রাজনৈতিক সহিংসতা- বাংলাদেশ কি নেভাবে না এ আগুন? by কাবেরী গায়েন
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতির সামনে একটি নতুন প্রত্যাশার দুয়ার উন্মোচিত
হয়েছে, যেমন দেশকে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা
বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
এ দেশে একাত্তরের
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব, মানুষ ভাবতেও ভুলে গিয়েছিল সে কথা। সরকার নানা
প্রতিকূলতা পার করে বিচারের ব্যবস্থা করেছে শুধু নয়, দেশীয়-আন্তর্জাতিক
নানা চাপের মুখেও প্রথম রায়টি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের প্রশ্নে তাদের আন্তরিকতা প্রমাণ করেছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি
রক্ষা করেছে। এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে গুণগত
পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে
গেছে। দায়িত্ব বেড়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধকে যাঁরা সব কাজের প্রেরণাবিন্দু মনে
করেন, তাঁদের সবার।
মুক্তিযুদ্ধ একটি বিজয়চেতনা। এই বিজয়চেতনার চিহ্নটি যাঁরা বহন করেন, দেশকে তাঁরা সব ধরনের অশুভ শক্তির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করবেন। সব ক্ষয়ক্ষতি আর জীবনহানি স্বীকার করে সেই প্রত্যাশাতেই জাতি নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রত্যাশা বিএনপির সেই সব মুক্তিযোদ্ধার কাছেও।
দেশ আজ রক্তাক্ত। বিভাজনটিও স্পষ্ট। আপাতদৃষ্টিতে সব সহিংসতা ও জীবনহানি নির্বাচনের পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মনে হলেও, গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ কাজ করছে এই বিভাজনের মূলে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলে শুধু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এই রক্তপাত হতো না। সহিংসতা নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়নি, বরং এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রথমে কাদের মোল্লা এবং পরে সাঈদীর বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন নৃশংসতার দিকে এগিয়েছে ক্রমাগত। সেই নৃশংসতার ধারাবাহিকতায় বরং যুক্ত হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা। দুঃখজনক হলো, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’ আর ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান’—এই পরস্পর বিরোধহীন বিষয় দুটিকে একাকার করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য, অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত যে সহিংস পথ বেছে নিয়েছে, এর সঙ্গে যেমন বিএনপির সায় লক্ষণীয়, তেমনি ‘ক্ষমতায় গেলে কেবল যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদেরই ছেড়ে দেওয়া হবে, এমন নয়; বরং যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, তাদেরও বিচার করা হবে’ মর্মে বিএনপির একাধিক নেতার বক্তব্য ভোটের ফলাফলের সঙ্গে ৪২ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় থাকা দেশবাসীকে এক ঘোর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যা হওয়ার কথা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, তা পর্যবসিত হয়েছে নিরীহ দেশবাসীকে মৃত্যু আর আতঙ্কের অভয়ারণ্যে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ঠুরতায়।
সাঈদীর বিপক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের বাড়িতে আগুন এবং নীলফামারীতে আসাদুজ্জামান নূরের ওপর পেট্রলবোমা নিক্ষেপ সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণের সাক্ষ্য দেয়। আঙুল ওঠে তাই সরাসরি সংক্ষুব্ধ পক্ষ জামায়াতের দিকে। দুই মাস ধরে নিরীহ দেশবাসীকে ককটেল আর পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরে ফেলা আর রেললাইন উপড়ে দেশকে কার্যত অচল করে দেওয়ার দায় বিএনপি কীভাবে এড়াবে?
