প্রসঙ্গ ইসলাম- মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান- অধ্যাপক by হাসান আবদুল কাইয়ূম
মানবশিশুর বুলি ফোটে মায়ের ভাষায়। মায়ের ভাষার মতো মধুর ভাষা আর হয় না। মাতৃভাষা আলস্নাহর সেরা দান। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আর্র্হমানু 'আলস্নামাল কুরআন, খালাকাল ইন্সানা আলস্নামাহুল বাইয়ান_ পরম করম্নণাময় আলস্নাহ্, তিনি কুরআন শিৰা দিয়েছেন,
তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে (সূরা আর্রাহ্মান: আয়াত ১-৪)মনের ভাব প্রকাশ করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে মাতৃভাষা। মাতৃভাষা দ্বারা যতো সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায় ততো সহজে তা অন্য কোনো ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না।
যার যার মাতৃভাষা তার তার কাছে অতিপ্রিয়। পৃথিবীতে বর্তমানে অসংখ্য ভাষা রয়েছে, কালের আবর্তে বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ভাষার বৈচিত্র্যও আলস্নাহ্র কুদরতের নিদর্শন।
পৃথিবীতে যুগে যুগে আলস্নাহ্ জালস্নাশানুহু পথভ্রষ্ট দিশেহারাকে সত্য পথের দিশা দেবার জন্য, হিদায়াত আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য অনেক নবী-রসুল প্রেরণ করেছেন। তিনি তাঁদেরকে যে জনপদে বা কওমের কাছে পাঠিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেককে সেই জনপদের মানুষের ভাষাভাষী বা কওমের ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছেন। আলস্নাহ্ জালস্নাশানুহু ইরশাদ করেন : আমি প্রত্যেক রসুলকে তাঁর নিজ কওমের ভাষাভাষী করেছি তাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবার জন্য (সূরা ইব্রাহীম: আয়াত ৪)।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সালস্নালস্নাহু আলায়হি ওয়া সালস্নামের নিকট কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে তাঁর মাতৃভাষা আরবীতে। কুরআন মজীদ কেনো আরবী ভাষায় নাযিল হলো সে সম্পর্কে আলস্নাহ জালস্নাশানুহু ইরশাদ করেন : (হে রসুল) আমি তো আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যাতে আপনি এর দ্বারা মুত্তাকীদেরকে সুসংবাদ দিতে পারেন এবং এর দ্বারা বিত-াপ্রবণ সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিতে পারেন (সূরা মরিয়ম: আয়াত ৯৭)। আরও ইরশাদ হয়েছে : এ আমি নাযিল করেছি আরবী ভাষায় কুরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো (সূরা ইউসুফ : আয়াত ৩)।
ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানে সেই অঞ্চল বা জনপদের মানুষের মাতৃভাষার ওপর গুরম্নত্ব আরোপ করেছে।
বাংলাদেশে ইসলাম আসে সপ্তম শতাব্দীতেই। এখানে মুসলিম শাসন কায়েম হবার পূর্বে এখানকার অধিবাসীদের কথা বলার বুলি দারম্নণ অবহেলিত অবস্থায় ছিলো। এ সম্পর্কে ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন : মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পলস্নী কুটিরে বাস করিতেছিল। বাঙ্গালা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেৰায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। প-িতেরা নস্যাদার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শেস্নাকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং 'তৈলাধার পাত্র কিম্বা পাত্রাধার তৈল' এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। সেখানে বঙ্গ ভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গ ভাষাকে প-িতম-লী দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গ ভাষা তেমনই সুধী সমাজের কাছে অপাঙ্ক্তেয় ছিল, তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেৰার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর অপেৰা করিয়া থাকে, বঙ্গ ভাষা তেমনই কোনো শুভদিন, শুভৰণের জন্য প্রতীৰা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভদিন, শুভৰণের সুযোগ আনয়ন করিল। বঙ্গ সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অতু্যক্তি হইবে না। (দ্র: শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, বঙ্গ ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব)
প্রাচীন বাংলার উৎস-স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ চর্যাপদকে চিহ্নিত করেছেন। এই চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়াদের মধ্যেই বন্দীদশায় ছিল। তাকে বাংলা ভাষা বলাও দুরূহ। বাংলা ভাষায় যখন থেকে আরবী, ফারসী, তুর্কী শব্দ ভাষার তাগিদেই ব্যবহৃত হতে লাগলো, তখন থেকে এ ভাষা প্রাঞ্জল ও প্রাণবনত্ম ভাষা হিসাবে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে লাগলো। মুসলিম শাসনে এসে তা প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। ডক্টর আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন : তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হলো।
এখানে উলেস্নখ্য, ৬২৮ খৃস্টাব্দে ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির পর থেকে আরবের বাইরের বিভিন্ন দেশে ইসলাম প্রচার শুরম্ন হয়, যার ব্যাপকতা সঞ্চারিত হয় ৬৩২ খৃস্টাব্দে বিদায় হজ্জের পরবর্তীকালে। ঐ সময় চীন, সুমাত্রাগামী আরব বাণিজ্য নৌজাহাজে করে প্রচুর পা-িত্যের অধিকারী কোনো কোনো সাহাবী বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরে সফর বিরতি দিয়ে এখানে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁরা বাংলা দেশের অভ্যনত্মরে প্রবেশ করেননি। তাঁদের কারো কারো মাথার শরীফ এখনো চীনের ক্যান্টন নগরীর 'ম্যাসেন্জার মসজিদ' সংলগ্ন এ্যানসেসটরস্ গ্রেভইয়ার্ডে রয়েছে।
হযরত উমর রাদিআলস্নাহু তা'আলা আনহুর খিলাফতকালের মধ্যভাগে অর্থাৎ ৬৪০ খৃস্টাব্দের দিকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ব্যাপকতা শুরম্ন হয়। আরবী, ফারসী, তুকর্ী ভাষাভাষী মহান প্রচারকগণ এখানে এসে এখানকার মানুষের ভাষা আয়ত্ত করে এই ভাষাতেই ইসলাম প্রচার করেন। ফলে এখানকার ভাষায় বহু আরবী, ফারসী, তুর্কী প্রভৃতি ভাষার শব্দ সংযোজনে এ ভাষা প্রাণবনত্ম ভাষায় পরিণত হয়। তাই তো আমরা লৰ্য করি, ৬৫০ খৃস্টাব্দে বাংলা ভাষা প্রকৃত অবয়বে বিকশিত হচ্ছে।
১২০১ খৃস্টাব্দে বাঙ্গালায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বে এখানকার রাজারা বাংলা ভাষাকে নিষিদ্ধ ভাষা করেছিলো। বলা হয়েছিলো : অষ্টাদশ পুরানানি বামস্য চরিতানিচ/ভাষায়াং মানব শ্রম্নত্বা রৌরব নরকং ব্রজেত। অষ্টাদশ পুরাণ রামচরিত ইত্যাদি মানব (বাংলা) ভাষায় চর্চা করলে রৌরব নরকে যেতে হবে।
ইসলাম বলে, সব ভাষাই আলস্নাহর দান। যার যার মাতৃভাষা তার তার জন্য আলস্নাহ জালস্নাশানুহুর সেরা দান। এই সেরা দানকে যথাযথভাবে লালন ও পরিচর্যার মধ্য দিয়ে আলস্নাহর এই মহাদানের জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করা যায়। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা পায় ২৪ কোটি, যার মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। আমরা লৰ্য করি, এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় উন্নীত করার জন্য আবুল বরকত, রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ তরতাজা প্রাণ শহীদ হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। একুশে ফেব্রম্নয়ারি ভাষা শহীদ দিবস আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে।
লেখক: উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা:), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
No comments