চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে > নানা কারসাজি- * কৃষক থেকে মিলার পর্যায়ে চলছে মজুদদারি- * বিলম্বে ফলনের আশঙ্কা কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি- * স্থানীয় পর্যায়ে মারোয়াড়িরাওফাঁদ পেতেছে- * লৰ্যমাত্রার চেয়ে মাঠে উপাদন কম by মিজান চৌধুরী
বোরোর বিলম্বিত ফলন আর আমন কম উৎপাদনের সুযোগে কৃষক থেকে মিলার সর্বত্র মজুদ হচ্ছে চাল। মিলাররা সীমাহীন ব্যাংক ঋণ নিয়ে সবের্াচ্চ এক লাখ বসত্মা পর্যনত্ম চাল মজুদ করছেন।
ওইসব মজুদদারি কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগ হয়েছেন মারোয়াড়িরাও। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সীমানত্ম এলাকায় অনেক মারোয়াড়ি ধান মজুদ করে বেশি দামে বিক্রি করছে। ফলে হাট ও বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় সব ধরনের চালের মূল্য বেড়েছে। জনকণ্ঠের নিজস্ব অনুসন্ধানে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।চালের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি, ল্যমাত্রার চেয়ে রোপার উৎপাদন কম হওয়া, বোরোর বীজতলা নষ্ট হওয়ায় বিলম্বে ফসল ওঠার আশঙ্কা থেকে মাঠ পর্যায়ে মজুদ প্রবণতা, বড় বড় মিল মালিকের ইচ্ছেমতো মূল্য বৃদ্ধি ও মজুদ, বাণিজ্যিকভাবে চাল আমদানি না হওয়া, সীমাহীন ব্যাংক ঋণ ইত্যাদি কারণে মজুদ প্রবণতা বাড়ছে। মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথা স্বীকার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। বুধবার সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, চালের মূল্য সম্প্রতি বেড়েছে। এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে।
টিসিবির তথ্য মতে, বেশি বেড়েছে সরম্ন ও মাঝারি চালের দাম। সরম্ন চাল সর্বোচ্চ ৪৪ টাকা ও মাঝারি চাল ৩৭ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ২৮ টাকা দরে। এক মাসের ব্যবধানে সরম্ন চালের মূল্য ৬.৫৮ শতাংশ ও মাঝারি চাল ৯.৩৮ শতাংশ বেড়েছে ।
মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোপা আমন উৎপাদন কম হয়েছে। ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ২৭ লাখ মেট্রিক টন আমন উৎপাদনের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের চিত্র হচ্ছে ল্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কম হয়েছে। এরপর আসে বোরো মৌসুম। সারাদেশে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বীজ রোপণ করা হয়। কিনত্মু দীর্ঘ ঘন কুয়াশা ও অবিরাম শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনেক বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে ১শ' টাকার বীজ গাছ ৭শ' টাকায় উঠেছে। অনেক কৃষক ধানের চেয়ে আগাম মুনাফার আশায় তে থেকে বীজ তুলে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই বিপর্যয়ের কারণে আগামীতে বোরো ফলন যথাসময়ে না হয়ে দেরিতে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকার এ বছর ৪৯ লাখ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৯০ হাজার মেট্রিক টন বোরো উৎপাদনের ল্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের হিসাব মতে, আমন উৎপাদন কম হয়েছে। পাশাপাশি বিলম্বে বোরো ফলনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে বেশি দাম পাওয়ার আশায় কৃষক পর্যায়ে ধান বিক্রি করছে না। মিল মালিকরা চাল মজুদ করছে। যে কারণে বাজারে পর্যাপ্ত ধান চালের সরবরাহ হ্রাস পেয়ে দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার আব্দুর রশিদ কোম্পানি, ডলফিন কোম্পানি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনারচাবি, এরফান কোম্পানি, নওগাঁর মিলস্নাত, দিনাজপুরে উৎসব এসব চাল কাছে প্রচুর চাল মজুদ রয়েছে। কৃষক থেকে ধান কিনে সবের্াচ্চ এক লাখ বসত্মা পর্যনত্ম ধান-চাল মজুদ করার খবর পাওয়া গেছে। ওসব ব্যবসায়ী কম দামে ক্রয় করে ইচ্ছেমতো চালের মূল্য নির্ধারণ করে বাজারজাত করছে। এসব কোম্পানিকে নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক সীমাহীন ঋণ সুবিধা প্রদান করছে। ব্যাংকগুলো তাদের অলস মানি কাজে লাগানোর জন্য চালকলমালিকদের ঋণ দেয়ার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে চালকল মালিকদের আর্থিক অসুবিধা হয় না। ব্যাংক থেকে তারা ১৩ শতাংশ হারে সুদে ঋণ পেয়ে থাকে। ধান চাল মজুদ করে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যনত্ম মুনাফা করছে। ব্যাংক সুদ বাদেও চাল কল মালিকদের মুনাফা থাকছে ২০ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি পাঠানো কৃষি ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে কৃষি ব্যাংক। যার মধ্যে ৫ কোটি টাকা গেছে চাল ব্যবসায়ীদের হাতে। শুধু কৃষি ব্যাংক নয়, অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংক থেকেও আনলিমিটেড ঋণ নিয়ে ধান-চাল মজুদ করছে মিল মালিকরা।
এদিকে সীমানত্ম এলাকায় স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পাশর্্ববর্তী দেশের মারোয়াড়িরা ধান মজুদের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। কৃষক পর্যায়ে ওইসব মারোয়াড়ি মণে সাড়ে চার শ' টাকায় রোপা-আমন কিনে মজুদ করেছে। ওই ধান এখন সাড়ে সাত শ' টাকা মণ বিক্রি করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় সীমানত্ম এলাকায় পার্শ্ববর্তী দেশের মারোয়াড়িদের মজুদ ব্যবসা বেশি রয়েছে। এই মজুদের প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে। আগামীতে ইরি নিয়ে আশঙ্কার কথা বলে নওগাঁ ধান-চাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি নীরোদ সাহা জনকণ্ঠকে জানান, বোরো আবাদ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ মাঠ পর্যায়ে কম হয়েছে। কুয়াশা ও শৈতপ্রবাহের কারণে বোরো ফসল আসতে দেরি হবে। বোরোর চারার দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অনেক কৃষক তে থেকে বেশি দামের আশায় চারা বিক্রি করে দিচ্ছে। সামনে বোরো নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। এই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে কিছু ব্যবসায়ী। চালের সঙ্কট হতে পারে এমন আশঙ্কায় কিছু কিছু মজুদ হচ্ছে। ফলে চালের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। শেরপুরের সারোয়ার চালকল মালিক দিলীপ সাহা টেলিফোনে জনকণ্ঠকে জানান, আমন ধান না থাকায় কেনা যাচ্ছে না। বাজারে এক ধরনের মন্দা বিরাজ করছে। ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে চালের মূল্যও বাড়ছে। কৃষ্টিয়ার স্বর্ণা রাইস এজেন্সির মালিক আব্দুস সামাদ টেলিফোনে জনকণ্ঠকে জানান, বৈশাখ মাসে উঠবে নতুন চাল। এ সময় পুরনো চালের ওপর নির্ভরতা থাকায় অনেকটা দাম বৃদ্ধি পায়। তাঁর মতে বাজারে সরবরাহ ঠিক আছে। কিনত্মু এরপরও দাম বাড়ার পেছনে কিছুটা দায়ী করেন অটোমোশন পদ্ধতিকে। তিনি বলেন, এই পদ্ধতি ব্যবহার করে চাল মালিকরা কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যনত্ম বেশি দাম নির্ধারণ করে থাকে। ঢাকার মিরপুর বড় বাজারের বাবা রাইস এজেন্সির মালিক হাজী মোঃ আবু হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, বড় মিল মালিকরা প্রচুর ধান মজুদ করেছে। ব্যাংক ঋণ সুবিধা পেয়ে তারা এসব মজুদ করে মূল্য বাড়াচ্ছে। এদিকে সরকারের নজর দেয়া দরকার।
এদিকে সরকারের প থেকে বলা হচ্ছে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আগামীতে খাদ্য নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। খাদ্য বিভাগের সচিব বিডি মিত্র জনকণ্ঠকে জানান, এই মুহূর্তে সরকারের হাতে ৯ লাখ ১৬ হাজার ৬০৬ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ৮ লাখ ৩ হাজার ৫৮ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ১৩ হাজার ৫৪৫ মেট্রিক টন গম রয়েছে। সরকার ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির জন্য দরপত্র আহবান করেছে। সরকার টু সরকার পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য রাশিয়া ও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আগামী ২৪ থেকে ২৮ ফেব্রম্নয়ারির মধ্যে রাশিয়া ও ডবিস্নউএফও থেকে আনা ৬৬ হাজার মেট্রিক টন গম দুটি চালানে বন্দরে এসে পেঁৗছবে। আগামী দেড় মাসের মধ্যে আরও তিন লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন গম আনা হবে। ফলে খাদ্য নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। সরকার বাফার স্টক গড়ে তুলতে আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। খাদ্যের কোন সঙ্কট নেই।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. উত্তম কুমার দেব জনকণ্ঠকে জানান, বোরো ধান বৈশাখে আসবে। এ সময় পুরনো চাল ব্যবহার করা হয়। আনত্মর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকার কারণে গত সাত মাসে বাণিজ্যিকভাবে কোন চাল আমদানি হয়নি। এ কারণে চালের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
No comments