সরকারই বা কীভাবে এড়াবে নির্বাচনকেন্দ্রিক ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়কে ঘিরে সহিংসতায় মৃত্যুর দায়কে? এ বছরের শুরু থেকে যে ধরনের সহিংসতা আমরা দেখছি, সরকারের ধারণা থাকার কথা যে বিচারের রায় কার্যকর হওয়া শুরু হলে সেই সহিংসতা কোন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জনগণের নৈতিক সমর্থনের খুব প্রয়োজন যে হয় এ-জাতীয় রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে, সেই ডাকটি যথাযথভাবে আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। ঐক্য হয়নি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে। নির্বাচনী ঐক্য না-ই হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর করার জন্য জনগণের নৈতিক সমর্থন সংহত করার ক্ষেত্রে, সহিংসতা মোকাবিলার জন্য বৃহত্তর একটি মঞ্চের ডাক দেওয়ার সময় ও প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকেরও বেশি আসনে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় গোটা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় সব শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে গেছে। বোঝার ওপরে শাকের আঁটি হিসেবে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু বিতর্কিত মুখকে বিজয়ী দেখানো। নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার পরিবর্তে কিছু মুখকে বিচারের আওতায় আনা হলে বরং সরকারের জনপ্রিয়তায় এতটা ধস হয়তো নামত না। সরকারের অনেক অর্জন নস্যাৎ হয়ে গেছে এমন কিছু মুখকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কারণে।
অন্যদিকে, গত পাঁচ বছরে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিরও নেই কোনো সাফল্য। না পেরেছে দলটি সরকারবিরোধী কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে, না রেখেছে সংসদে কোনো ভূমিকা। সব শেষে জাতিকে চূড়ান্ত সহিংসতার ভেতর ফেলে দিয়ে অজানা স্থান থেকে ভিডিও টেপের মাধ্যমে পরবর্তী হরতাল বা অবরোধের ঘোষণা দেওয়াতেই তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ। মুশকিল হলো, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ও গণমাধ্যমের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে সরকারি দলের অনিয়ম-দুর্নীতি উপস্থাপনে, বিরোধী দলের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনো মূল্যায়ন হয় না। ফলে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে বিরোধী দল যে জয়লাভ করে, তা যত না নিজেদের সাফল্য বা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কারণে; তার চেয়ে ঢের বেশি সব দোষের দায়ভার বিদায়ী সরকারের দিকে তাক হয়ে থাকার কারণে। লুটপাট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রশ্নে বড় দুই দলের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। মৌলিক পার্থক্য যা আছে, তা হলো জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে। এই প্রশ্ন দুটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাতক্ষীরা, সীতাকুণ্ড, নীলফামারী, পাবনা, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, লক্ষ্মীপুর জ্বলছে। জ্বলছে সিলেট, রংপুর, পীরগাছা, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর। এসব জায়গায় যারা মারা পড়ছেন, বাংলাদেশেরই মানুষ তাঁরা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয় মাস জ্বালানো-পোড়ানো-হত্যা-ধর্ষণ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল। এই দিন থেকেই ভারতের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাফেলা দেশমুখী হয়েছিল, ১৯৭১ সালে। এই ডিসেম্বরে যখন সাতক্ষীরা থেকে ‘সংখ্যালঘু’ নামের মানুষ সীমান্তের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে, তখন কি আমাদের রাজনীতিকেরা মুহূর্তের জন্য ভাববেন, কোথায় এনেছেন তাঁরা দেশটিকে ৪২ বছরে? নির্বাচনের মতো একটি রুটিন বিষয়কে কি পাঁচ বছর পর পর সহজভাবে পরিচালনা করার কথা ভাববেন তাঁরা? যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো জাতীয় ইস্যুতে যখন জ্বলছে দেশ, জাতীয় ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ কি নেভাবে না এ আগুন?
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মুক্তিযুদ্ধ একটি বিজয়চেতনা। এই বিজয়চেতনার চিহ্নটি যাঁরা বহন করেন, দেশকে তাঁরা সব ধরনের অশুভ শক্তির করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করবেন। সব ক্ষয়ক্ষতি আর জীবনহানি স্বীকার করে সেই প্রত্যাশাতেই জাতি নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রত্যাশা বিএনপির সেই সব মুক্তিযোদ্ধার কাছেও।
দেশ আজ রক্তাক্ত। বিভাজনটিও স্পষ্ট। আপাতদৃষ্টিতে সব সহিংসতা ও জীবনহানি নির্বাচনের পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত মনে হলেও, গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ কাজ করছে এই বিভাজনের মূলে। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার এই নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলে শুধু নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এই রক্তপাত হতো না। সহিংসতা নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়নি, বরং এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রথমে কাদের মোল্লা এবং পরে সাঈদীর বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন নৃশংসতার দিকে এগিয়েছে ক্রমাগত। সেই নৃশংসতার ধারাবাহিকতায় বরং যুক্ত হয়েছে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা। দুঃখজনক হলো, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার’ আর ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান’—এই পরস্পর বিরোধহীন বিষয় দুটিকে একাকার করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য, অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত যে সহিংস পথ বেছে নিয়েছে, এর সঙ্গে যেমন বিএনপির সায় লক্ষণীয়, তেমনি ‘ক্ষমতায় গেলে কেবল যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদেরই ছেড়ে দেওয়া হবে, এমন নয়; বরং যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, তাদেরও বিচার করা হবে’ মর্মে বিএনপির একাধিক নেতার বক্তব্য ভোটের ফলাফলের সঙ্গে ৪২ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় থাকা দেশবাসীকে এক ঘোর সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। যা হওয়ার কথা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন, তা পর্যবসিত হয়েছে নিরীহ দেশবাসীকে মৃত্যু আর আতঙ্কের অভয়ারণ্যে ঠেলে দেওয়ার নিষ্ঠুরতায়।
সাঈদীর বিপক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের বাড়িতে আগুন এবং নীলফামারীতে আসাদুজ্জামান নূরের ওপর পেট্রলবোমা নিক্ষেপ সরাসরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণের সাক্ষ্য দেয়। আঙুল ওঠে তাই সরাসরি সংক্ষুব্ধ পক্ষ জামায়াতের দিকে। দুই মাস ধরে নিরীহ দেশবাসীকে ককটেল আর পেট্রলবোমা ছুড়ে মেরে ফেলা আর রেললাইন উপড়ে দেশকে কার্যত অচল করে দেওয়ার দায় বিএনপি কীভাবে এড়াবে?
