সাদাকালো-পোশাক শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা ও নিরাপত্তার আশু ব্যবস্থা চাই by আহমদ রফিক
আবারও পোশাক কারখানায় আগুন। ভাবিনি তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন কয়লা হয়ে যাওয়ার পর আবারও পোশাক কারখানায় আগুনে আরো মৃত্যু ঘটবে। তাজরীনের ভয়াবহতা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে।
এর দায়বদ্ধতা নিয়ে অভিযোগের আঙুল উঠেছে কারখানার কর্মকর্তা ও মালিকদের প্রতি। উঠেছে ক্ষতিপূরণের দাবি। কিন্তু মৃত্যু কি ক্ষতিপূরণ হয়? বড়জোর টাকায় কিছুটা প্রতিদানমূলক ক্ষতিপূরণ হয়। মৃত ব্যক্তি তো ফেরে না। তার শূন্যতা পূরণ হয় না।
এত লেখালেখির পরও পোশাক কারখানার মালিকদের সচেতন হতে দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন পর পরই বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে সবচেয়ে মূল্যবান খাত পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর ঘটনা এবং সবচেয়ে বড় বিস্ময়- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বড় একটা মাথাব্যথা নেই। সমস্যার কারণ অনুসন্ধান এবং ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ নেই।
ওই যে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ প্রাণের আত্মাহুতি- তার পরও কী সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে? জানি না। তবে যতটা শুনি, তাতে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হয়তো মালিকপক্ষ তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্য নিয়েই ব্যস্ত। এ বিষয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? তাদের সদস্যভুক্ত কারখানার ভালো-মন্দ, ঘটন-অঘটন নিয়ে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে?
কিন্তু পারছে।
আসলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান এ শিল্প খাতটিতে এক ধরনের নৈরাজ্যিক অবস্থা বিরাজ করছে। মনে হয়, এর কোনো অভিভাবক নেই। কারখানাগুলো সব রকম নিয়মনীতির দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত। এই শিল্প খাতে 'কমপ্লায়েন্সি' বলে বাধ্যবাধকতার একটি শব্দ প্রচলিত আছে, তা হলো অবকাঠামো থেকে নিরাপত্তা পর্যন্ত ব্যবস্থাদির শর্তাদি যথাযথভাবে পূরণের। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের অনেক ফাঁকি, অনেক অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।
সেগুলোর তদারকিতে শৈথিল্য রয়েছে। যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি খবরাখবর নিয়ে জানা গেছে, কথিত বাধ্যবাধকতার নীতিমালা পূরণ না করায় বিজিএমইএ নাকি কয়েক শ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে। কিন্তু তাতে কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে? বরং তারা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে এরপর তাদের মর্জিমাফিক চলতে থাকবে। ওই শিল্পে 'সাবকনট্রাক্ট' নামে যে ব্যবস্থা চালু আছে, তার বদৌলতে তারা কারখানা চালিয়ে মুনাফা গুনতে থাকবে। এবং অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সুব্যবস্থার অভাবে দুর্ঘটনা ঘটবে, শ্রমিকের প্রাণ যাবে, তা নিয়ে লেখালেখি হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাময়িক প্রতিবাদের ঢেউ উঠবে; এরপর যথারীতি সব শান্ত, সব স্তব্ধ। নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত দায় পূরণের কোনো দরকার পড়বে না। এ অবস্থা কি চলতে দেওয়া যায়? যায় না। আর সে জন্যই এদের ক্ষেত্রেও পূর্বকথিত 'কমপ্লায়েন্সি' আবশ্যিক হওয়া দরকার। আর সে দায়িত্ব অনেকাংশে বিজিএমইএর। তাতে দরকার সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা।
