মিডিয়া ভাবনা- টিভি টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা! by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
মহাজোট সরকারের নানা সমালোচনা ও ব্যর্থতা রয়েছে, তা সত্য। কিন্তু একটা ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করতে হবে। তাহলো, তাদের সরকারের আমলে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেছে।
দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিগত পাঁচ বছরে গণমাধ্যমের ওপর তেমন নিয়ন্ত্রণ আসেনি। সংবাদপত্রে কলামিস্টরা স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা লিখেছেন। টিভির টক শোতে আলোচকেরাও স্বাধীনভাবে সরকারের দোষত্রুটি দেখিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে সরকারের নানা দুর্নীতি, ভুলনীতি, দলীয়করণ, অপরাজনীতি, ছাত্রলীগের টেন্ডার-বাণিজ্য নিয়ে অসংখ্য অনুসন্ধানী ও সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা অত্যন্ত সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। যারা পারেনি, তারা তাদের দক্ষতার অভাবে পারেনি অথবা মালিকের আগ্রহের অভাবে পারেনি। সরকার বাধা দেয়নি। সরকারের এই মুক্ত সাংবাদিকতার নীতি প্রশংসনীয়। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো স্বাধীন সাংবাদিকতা। মহাজোট সরকার গণতন্ত্রের নানা শর্ত লঙ্ঘন করলেও স্বাধীন সাংবাদিকতার শর্তটি বাস্তবায়নে বাধা দেয়নি।
মহাজোট সরকার বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতায় এখন নির্বাচনকালীন বহুদলীয় সরকার। যেসব দল সরকারে রয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগবান্ধব। প্রকৃত বিরোধী দল এই সরকারে নেই। নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। অথচ সেই বহুদলীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে।
একটি দর্শকপ্রিয় টিভি চ্যানেলের টক শোর উপস্থাপনা থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না যে মালিকপক্ষের ওপর সরকার চাপ সৃষ্টি করায় এই ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ করা যায় যে মাহমুদুর রহমান মান্না একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সফল বাগ্মী হওয়াতে টিভির রাজনৈতিক টক শো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। তাঁর অনুরাগী দর্শকের সংখ্যা প্রচুর। এই ঘটনা থেকে অনেকে আশঙ্কা করছেন সরকার নির্বাচনের আগে টিভির টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করবে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশেষ বিশেষ আলোচককে আমন্ত্রণ না করার জন্য চাপ আছে। এই চাপ প্রয়োগের কারণ বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে লাইসেন্স পেয়েছে। বেশির ভাগ মালিকই আওয়ামীপন্থী। চ্যানেল মালিক ব্যবসায়ীদের নানা দুর্বলতার কথা সরকার জানে। কাজেই সরকার চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দিতে পারে। অনেককে দিচ্ছেও।
টিভির টক শো শুধু সরকারের সমালোচনা করে, এই ধারণা ঠিক নয়। অনেক আলোচক সরকারের নীতির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন এবং নানা বিষয়ে সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি বা একই অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বলেই এই অনুষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এত বেশি। ‘বিটিভির’ মতো শুধু একতরফা প্রশংসা হলে দর্শক এসব অনুষ্ঠান দেখতেন না। সরকার টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কি সব প্রাইভেট চ্যানেলকে বিটিভির অবস্থানে নিতে চায়?
সম্প্রতি আলোচ্য বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার জন্য টক শোর মডারেটর, আলোচক ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে এবিএম মূসা ‘টেলিভিশন টক শো: সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে নাগরিক উদ্যোগ’ শিরোনামে যে বক্তব্য পাঠ করেছেন, তা উদ্ধৃত করা হলো:
‘সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে আমরা টেলিভিশন টক শোতে স্বাধীন মতামত প্রকাশে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানতে পেরেছি। এরই অংশ হিসাবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে টক শো উপস্থাপককে পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও আমরা জানতে পেরেছি। সরকারের সমালোচনাকারী বা ভিন্নমতাবলম্বী বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষককে টক শোতে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং সরকারের পছন্দমতো আলোচকদের বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণ জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এর আগে দেশের বরেণ্য কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ওপর হামলা, আক্রমণ এবং হয়রানির মতো কিছু শোচনীয় ঘটনাও সাম্প্রতিককালে ঘটেছে।
আমরা তাকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে মনে করি। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করছি এবং সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে অনতিবিলম্বে বিরত হওয়ার দাবি করছি।’
আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চর্চা এবং এতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে সরকারসহ সব মহলের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করা বা তার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করা বা গঠনমূলক বিভিন্ন মতামত প্রদান করার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রদান করেছে। বিশেষ করে, দেশে নির্বাচনকালীন সময়ে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাসহ এসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং এসব অধিকার হরণকারী সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মাধ্যমে সরকার তার এই কর্তব্যেও বরখেলাপ করছে। সরকারের এ ভূমিকা জনগণের মুক্ত মননশীলতা, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার চর্চা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করি।
আমরা বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অধিকার এবং ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী সব মহলের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জোর অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জনগণকে মুক্তভাবে কথা বলতে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করারও আহ্বান জানাই।
আমরা আশা করি, সরকার এই ভুল পথে পা বাড়াবে না। গণমাধ্যম যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে সেই সরকারকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। এমনিতে নানা কারণে বর্তমান সরকারের অবস্থা টালমাটাল। টক শো নিয়ন্ত্রণ করে সরকার কফিনের শেষ পেরেকটি যেন না মারে।
মহাজোট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে আরও ১৩টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়ে গেছে। আমাদের দলীয় রাজনীতি ও সরকার কতটা দূষিত হলে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার একটা বড় প্রমাণ এটি। টিভি লাইসেন্স, বেতার লাইসেন্স, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির লাইসেন্স বর্তমান সরকার একমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছে। ব্যতিক্রম খুব কম। যেহেতু এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি দিয়ে প্রচুর মুনাফা করা সম্ভব। এমনকি শুধু লাইসেন্স বিক্রি করে দিলে বা অন্যদের ভাগ দিলেও বিরাট অঙ্কের টাকা আয় করা সম্ভব। আমাদের দুই বড় দলের রাজনীতি যে প্রধানত হালুয়া-রুটির রাজনীতি, তা এই ঘটনাতে আবার প্রমাণিত হয়েছে। টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে দল ও সরকারের ওপর মহলে যে অনেক লেনদেন হয়েছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কারা লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁদের নাম, পরিচয় দেখলেও তা অনুমান করা যায়। টিভি মাধ্যমের উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা যে খুব উদগ্রীব, তা কারও মনে হবে না। টাকা রোজগার ও নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোই এই টিভি লাইসেন্স সংগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য।
এখন যেসব টিভি চ্যানেল চলছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি মূলধন, স্পনসর, বিজ্ঞাপন ও উপযুক্ত লোকবলের অভাবে ধুঁকছে। বাংলাদেশে টিভি মিডিয়ায় উপযুক্ত লোকবল, শিল্পী, লেখক, উপস্থাপক পাওয়াই এক বড় সমস্যা। টিভির পর্দায় শুধু লাইসেন্স দেখালে তো আর দর্শক সেই চ্যানেল দেখবে না। আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজারও সীমিত। সরকার এই বাস্তব সত্যটিও মনে রাখে না। লাইসেন্স বিতরণ করে দুর্নীতি করা যাদের একমাত্র লক্ষ্য, তাদের অবশ্য অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করার কথা নয়। যে সরকার বা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরে একটা সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি, সেই সরকারের মন্ত্রীরা আবার মাইক পেলে বড় বড় কথা বলেন।
একটা সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি না করে খেয়ালখুশি মতো এ ধরনের টিভির লাইসেন্স দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত? দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব তো রুটিন কাজ চালিয়ে যাওয়া, নীতিগত বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে এই ১৩টি টিভি লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
মহাজোট সরকার বিদায় নিয়েছে। ক্ষমতায় এখন নির্বাচনকালীন বহুদলীয় সরকার। যেসব দল সরকারে রয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগবান্ধব। প্রকৃত বিরোধী দল এই সরকারে নেই। নির্বাচনের সময় গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে, এটাই প্রত্যাশিত। অথচ সেই বহুদলীয় সরকার নির্বাচনের প্রাক্কালে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার পাঁয়তারা করছে বলে জানা গেছে।
একটি দর্শকপ্রিয় টিভি চ্যানেলের টক শোর উপস্থাপনা থেকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না যে মালিকপক্ষের ওপর সরকার চাপ সৃষ্টি করায় এই ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ করা যায় যে মাহমুদুর রহমান মান্না একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সফল বাগ্মী হওয়াতে টিভির রাজনৈতিক টক শো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। তাঁর অনুরাগী দর্শকের সংখ্যা প্রচুর। এই ঘটনা থেকে অনেকে আশঙ্কা করছেন সরকার নির্বাচনের আগে টিভির টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করবে। কোনো কোনো টিভি চ্যানেলে বিশেষ বিশেষ আলোচককে আমন্ত্রণ না করার জন্য চাপ আছে। এই চাপ প্রয়োগের কারণ বেশির ভাগ টিভি চ্যানেল বর্তমান সরকারের অনুগ্রহে লাইসেন্স পেয়েছে। বেশির ভাগ মালিকই আওয়ামীপন্থী। চ্যানেল মালিক ব্যবসায়ীদের নানা দুর্বলতার কথা সরকার জানে। কাজেই সরকার চাইলে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দিতে পারে। অনেককে দিচ্ছেও।
টিভির টক শো শুধু সরকারের সমালোচনা করে, এই ধারণা ঠিক নয়। অনেক আলোচক সরকারের নীতির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন এবং নানা বিষয়ে সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন। পাশাপাশি বা একই অনুষ্ঠানে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে বলেই এই অনুষ্ঠানগুলোর জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা এত বেশি। ‘বিটিভির’ মতো শুধু একতরফা প্রশংসা হলে দর্শক এসব অনুষ্ঠান দেখতেন না। সরকার টক শোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কি সব প্রাইভেট চ্যানেলকে বিটিভির অবস্থানে নিতে চায়?
সম্প্রতি আলোচ্য বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার জন্য টক শোর মডারেটর, আলোচক ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট প্রতিনিধি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে এবিএম মূসা ‘টেলিভিশন টক শো: সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে নাগরিক উদ্যোগ’ শিরোনামে যে বক্তব্য পাঠ করেছেন, তা উদ্ধৃত করা হলো:
‘সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে আমরা টেলিভিশন টক শোতে স্বাধীন মতামত প্রকাশে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিধিনিষেধ আরোপের কথা জানতে পেরেছি। এরই অংশ হিসাবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল থেকে টক শো উপস্থাপককে পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও আমরা জানতে পেরেছি। সরকারের সমালোচনাকারী বা ভিন্নমতাবলম্বী বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষককে টক শোতে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং সরকারের পছন্দমতো আলোচকদের বাধ্যতামূলক আমন্ত্রণ জানানোর জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এর আগে দেশের বরেণ্য কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ওপর হামলা, আক্রমণ এবং হয়রানির মতো কিছু শোচনীয় ঘটনাও সাম্প্রতিককালে ঘটেছে।
আমরা তাকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে মনে করি। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করছি এবং সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে অনতিবিলম্বে বিরত হওয়ার দাবি করছি।’
আমরা মনে করি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চর্চা এবং এতে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত রাখার স্বার্থে সরকারসহ সব মহলের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করা বা তার সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করা বা গঠনমূলক বিভিন্ন মতামত প্রদান করার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধান বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রদান করেছে। বিশেষ করে, দেশে নির্বাচনকালীন সময়ে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাসহ এসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা এবং এসব অধিকার হরণকারী সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা। টক শো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার মাধ্যমে সরকার তার এই কর্তব্যেও বরখেলাপ করছে। সরকারের এ ভূমিকা জনগণের মুক্ত মননশীলতা, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার চর্চা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করি।
আমরা বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের অধিকার এবং ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী সব মহলের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জোর অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জনগণকে মুক্তভাবে কথা বলতে দিয়ে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করারও আহ্বান জানাই।
আমরা আশা করি, সরকার এই ভুল পথে পা বাড়াবে না। গণমাধ্যম যদি সরকারের বিপক্ষে চলে যায়, তাহলে সেই সরকারকে আর কেউ রক্ষা করতে পারবে না। এমনিতে নানা কারণে বর্তমান সরকারের অবস্থা টালমাটাল। টক শো নিয়ন্ত্রণ করে সরকার কফিনের শেষ পেরেকটি যেন না মারে।
মহাজোট সরকার বিদায় নেওয়ার আগে আরও ১৩টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়ে গেছে। আমাদের দলীয় রাজনীতি ও সরকার কতটা দূষিত হলে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তার একটা বড় প্রমাণ এটি। টিভি লাইসেন্স, বেতার লাইসেন্স, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির লাইসেন্স বর্তমান সরকার একমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় দিয়েছে। ব্যতিক্রম খুব কম। যেহেতু এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি দিয়ে প্রচুর মুনাফা করা সম্ভব। এমনকি শুধু লাইসেন্স বিক্রি করে দিলে বা অন্যদের ভাগ দিলেও বিরাট অঙ্কের টাকা আয় করা সম্ভব। আমাদের দুই বড় দলের রাজনীতি যে প্রধানত হালুয়া-রুটির রাজনীতি, তা এই ঘটনাতে আবার প্রমাণিত হয়েছে। টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিয়ে দল ও সরকারের ওপর মহলে যে অনেক লেনদেন হয়েছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কারা লাইসেন্স পেয়েছেন, তাঁদের নাম, পরিচয় দেখলেও তা অনুমান করা যায়। টিভি মাধ্যমের উন্নয়ন নিয়ে তাঁরা যে খুব উদগ্রীব, তা কারও মনে হবে না। টাকা রোজগার ও নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোই এই টিভি লাইসেন্স সংগ্রহের প্রধান উদ্দেশ্য।
এখন যেসব টিভি চ্যানেল চলছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি মূলধন, স্পনসর, বিজ্ঞাপন ও উপযুক্ত লোকবলের অভাবে ধুঁকছে। বাংলাদেশে টিভি মিডিয়ায় উপযুক্ত লোকবল, শিল্পী, লেখক, উপস্থাপক পাওয়াই এক বড় সমস্যা। টিভির পর্দায় শুধু লাইসেন্স দেখালে তো আর দর্শক সেই চ্যানেল দেখবে না। আমাদের বিজ্ঞাপনের বাজারও সীমিত। সরকার এই বাস্তব সত্যটিও মনে রাখে না। লাইসেন্স বিতরণ করে দুর্নীতি করা যাদের একমাত্র লক্ষ্য, তাদের অবশ্য অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করার কথা নয়। যে সরকার বা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরে একটা সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি, সেই সরকারের মন্ত্রীরা আবার মাইক পেলে বড় বড় কথা বলেন।
একটা সুষ্ঠু নীতিমালা তৈরি না করে খেয়ালখুশি মতো এ ধরনের টিভির লাইসেন্স দেওয়া কতটা যুক্তিসংগত? দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব তো রুটিন কাজ চালিয়ে যাওয়া, নীতিগত বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে এই ১৩টি টিভি লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।
No comments