রহও দেখিয়েছিলেন। সেই আগ্রহ আবার জাগানো দরকার। এখন তো মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর গুণগত মানের চেয়ে অর্থবিত্ত ও পেশিশক্তিকে প্রায়ই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর ফলে খারাপ প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কাঠামোগতভাবে থেকে যায়। মনোনয়ন-বাণিজ্যের সূত্রপাত ঘটে এই সূত্রেই। এতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই হয় না, রাজনৈতিক উন্নতিও বাধাগ্রস্ত হয়। সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্রের আরও একটি দিক হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল না হলেও কিছুটা পরিবর্তন। যেমন, দলে ধারাবাহিকভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করা। আমরা গণমাধ্যমে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চার দৃশ্য দেখতে চাই—সেটা শুধু প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নয়, নীতিমালা নিয়ে দলের ভেতরে বিতর্ক বা মতপার্থক্য বিষয়েও। কর্তৃত্ববাদী মিশ্র গণতন্ত্র মানে এককেন্দ্রিক শাসন নয়। ১৬ কোটি মানুষের দেশকে এক কেন্দ্র থেকে যথাযথ শাসন করা সম্ভব নয়। কেন উপজেলা-কাঠামো শুধু নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে থাকবে? কেন বিভাগীয় পার্লামেন্ট ধরনের কাঠামো গড়ে তোলা যাবে না? কেন শহর-প্রশাসনে আরও গভীরে বিকেন্দ্রীভবন হবে না? এর ফলে শুধু প্রশাসনের মানই বাড়বে না, জাতীয় সংসদেরও মান বাড়বে। আরেকটি অনালোচিত দিক হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। আওয়ামী লীগ জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, বিএনপি জোটের পক্ষে সমর্থন ৪০ শতাংশ, আর বাদবাকি ২০ শতাংশ দলীয় সমর্থক নন—তাঁরা পারফরম্যান্স বুঝে ভোট দেন। এই সুইং ভোটাররাই সরকারের বদল আনেন। কিন্তু সংসদে আসনের ফলাফলে এটা প্রতিফলিত হয় না। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটা প্রস্তাব হচ্ছে, ৩০০টি আসনে যেমন হচ্ছে তেমনই ধারার ভোট হোক; কিন্তু এর অতিরিক্ত আরও ১৫০টি আসনের বণ্টন বা নির্বাচন হোক জাতীয়ভাবে মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের ভিত্তিতে। এভাবে দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারবে। এই ‘মিশ্র’ নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যেমন রাজনীতিতে ভারসাম্যআসবে, তেমনি দুই প্রধান দলের মধ্যে সাংঘর্ষিক উত্তাপও কমে আসবে বলে অনুমান করি। এককথায়, কর্তৃত্ববাদী শাসন ও পূর্ণ গণতন্ত্রের মাঝামাঝি যে সহনীয় ধারার কর্তৃত্ববাদী সংকর গণতন্ত্রের কথা বললাম, সেখানে রাজনৈতিক উন্নতি ঘটানোর ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অনেক অবকাশ রয়ে গেছে।
প্রথম আলো দুটি ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে অন্তহীন শত্রুতার রাজনৈতিক ব্যাকরণ না বদলিয়ে তা কি সম্ভব?
বিনায়ক সেন কেবল ৪০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করা যেমন সম্ভব নয়, অন্যদিকে ৪০ শতাংশ নিয়ে বিএনপির পক্ষেও জাতির প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব নয়। এটি হচ্ছে মৌলিক সমকক্ষতার প্রশ্ন। এর থেকে চারটি কথা বলতে চাই। এক. আ.লীগকে যত দ্রুত সম্ভব সব দলের অংশগ্রহণে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ ও আলোচনা শুরু করতে হবে। এ পথেই দলের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ নিহিত। দুই. বিএনপিকে ইতিহাসের দাবিকে বুঝতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ছিল মুক্তিযুদ্ধের ধারারই অংশ। তাদের এই ক্ষেত্রটিকে পুনরায় অধিকার করতে হবে। গত দুই দশকে যে তরুণ প্রজন্ম আধুনিকতার ধারায় বিকশিত হয়েছে, এটি তাদেরও প্রাণের দাবি। তিন. ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একটি মাত্র অর্থ বা ব্যাখ্যা হতে পারে না। ভারতে ১৯৪৭-র ‘স্বাধীনতার চেতনা’ নিয়ে বিতর্ক নেই। সেখানে গান্ধীর পাশাপাশি ‘বামপন্থী’ নেহরু ও ‘ডানপন্থী’ প্যাটেলের চেতনাও আছে, দলিত প্রতিনিধি আম্বেদকরে নেতাজি সুভাষ বসুর চেতনাও আছে। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাও আছে। সেভাবে আ.লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়াও বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুজিবের পাশাপাশি ভাসানীর চেতনার বিশিষ্টতার অবকাশ রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর কোনো দলের একচেটিয়া চলতে পারে না। অন্যদিকে সব দলকেই দলীয় মতপার্থক্য সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাবাদর্শিক জমিনেই দাঁড়াতে হবে। চার. জন রাউলস তাঁর ‘রিজনেবল প্লুরালিজম’-এর ধারণায় ধর্মীয় দল ও ধারাকেও স্থান দিয়েছেন—যদি তারা বর্ণবাদী, সামপ্রদায়িক বা জাতিবিদ্বেষী মতবাদ প্রচার না করে। সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-বাস্তবতায় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নির্যাতিতের পক্ষে যেমন দাঁড়িয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমাদের দেশে জামায়াতে ইসলামী ‘রাজনৈতিক ইসলাম’-এর ধারায় রয়েছে এবং এর সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু একাত্তরকে অস্বীকার করে স্বীয় মতাদর্শের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দলটির পক্ষে কী করে সম্ভব? একাত্তরের কৃত অপরাধ ও ভুলত্রুটি এবং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধের স্বচ্ছ বিচারের বিষয়ে দলটিকে নতুন করে ভাবতে হবে। গণতান্ত্রিক ও ভিন্নমত-সহিষ্ণুু সমাজের বিকাশের স্বার্থে এটাই তো কাম্য। দেশটা তো সবার—‘৩৬ জাতি না হলে নাকি রাজ্য চলে না।’ দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শান্তি নেমে আসুক, সেটা তো আমরা সবাই চাই। চাই কি?
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
বিনায়ক সেন ধন্যবাদ।
No comments