কিন্তু আমাদের মূল প্রশ্ন শুধু ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর কারখানাগুলো নিয়ে নয়। প্রশ্ন- বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সদস্যদের মধ্যে যারা ক্রেতাদের সব শর্ত পূরণ করে রপ্তানি করে থাকে তারাও কি শ্রমিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে? যদি পারত তাহলে ওই শ্রেণীভুক্ত সেসব কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানি ঘটত না। কিন্তু ঘটছে।
এর অর্থ সোজা, সিধা। তাদের কারখানাব্যবস্থার শর্তপূরণে ঘাটতি রয়েছে, গাফিলতি আছে। তাজরীন ফ্যাশনস তার বড় প্রমাণ। কারখানা থেকে বের হওয়ার একটিমাত্র সিঁড়ি, অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থা গ্রহণেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই ইত্যাদি। উদাসীনতা কারখানা কর্তৃপক্ষের। ফলাফল ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যু। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। এ ধরনের ঘটনা এর পরও ঘটেছে, মনে হয় ঘটতেই থাকবে।
প্রমাণ দুই দিন আগে মোহাম্মদপুরে অবস্থিত 'স্মার্ট এক্সপোর্ট' নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে সাত নারী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু। আহতদের যথারীতি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংবাদপত্র কি দিনের পর দিন এসব শোকাবহ ঘটনা পরিবেশন করে চলবে। এখানেও ঘটনা তাজরীন ফ্যাশনসের মতোই। বাইরে বের হওয়ার একটিমাত্র সিঁড়ির গেট তালাবদ্ধ। কাজেই বদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু। আগুনের আলামত দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল ফটকের তালা খুলে দেওয়া। সে কাজটি সঙ্গে সঙ্গে করা হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমে অথবা মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি মেলে। তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনার পর বলা হয়েছিল বাইরে বেরোনোর বিকল্প সিঁড়ি রাখার কথা। কিন্তু কে কার কথা শোনে। মালিকদের লক্ষ্য একটাই- মুনাফা।
(দুই)
এই মুনাফাবাজি নিয়ে বিষয়ান্তরে অনেকবার লিখেছি, যদিও জানি এসব লেখায় কোনো কাজ হয় না। এরা বিশেষ করে পোশাকশিল্প খাত বাংলাদেশে এমন এক সাম্রাজ্য শক্তি গড়ে তুলেছে, যেকোনো সমালোচনা, কোনো পরামর্শ- তা প্রাণ বাঁচানোরই হোক- এদের চৈতন্যে সাড়া জাগায় না। এরা কোনো কিছুই 'কেয়ার করে না'। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে এরা এমনভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট যে মনে হয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষও এদের দাপটের কাছে অসহায়। অর্থনীতি বলে কথা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বলে কথা! তা না হলে ১১১ লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকদের এতটা নির্বিকার থাকতে দেখা যেত না।
যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো শিল্প খাতের তুলনায় পোশাকশিল্প খাতের মুনাফার হার অনেক বেশি। এ জন্য তারা অতি দ্রুত একটি থেকে দুটি, এভাবে শিল্প ইউনিট বাড়াতে পারে। উদাহরণ অনেক। অন্তত কিছুসংখ্যক চেনা উদাহরণ থেকে এ কথা বলা যায়। এ ধরনের মুনাফাবাজিতে রাশ টানার কেউ নেই। হতদরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের তরুণীদের ছাড়া অবিশ্বাস্য রকম কম বেতনে, কম সুযোগ-সুবিধায় শ্রমিক হিসেবে কাদের মিলবে?