সরকারই বা কীভাবে এড়াবে নির্বাচনকেন্দ্রিক ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়কে ঘিরে সহিংসতায় মৃত্যুর দায়কে? এ বছরের শুরু থেকে যে ধরনের সহিংসতা আমরা দেখছি, সরকারের ধারণা থাকার কথা যে বিচারের রায় কার্যকর হওয়া শুরু হলে সেই সহিংসতা কোন মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জনগণের নৈতিক সমর্থনের খুব প্রয়োজন যে হয় এ-জাতীয় রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে, সেই ডাকটি যথাযথভাবে আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। ঐক্য হয়নি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে। নির্বাচনী ঐক্য না-ই হতে পারে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর করার জন্য জনগণের নৈতিক সমর্থন সংহত করার ক্ষেত্রে, সহিংসতা মোকাবিলার জন্য বৃহত্তর একটি মঞ্চের ডাক দেওয়ার সময় ও প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্ধেকেরও বেশি আসনে নির্বাচন হয়ে যাওয়ায় গোটা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতায় সব শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে গেছে। বোঝার ওপরে শাকের আঁটি হিসেবে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু বিতর্কিত মুখকে বিজয়ী দেখানো। নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার পরিবর্তে কিছু মুখকে বিচারের আওতায় আনা হলে বরং সরকারের জনপ্রিয়তায় এতটা ধস হয়তো নামত না। সরকারের অনেক অর্জন নস্যাৎ হয়ে গেছে এমন কিছু মুখকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কারণে।
অন্যদিকে, গত পাঁচ বছরে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপিরও নেই কোনো সাফল্য। না পেরেছে দলটি সরকারবিরোধী কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে, না রেখেছে সংসদে কোনো ভূমিকা। সব শেষে জাতিকে চূড়ান্ত সহিংসতার ভেতর ফেলে দিয়ে অজানা স্থান থেকে ভিডিও টেপের মাধ্যমে পরবর্তী হরতাল বা অবরোধের ঘোষণা দেওয়াতেই তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ। মুশকিল হলো, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে ও গণমাধ্যমের সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকে সরকারি দলের অনিয়ম-দুর্নীতি উপস্থাপনে, বিরোধী দলের সাফল্য-ব্যর্থতার কোনো মূল্যায়ন হয় না। ফলে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনে বিরোধী দল যে জয়লাভ করে, তা যত না নিজেদের সাফল্য বা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কারণে; তার চেয়ে ঢের বেশি সব দোষের দায়ভার বিদায়ী সরকারের দিকে তাক হয়ে থাকার কারণে। লুটপাট ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রশ্নে বড় দুই দলের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। মৌলিক পার্থক্য যা আছে, তা হলো জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে। এই প্রশ্ন দুটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাতক্ষীরা, সীতাকুণ্ড, নীলফামারী, পাবনা, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, লক্ষ্মীপুর জ্বলছে। জ্বলছে সিলেট, রংপুর, পীরগাছা, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর। এসব জায়গায় যারা মারা পড়ছেন, বাংলাদেশেরই মানুষ তাঁরা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয় মাস জ্বালানো-পোড়ানো-হত্যা-ধর্ষণ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল। এই দিন থেকেই ভারতের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাফেলা দেশমুখী হয়েছিল, ১৯৭১ সালে। এই ডিসেম্বরে যখন সাতক্ষীরা থেকে ‘সংখ্যালঘু’ নামের মানুষ সীমান্তের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে, তখন কি আমাদের রাজনীতিকেরা মুহূর্তের জন্য ভাববেন, কোথায় এনেছেন তাঁরা দেশটিকে ৪২ বছরে? নির্বাচনের মতো একটি রুটিন বিষয়কে কি পাঁচ বছর পর পর সহজভাবে পরিচালনা করার কথা ভাববেন তাঁরা? যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো জাতীয় ইস্যুতে যখন জ্বলছে দেশ, জাতীয় ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ কি নেভাবে না এ আগুন?
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments