হক সাহেব থেকে শেখ হাসিনা অর্ধশতক ধরে একই অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রহক সাহেব থেকে শেখ হাসিনা অর্ধশতক ধরে একই অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র আবদুল by গাফ্ফার চৌধুরী
মাসখানেকের উপর হয় ঢাকায় এসেছি। আমার ঢাকায় অবস্থানের সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লী সফরে গেছেন এবং ভারত বিজয় শেষে ঢাকায় ফিরে এসেছেন।
তিনি ফিরে আসার পরেই ভারতের সঙ্গে তাঁর তিনটি চুক্তি ও দু'টি সমঝোতা নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক সৃষ্টি ও অপপ্রচারের ধুম। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক কুবুদ্ধিজীবীরা কলম শাণিত করে বিভিন্ন কাগজে কুযুক্তি তুলে লেখালেখি শুরু করেছেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া চুক্তি হওয়ার আগেই তার বিরোধিতা শুরু করেছিলেন। এখন চুক্তি হতে না হতেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, "ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।" তার সঙ্গে ধুয়া ধরেছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতারা। খালেদা জিয়ার কণ্ঠে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়ার ধুয়া শুনে পাকিস্তান আমলের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট যখন বিরাট বিজয় লাভ করে এবং ফজলুল হক প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তখন ঠিক আজকের বিএনপি নেতাদের মতোই তখনকার মুসলিম লীগ নেতারা প্রচার করতে শুরু করেছিলেন যে, হক সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হলে তিনি গোটা দেশটাই ভারতের কাছে বিক্রি করে দেবেন। এই প্রচারণার জবাবে মুসলিম লীগের নেতাদের উদ্দেশ করে হক সাহেব খাঁটি বরিশালের ভাষা ব্যবহার করে বলেছিলেন, "চোরার পুত চোররা, দেশটা লুটপাট কইরা কিছু রাখছোস যে, ভারতের কাছে বিক্রি কইরা দুইটা পয়সা পাইমু?"খালেদা জিয়া এবং তার বশংবদদের কাছেও আওয়ামী লীগ নেতাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, গত জোট সরকারের এবং তারেক বাহিনী ও হাওয়া ভবনের পাঁচ বছরব্যাপী অবাধ লুটপাট ও শোষণ-নির্যাতনের পর বাংলাদেশের আর কি অবশিষ্ট আছে যে, তা বিক্রি করে লাভবান হওয়া যাবে? ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মতায় বসে খালেদা-নিজামী সরকার বাংলাদেশকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কলোনি, ভারতের অর্থনৈতিক কলোনি, আমেরিকার সামরিক কলোনি এবং সৌদি বাদশাদের ধমর্ীয় (কট্টর ওহাবিজম) কলোনিতে পরিণত করে গেছেন। কথাটা আমার নয়, বিলেতের একটি প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিকের মন্তব্য। বিএনপি-জামায়াতের কুবুদ্ধিজীবীরা তখনও এর প্রতিবাদ করেননি। এখনও করার হিম্মত দেখাচ্ছেন না। কারণ ভাড়াটে বাঁশি কখনও অন্য সুর বাজাতে জানে না।
গত রবিবারের সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেত্রী যেসব কথা বলেছেন তা সংবাদপত্রে পাঠ করে ঢাকায় অবস্থানকারী এক বিদেশী কূটনীতিক আমাকে বলেছেন, "তোমাদের বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব যেমন আনকালচার্ড, তেমনি ইরিটেটিং। ভারত যদি তোমাদের শত্রুও হয়, তাহলে সামান্য শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক জ্ঞান যার আছে, তেমন কোন বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রী কি প্রতিবেশী এত বড় দেশটিকে অনবরত চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে স্থায়ী অবস্থান গ্রহণ করার দেউলিয়াপনার পরিচয় দেখাতে পারেন? এই বিরোধীদলীয় নেত্রী অতীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশা রাখেন। যদি তিনি ভবিষ্যতে আবার প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাকেও আলোচনা বৈঠকে বসতে হবে। তখন তিনি কোন্ মুখ নিয়ে দিল্লীতে যাবেন, অথবা দিল্লীর কর্তাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানাবেন? তখন দিল্লী যদি তার আমন্ত্রণে সাড়া না দেয়?
আমি এই কূটনীতিক বন্ধুকে বলেছি, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বিকল্প আরেকটি বড় গণতান্ত্রিক দলের অনুপস্থিতি। বিএনপির ভারত-বিরোধিতা কোন জাতীয় স্বার্থ রার ইসু্য নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক শাসকদের কাছ থেকে তারা এই বিদ্বেষ পোষণ ও বিরোধিতার উত্তরাধিকার গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ক্যাপিটাল মাত্র এই একটা ইসু্যই। তাতে তি হচ্ছে বাংলাদেশের এবং লাভবান হচ্ছে পাকিস্তান।
পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে এই প্রক্সি ওয়ার চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। তাতে তি হচ্ছে বাংলাদেশের। ঢাকায় ও দিল্লীর মধ্যে যে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো দীর্ঘকাল ধরে ঝুলে আছে, তা মীমাংসায় এত কাল কোন আন্তরিকতা ও আগ্রহ দেখায়নি দিল্লী। শেখ হাসিনার কৃতিত্ব এই যে, তিনি দুই দু'বার মতায় গিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থে ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কের অচলাবস্থা দূর করার সফল চেষ্টা চালিয়েছেন। এবারও দিল্লীর সঙ্গে তার তিনটি চুক্তি এবং দু'টি সমঝোতা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বরফ গলাতে শুরু করেছে। এই চুক্তির ফলে বর্তমানে ভারত কিছুটা বেশি লাভবান হলেও আখেরে বাংলাদেশই বেশি লাভবান হবে। এই সত্যটা বিএনপির কুবুদ্ধিজীবীরা দেশবাসীর কাছে গোপন রেখে জাতীয় স্বার্থে নয়, দলীয় স্বার্থে বিভ্রান্তি ছড়াবার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতির সবচাইতে দুর্ভাগ্যজন দিক হচ্ছে দেশের স্বার্থ রায় কূটনৈতিক বুদ্ধি ও চাতুর্য্যের বদলে ক্রমাগত মিথ্যাচার ও রণংদেহী মনোভাব প্রদর্শন। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যায় যে, ভারত একটি বিরাট প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, তাহলেও অধিকতর কূটনৈতিক কৌশল ও প্রচেষ্টা দ্বারা তার মোকাবেলা করতে হবে। হুঙ্কার ও কনপ্রন্টেশনের নীতি দ্বারা তার প্রতিকার করা যাবে না; বরং একটি শক্তিশালী বড় প্রতিবেশীকে চিরশত্রু বানিয়ে কোন বিরোধেরই মীমাংসা করা যাবে না, শুধু জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার চরম তি করা হবে।
ধরা যাক, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা লাভের কথা। দিল্লীর সঙ্গে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক চুক্তির আগেই মুজিব সরকার ৪০ কিউসেক পানি লাভের ব্যবস্থা করেছিলেন। সামরিক কু ঘটিয়ে জিয়াউর রহমান মতা দখলের পর গঙ্গার পানি আনার প্রশ্নে কনফ্রন্টেশনের নীতি গ্রহণ এবং লংমার্চের ব্যবস্থা করেও এক ফোঁটা পানি আনতে পারেননি। বছরের পর বছর বাংলাদেশকে ভারত গঙ্গার পানি না দেয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছিল। তাতে জিয়া বা এরশাদ সরকার কি করতে পেরেছিলেন?
বাংলাদেশকে পানির হিস্যা দিতে ভারত যাতে বাধ্য হয়, সেজন্য জিয়া বা এরশাদ সরকার কোন আন্তর্জাতিক চাপ কি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন? যে দেশগুলোর স্বার্থে (যেমন-পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরব) বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত জোট অনবরত দেশে ভারত বিদ্বেষ প্রচার করছে, তাদের একটি দেশও কি সীমান্ত বিরোধ, পানি বিরোধ ও ছিটমহল সমস্যায় বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ে কখনও দিল্লীর দিকে একটি অঙ্গুলি উত্তোলনেরও সাহস দেখিয়েছে? নাকি খালেদা-নিজামী সরকার মতায় থাকাকালে ভারতবিরোধী হুঙ্কার ছেড়ে এসব সমস্যার কোন সমাধান করতে পেরেছেন, অথবা সমাধানের ব্যাপারে কোন দেশেরই কার্যকর সমর্থন ও সাহায্য লাভ করেছেন? বরং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া দিল্লী সফরে গিয়ে গঙ্গার পানি সমস্যার কথা বলতেই সাহস পাননি। দেশে ফিরে বলেছেন, তিনি সমস্যাটির কথা তুলতে ভুলে গিয়েছিলেন।
এদিক থেকে শেখ হাসিনার সাফল্য এই যে, অহেতুক ভারত বিদ্বেষ প্রচার না করে এবং ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের স্বার্থে কনফ্রন্টেশনের নীতি গ্রহণ না করে প্রথম দফায় মতায় বসে তিনি দিল্লীর দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে অন্তত ত্রিশ বছর মেয়াদী পানি চুক্তি করতে পেরেছেন এবং পার্বত্য অঞ্চলে রক্তয়ী যুদ্ধ বন্ধ করেছেন। এবারেও মতায় এসে তিনি ভারতের সঙ্গে দু'টি সমঝোতা ও তিনটি চুক্তি সম্পাদনে সম হয়েছেন। তাতে বাংলাদেশ না ভারত কার বেশি লাভ বা তি হয়েছে তার চুলচেরা বিচার করতে বসা হাস্যকর। দীর্ঘকাল যাবত দু'টি দেশের মধ্যে সমস্যা ও বিরোধ থাকলে এক বৈঠকেই তা শেষ হয় না। প্রথমে পারস্পরিক সন্দেহ দুর করা ও আস্থা ফিরিয়ে আনাই বড় কাজ। একবার এই দুটি কাজ হয়ে গেলে পরবতর্ীকালে অনেক দুরূহ সমস্যা সমাধানও সহজ হয়ে ওঠে। বর্তমান দিল্লী সফরে শেখ হাসিনা এই দুটি কাজ করে আসতে পেরেছেন এটাই তাঁর ঐতিহাসিক সাফল্য। অন্য কিছু নয়।
বিএনপি-জামায়াতের যেসব কুবুদ্ধিজীবী এবারের দিল্লী চুক্তি সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ট্রানজিট, নৌবন্দর ব্যবহার ইত্যাদি ব্যাপারে শেখ হাসিনা দিল্লীর সব দাবি মেনে এসেছেন; কিন্তু তালপট্টি, তিস্তার পানি বণ্টন ও টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি সম্পর্কে দিল্লীর কাছ থেকে কোন কনসেসনই আদায় করতে পারেননি বলে প্রচার চালাচ্ছেন, তারা উপকথার সেই মিথ্যাবাদী রাখাল বালক। বাংলাদেশ পাকিস্তানের স্বার্থে ও প্ররোচনায় ভারতবিরোধী ভূমিকা নিয়েছে, দীর্ঘকাল যাবত ঘোষিত এই সন্দেহটি দিল্লীর মন থেকে যদি দূর করা যায় এবং ভারত শক্তিশালী ও বিরাট প্রতিবেশী বিধায় বাংলাদেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করে ফেলবে এই ভয়টি ঢাকার মন থেকে যদি তাড়ানো যায়, তাহলে দিল্লী চুক্তির পরেও যে সমস্যাগুলোর সমাধান অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত রয়ে গেছে, সেগুলোর পর্যায়ক্রমিক সমাধানে কোন বাধাই থাকবে না।
তিস্তার পানি নিয়ে ভারত আলোচনায় রাজি হয়েছে এবং টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দিল্লী এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের তি হতে পারে, সেই আশ্বাস ভারতের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে দিয়েছেন। তালপট্টি নিয়ে তেমন কোন কথা না উঠলেও ভারতের সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশে সমস্যাটির সমাধান ঝুলে থাকলেও বর্তমান চুক্তি বাস্তবায়নে দুই দেশই আন্তরিকতা দেখালে পর্যায়ক্রমে সকল সমস্যা সমাধানেই কোন বাধা দেখা দেবে না।
এ সম্পর্কে বিএনপির কুবুদ্ধিজীবীরা কোন যুক্তি দেখাতে না পেরে ধুয়া তুলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শুধু আশ্বাস দিয়েছেন, কোন চুক্তি করেননি; সুতরাং এই আশ্বাস তিনি রা করবেন, তার নিশ্চয়তা কি? এই সন্দেহবাদীদের জিগ্যেস করতে হয়, কোন ব্যাপারে চুক্তি হলেও সব সময় তা রতি হয় তার কোন প্রমাণ সারাবিশ্বে আছে কি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে অন্তত বিশ বছর শান্তি রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটেন ও জার্মানি মিউনিখ চুক্তি করেছিল সেই চুক্তি ভঙ্গ হতে এক বছরও সময় লাগেনি। সুতরাং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্যে ঘোষিত আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন না করে যারা চুক্তিতে বিশ্বাস করেন, তাঁরা কি করে মনে করেন চুক্তি করলেই ভারত তা ভঙ্গ করতে পারবে না? কাশ্মীরে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তি ভঙ্গ হতে এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফের সংঘর্ষ শুরু হতে ক'দিন লেগেছিল?
এ েেত্র চুক্তি হওয়ার চাইতেও পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি হওয়াই বড় কথা। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি থেকে সিমলা চুক্তি এবং আরও বহু চুক্তি হয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি হয়নি, ফলে চুক্তি ভঙ্গ হতে দেরি লাগেনি এবং কাশ্মীরসহ বহু সমস্যার সমাধান হয়নি। ক্রমাগত ভারতবিরোধী রাজনীতি করে পাকিস্তান আজ যখন বিপর্যয় ও ভেঙ্গে যাওয়ার মুখে তখন তাদের কিছুটা হুঁশ হয়েছে। কাশ্মীর সমস্যাকে পাশে সরিয়ে রেখে সন্ত্রাস দমন এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ে এখন ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে পাকিস্তান এগিয়ে গেছে। তাতে কেউ বলেনি, পাকিস্তানের জারদারি সরকার ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দিয়েছে।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যদি দীর্ঘকাল বিবাদ ও তিক্ত সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা যায়, তাহলে কাশ্মীর সমস্যাসহ সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। উপমহাদেশে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বাতাস বইবে। সেজন্য চুক্তি করারও দরকার হবে না। আলোচনার বৈঠকে বসেই সব সমস্যার সমাধান করা যাবে। আর চুক্তি করেও যদি এক প আরেক পরে বিরুদ্ধে সন্দেহ ও বিদ্বেষের বিষ ছড়ায় (যে কাজটি বিএনপি-জামায়াত করছে ভারতের বিরুদ্ধে) তাহলে ওই চুক্তি দ্বারাও কোন সমস্যারই সমাধান হবে না। যে কারণে খালেদা জিয়া দু' দু'বার মতায় এসেও ভারতের সঙ্গে একটি সমস্যারও সমাধান করতে পারেনি। কেবল সমস্যার জট বাড়িয়ে দেশের সর্বনাশ করেছেন।
চীন-আমেরিকার সম্পর্কের েেত্রও আমরা দেখি, এই দুই দেশের মধ্যে বহু সমস্যার মীমাংসায় সময় লেগেছে এবং পর্যায়ক্রমে তারা সমস্যাগুলোর মীমাংসা করেছেন। নিকসন-কিসিঞ্জারের আকস্মিক বেজিং সফরেই চীন ও আমেরিকার মধ্যে সকল সমস্যার সমাধান হয়নি এবং এখনও হয়েছে তা বলা যাবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে দু'টি দেশ রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক বিরোধ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তাইপে ও ফরমোজা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে চীনের বিরোধ এখনও শেষ হয়নি। তাই বলে অন্যান্য েেত্র বিরোধ মেটাতে চীন দেরি করেনি। চীনের এই নীতিকে কেউ আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে বলে মূর্খের চিৎকার শুরু করেনি। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারেও ধীরে ধীরে জট খুলবে। অবশ্যই যদি বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর অপপ্রচার সফল না হয়।
হাসিনার একবারের দিল্লীর সফরকেই ঢাকার সঙ্গে দিল্লীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এক সফরেই হাসিনা বাংলাদেশের সকল দাবিদাওয়া আদায় করবেন, এই প্রচারণা যারা চালায় তারা হয় বিশ্ব রাজনীতির কোন খোঁজখবর রাখেন না, অথবা জেনেশুনেও মিথ্যাচার করছেন। হাসিনা এবার দিল্লীতে যে কাজটি করে এসেছেন তা সকল পাওনা আদায় করা নয়, এই পাওনা আদায়ের একটা বিশ্বাস ও আস্থার ভাব সৃষ্টি করে এসেছেন। এখন ট্রানজিট, পোর্ট ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে চুক্তির (যে চুক্তিতে শুধু ভারতের লাভ হবে না, বাংলাদেশও উপকৃত হবে) অপব্যাখ্যা দ্বারা বিএনপি-জামায়াত চক্র যদি বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক উভয় দেশের জন্যই কল্যাণকর হবে।
বর্তমান বিশ্বের কূটনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, শত্রু বলে প্রমাণিত দেশকেও কোন দেশ তার শত্রু বলে প্রচার চালায় না। আমেরিকার প্রচণ্ড শত্রুতা সত্ত্বেও কিউবা এ কাজটি কখনও করেনি; বরং মিত্র দেশের সাহায্য ও কূটনৈতিক উপায়ে এই শত্রুতা ব্যর্থ করার চেষ্টা করেছে এবং এখনও করছে। চীন ও সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধ এবং ইরান ও ইরাকের মধ্যে আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময়েও আমরা এই সত্যের প্রমাণ পেয়েছি। আধুনিক বিশ্বে কোন দেশই অপর দেশের সঙ্গে বিরোধ এবং শত্রুতার েেত্রও তাকে শত্রু বলে ঘোসণা দেয় না, বরং আপস ও ভবিষ্যত মৈত্রীর সম্ভাবনার দরোজা খোলা রাখে।
এর একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত চক্রের ভূমিকা। সেই কবে অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে হক সাহেবের জমানায় পাকিস্তানের স্বৈরচারী শাসকরা ভারত-বিদ্বেষী প্রচারণাকে তাদের একমাত্র রাজনৈতিক মূলধন করে স্থায়ীভাবে মতায় থাকার স্বার্থে দেশটির সর্বনাশ করে গেছেন, সেই ইতিহাস জানা থাকা সত্ত্বেও খালেদা-নিজামী চক্র পাকিস্তানের সেই ভারত-বিদ্বেষী রাজনীতি অর্ধশতক পরেও বাংলাদেশে চালু করে দেশটির চরম সর্বনাশ করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশকে এদের এই চেষ্টা ও চক্রান্ত থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব দেশের সচেতন মানুষ এবং দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের।
ঢাকা ২০ জানুয়ারি, বুধবার, ২০১০
No comments