এক সময় এদের ওপর অসভ্য রকমের অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম চলেছে এবং তা দৈহিক ও অর্থনৈতিক। দৈহিক নির্যাতনের হার কমে এলেও তা বন্ধ হয়নি। এক সময় ঝোপঝাড়ে গার্মেন্ট তরুণীর ধর্ষিত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যেত, এখন মাঝেমধ্যে চলন্ত বাস থেকে তাদের কাউকে ফেলে দেওয়া হয়, এই যা পার্থক্য। এদের সংগত দাবিদাওয়া আদায়ের সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা বা ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতাও তেমন জোরদার নয়। কলকাতার সমাজসেবী প্রয়াত অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের ভাষায় 'নীরব নারী বিপ্লব' ঘটানোর কারিগর এই তরুণীকুলের অসহায়তার তুলনা বিরল।
তরুণ এক সাংবাদিক এই স্বল্প মজুরির নারী শ্রমিকদের নিয়ে মুনাফাবাজিকে 'দাস ব্যবসার' সঙ্গে তুলনা করেছেন। একেবারে খাঁটি কথা। এটা আরো সম্ভব হয়েছে পোশাক খাতের শ্রমজীবীদের বেশির ভাগ কিশোরী ও তরুণী হওয়ার কারণে। এদের ভয়ভীতি ও অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছেন পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা, যাঁরা এদের শ্রমশক্তি শোষণ করে বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এসব নিয়ে আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই বাম রাজনীতির দল ও সংগঠনের, যারা সমাজবাদী রাজনীতি ও শ্রেণীসংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ তাদের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল।
এখন যা হচ্ছে বা যেটুকু হচ্ছে তা সরোবরে শিশিরবিন্দু। শ্রমিক নেতা বা বাম রাজনৈতিক নেতাদের বলি : একবার ঘুরে আসুন না অল্পবয়সী এই শ্রমিকদের আবাসস্থলে, তাদের জীবনযাপনের ব্যবস্থাদি দেখতে। দেখবেন কী নিদারুণ সামাজিক অসংগতি ও বৈষম্য। বড় ধরনের একটা বহুমাত্রিক জরিপ চালানো খুব কঠিন কাজ নয়, তাতেই বুঝতে পারা যাবে এসব শ্রমজীবীর দুঃখ-দুর্দশা, অর্থনৈতিক অবস্থা। তখন বোঝা যাবে 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগানের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য। শুধু স্লোগানের জন্য স্লোগান বা আনুষ্ঠানিকতায় কোনো কাজ হবে না।
এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা। দরকার পোশাক খাতের শ্রমজীবী নর-নারীদের সংগঠিত করে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামা। এ কাজ সমাজবাদী সংগঠনগুলো ছাড়া অন্য কেউ করবে না। করবে না তাদের শ্রেণীস্বার্থের কারণে। এ সত্য বাম রাজনীতিকদের চেয়ে কে আর ভালো বুঝবেন? কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে তাঁদের আগ্রহের কিছুটা অভাব।
এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যেমন তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিবিধানের দিক, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিরাপত্তাবিষয়ক ব্যবস্থাদি নিশ্চিত করার দিক। এ বিষয়ে বিজিএমইএ বা বিকেএমইএসহ সরকারের সঙ্গেও আলোচনা এবং সেসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য মালিক শ্রেণীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা। শুধু চাপ নয়, যাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে তার নিশ্চয়তা বিধান।
এ কথাটি বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছি, কিন্তু তাতে সমস্যার এক ইঞ্চি পরিমাণ সমাধানও দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে দুই দিন আগে মার্কিন কংগ্রেসের যে প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে গেল, তারাও কিন্তু পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই শ্রমিকস্বার্থের ক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনকি তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের বিষয় নিয়েও নাকি কথা বলেছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদল যুক্তিসংগত কথাই বলেছে, তবে শ্রমিকদের মজুরির নিম্নহার সম্পর্কে কিছু বলেছে কি না জানা যায়নি। তারা যা বলেছে সে কথাগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে এ দেশে বহু উচ্চারিত। কিন্তু তাতে বরফ গলেনি। কারণ এ খাতের বিত্তবান মালিকদের হাত অনেক লম্বা, প্রভাবও যথেষ্ট। তাই মুনাফার অংশবিশেষও ছাড়তে তাঁরা নারাজ, অনেকটা মাড়োয়ারিদের মক্ষিচোষা স্বভাবের মতো কারণে। কিন্তু এ দিকটাতে পরিবর্তন আনা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তন ঘটাতে হবে কয়েক হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির বিপুল মুনাফা থেকে কয়েক শতাংশ শ্রমিকের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যয় প্রসঙ্গে। চাপে না পড়লে তাঁরা কখনো এটুকু উদারতা দেখাবেন না। সে জন্যই বলছিলাম বাম রাজনীতিকদের আন্দোলনের কথা। আর যে মার্কিন প্রতিনিধিদল শ্রমিকস্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গেল, তারাও এ বিষয়ে জোরদার কোনো কথা বলেনি, পাছে তাদের ট্যারিফ সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে! গার্মেন্টশিল্পের মালিক ও সরকার এ বিষয়ে অনেকবারই কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল দেখা যায়নি। যে যার স্বার্থ খুব ভালোভাবে বোঝে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
এত লেখালেখির পরও পোশাক কারখানার মালিকদের সচেতন হতে দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন পর পরই বাংলাদেশের অর্থনীতির পক্ষে সবচেয়ে মূল্যবান খাত পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও মৃত্যুর ঘটনা এবং সবচেয়ে বড় বিস্ময়- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বড় একটা মাথাব্যথা নেই। সমস্যার কারণ অনুসন্ধান এবং ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ নেই।
ওই যে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ প্রাণের আত্মাহুতি- তার পরও কী সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়েছে? জানি না। তবে যতটা শুনি, তাতে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হয়তো মালিকপক্ষ তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের উদ্দেশ্য নিয়েই ব্যস্ত। এ বিষয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই? তাদের সদস্যভুক্ত কারখানার ভালো-মন্দ, ঘটন-অঘটন নিয়ে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে?
কিন্তু পারছে।
আসলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান এ শিল্প খাতটিতে এক ধরনের নৈরাজ্যিক অবস্থা বিরাজ করছে। মনে হয়, এর কোনো অভিভাবক নেই। কারখানাগুলো সব রকম নিয়মনীতির দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত। এই শিল্প খাতে 'কমপ্লায়েন্সি' বলে বাধ্যবাধকতার একটি শব্দ প্রচলিত আছে, তা হলো অবকাঠামো থেকে নিরাপত্তা পর্যন্ত ব্যবস্থাদির শর্তাদি যথাযথভাবে পূরণের। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের অনেক ফাঁকি, অনেক অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।
সেগুলোর তদারকিতে শৈথিল্য রয়েছে। যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি খবরাখবর নিয়ে জানা গেছে, কথিত বাধ্যবাধকতার নীতিমালা পূরণ না করায় বিজিএমইএ নাকি কয়েক শ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে। কিন্তু তাতে কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে? বরং তারা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে এরপর তাদের মর্জিমাফিক চলতে থাকবে। ওই শিল্পে 'সাবকনট্রাক্ট' নামে যে ব্যবস্থা চালু আছে, তার বদৌলতে তারা কারখানা চালিয়ে মুনাফা গুনতে থাকবে। এবং অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সুব্যবস্থার অভাবে দুর্ঘটনা ঘটবে, শ্রমিকের প্রাণ যাবে, তা নিয়ে লেখালেখি হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাময়িক প্রতিবাদের ঢেউ উঠবে; এরপর যথারীতি সব শান্ত, সব স্তব্ধ। নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত দায় পূরণের কোনো দরকার পড়বে না। এ অবস্থা কি চলতে দেওয়া যায়? যায় না। আর সে জন্যই এদের ক্ষেত্রেও পূর্বকথিত 'কমপ্লায়েন্সি' আবশ্যিক হওয়া দরকার। আর সে দায়িত্ব অনেকাংশে বিজিএমইএর। তাতে দরকার সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহযোগিতা।
কিন্তু আমাদের মূল প্রশ্ন শুধু ওই দ্বিতীয় শ্রেণীর কারখানাগুলো নিয়ে নয়। প্রশ্ন- বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক এবং বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সদস্যদের মধ্যে যারা ক্রেতাদের সব শর্ত পূরণ করে রপ্তানি করে থাকে তারাও কি শ্রমিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে? যদি পারত তাহলে ওই শ্রেণীভুক্ত সেসব কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানি ঘটত না। কিন্তু ঘটছে।
এর অর্থ সোজা, সিধা। তাদের কারখানাব্যবস্থার শর্তপূরণে ঘাটতি রয়েছে, গাফিলতি আছে। তাজরীন ফ্যাশনস তার বড় প্রমাণ। কারখানা থেকে বের হওয়ার একটিমাত্র সিঁড়ি, অগ্নি নির্বাপণব্যবস্থা গ্রহণেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই ইত্যাদি। উদাসীনতা কারখানা কর্তৃপক্ষের। ফলাফল ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যু। এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। এ ধরনের ঘটনা এর পরও ঘটেছে, মনে হয় ঘটতেই থাকবে।
প্রমাণ দুই দিন আগে মোহাম্মদপুরে অবস্থিত 'স্মার্ট এক্সপোর্ট' নামের একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে সাত নারী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু। আহতদের যথারীতি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সংবাদপত্র কি দিনের পর দিন এসব শোকাবহ ঘটনা পরিবেশন করে চলবে। এখানেও ঘটনা তাজরীন ফ্যাশনসের মতোই। বাইরে বের হওয়ার একটিমাত্র সিঁড়ির গেট তালাবদ্ধ। কাজেই বদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু। আগুনের আলামত দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল ফটকের তালা খুলে দেওয়া। সে কাজটি সঙ্গে সঙ্গে করা হলে মৃত্যুর সংখ্যা কমে অথবা মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি মেলে। তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনার পর বলা হয়েছিল বাইরে বেরোনোর বিকল্প সিঁড়ি রাখার কথা। কিন্তু কে কার কথা শোনে। মালিকদের লক্ষ্য একটাই- মুনাফা।
(দুই)
এই মুনাফাবাজি নিয়ে বিষয়ান্তরে অনেকবার লিখেছি, যদিও জানি এসব লেখায় কোনো কাজ হয় না। এরা বিশেষ করে পোশাকশিল্প খাত বাংলাদেশে এমন এক সাম্রাজ্য শক্তি গড়ে তুলেছে, যেকোনো সমালোচনা, কোনো পরামর্শ- তা প্রাণ বাঁচানোরই হোক- এদের চৈতন্যে সাড়া জাগায় না। এরা কোনো কিছুই 'কেয়ার করে না'। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে এরা এমনভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট যে মনে হয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষও এদের দাপটের কাছে অসহায়। অর্থনীতি বলে কথা, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বলে কথা! তা না হলে ১১১ লাশের ওপর দাঁড়িয়ে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকদের এতটা নির্বিকার থাকতে দেখা যেত না।
যত দূর জানা যায়, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো শিল্প খাতের তুলনায় পোশাকশিল্প খাতের মুনাফার হার অনেক বেশি। এ জন্য তারা অতি দ্রুত একটি থেকে দুটি, এভাবে শিল্প ইউনিট বাড়াতে পারে। উদাহরণ অনেক। অন্তত কিছুসংখ্যক চেনা উদাহরণ থেকে এ কথা বলা যায়। এ ধরনের মুনাফাবাজিতে রাশ টানার কেউ নেই। হতদরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের তরুণীদের ছাড়া অবিশ্বাস্য রকম কম বেতনে, কম সুযোগ-সুবিধায় শ্রমিক হিসেবে কাদের মিলবে?
এক সময় এদের ওপর অসভ্য রকমের অন্যায়-অত্যাচার-জুলুম চলেছে এবং তা দৈহিক ও অর্থনৈতিক। দৈহিক নির্যাতনের হার কমে এলেও তা বন্ধ হয়নি। এক সময় ঝোপঝাড়ে গার্মেন্ট তরুণীর ধর্ষিত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যেত, এখন মাঝেমধ্যে চলন্ত বাস থেকে তাদের কাউকে ফেলে দেওয়া হয়, এই যা পার্থক্য। এদের সংগত দাবিদাওয়া আদায়ের সংঘবদ্ধ ব্যবস্থা বা ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতাও তেমন জোরদার নয়। কলকাতার সমাজসেবী প্রয়াত অধ্যাপক শান্তিময় রায়ের ভাষায় 'নীরব নারী বিপ্লব' ঘটানোর কারিগর এই তরুণীকুলের অসহায়তার তুলনা বিরল।
তরুণ এক সাংবাদিক এই স্বল্প মজুরির নারী শ্রমিকদের নিয়ে মুনাফাবাজিকে 'দাস ব্যবসার' সঙ্গে তুলনা করেছেন। একেবারে খাঁটি কথা। এটা আরো সম্ভব হয়েছে পোশাক খাতের শ্রমজীবীদের বেশির ভাগ কিশোরী ও তরুণী হওয়ার কারণে। এদের ভয়ভীতি ও অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছেন পোশাকশিল্প কারখানার মালিকরা, যাঁরা এদের শ্রমশক্তি শোষণ করে বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। এসব নিয়ে আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই বাম রাজনীতির দল ও সংগঠনের, যারা সমাজবাদী রাজনীতি ও শ্রেণীসংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ তাদের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল।
এখন যা হচ্ছে বা যেটুকু হচ্ছে তা সরোবরে শিশিরবিন্দু। শ্রমিক নেতা বা বাম রাজনৈতিক নেতাদের বলি : একবার ঘুরে আসুন না অল্পবয়সী এই শ্রমিকদের আবাসস্থলে, তাদের জীবনযাপনের ব্যবস্থাদি দেখতে। দেখবেন কী নিদারুণ সামাজিক অসংগতি ও বৈষম্য। বড় ধরনের একটা বহুমাত্রিক জরিপ চালানো খুব কঠিন কাজ নয়, তাতেই বুঝতে পারা যাবে এসব শ্রমজীবীর দুঃখ-দুর্দশা, অর্থনৈতিক অবস্থা। তখন বোঝা যাবে 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' স্লোগানের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য। শুধু স্লোগানের জন্য স্লোগান বা আনুষ্ঠানিকতায় কোনো কাজ হবে না।
এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন কার্যকর ব্যবস্থা। দরকার পোশাক খাতের শ্রমজীবী নর-নারীদের সংগঠিত করে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামা। এ কাজ সমাজবাদী সংগঠনগুলো ছাড়া অন্য কেউ করবে না। করবে না তাদের শ্রেণীস্বার্থের কারণে। এ সত্য বাম রাজনীতিকদের চেয়ে কে আর ভালো বুঝবেন? কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে তাঁদের আগ্রহের কিছুটা অভাব।
এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য যেমন তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিবিধানের দিক, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো পোশাকশিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিক নিরাপত্তাবিষয়ক ব্যবস্থাদি নিশ্চিত করার দিক। এ বিষয়ে বিজিএমইএ বা বিকেএমইএসহ সরকারের সঙ্গেও আলোচনা এবং সেসব ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য মালিক শ্রেণীর ওপর চাপ প্রয়োগ করা। শুধু চাপ নয়, যাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে তার নিশ্চয়তা বিধান।
এ কথাটি বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছি, কিন্তু তাতে সমস্যার এক ইঞ্চি পরিমাণ সমাধানও দেখা যায়নি। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে দুই দিন আগে মার্কিন কংগ্রেসের যে প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে গেল, তারাও কিন্তু পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এসব ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই শ্রমিকস্বার্থের ক্ষেত্রে উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে। এমনকি তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের বিষয় নিয়েও নাকি কথা বলেছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদল যুক্তিসংগত কথাই বলেছে, তবে শ্রমিকদের মজুরির নিম্নহার সম্পর্কে কিছু বলেছে কি না জানা যায়নি। তারা যা বলেছে সে কথাগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে এ দেশে বহু উচ্চারিত। কিন্তু তাতে বরফ গলেনি। কারণ এ খাতের বিত্তবান মালিকদের হাত অনেক লম্বা, প্রভাবও যথেষ্ট। তাই মুনাফার অংশবিশেষও ছাড়তে তাঁরা নারাজ, অনেকটা মাড়োয়ারিদের মক্ষিচোষা স্বভাবের মতো কারণে। কিন্তু এ দিকটাতে পরিবর্তন আনা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবর্তন ঘটাতে হবে কয়েক হাজার কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির বিপুল মুনাফা থেকে কয়েক শতাংশ শ্রমিকের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ব্যয় প্রসঙ্গে। চাপে না পড়লে তাঁরা কখনো এটুকু উদারতা দেখাবেন না। সে জন্যই বলছিলাম বাম রাজনীতিকদের আন্দোলনের কথা। আর যে মার্কিন প্রতিনিধিদল শ্রমিকস্বার্থ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গেল, তারাও এ বিষয়ে জোরদার কোনো কথা বলেনি, পাছে তাদের ট্যারিফ সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে! গার্মেন্টশিল্পের মালিক ও সরকার এ বিষয়ে অনেকবারই কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল দেখা যায়নি। যে যার স্বার্থ খুব ভালোভাবে বোঝে।
লেখক : কবি, গবেষক ও কলাম লেখক
No comments