পাইপলাইনে ৬০ হাজার কোটি- দাতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু ছাড় করা হয়নি ॥ স্বাধীনতার পর থেকে জমে আছে এই বিপুল অর্থ by জাফর আহমেদ
উন্নয়ন সহযোগী দেশ এবং দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুত সহায়তার প্রায় ৮শ' ৬৬ কোটি মার্কিন ডলার বা ৬০ হাজার কোটি টাকা এখনও ছাড় করাতে পারেনি বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যনত্ম দাতারা দেশের নানা রকম উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার মধ্যে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দাতারা ছাড় করেনি বা পাইপলাইনে আটকে রয়েছে। ইআরডি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।সংশিস্নষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাসত্মবায়ন সমস্যা, প্রাতিষ্ঠানিক সমতা ও প্রশিতি জনবলের অভাব, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি এবং দেশে বড়মাপের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অভাবে বার বার প্রকল্প পিছিয়ে পড়ছে। আর প্রকল্প পিছিয়ে যাওয়ার কারণেই দাতাদের প্রতিশ্রম্নত অর্থ ছাড়ে বিলম্ব করে। পর্যায়ক্রমে এসব অর্থ পাইপলাইনে চলে যায়। তবে দাতাদের শর্ত প্রকল্প বাসত্মবায়ন বা অর্থ ছাড়ে কোন সমস্যা নয় বলে মনে করেন তাঁরা।
দাতা সংস্থাগুলোর মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সমতার অভাবে বাসত্মবায়নে দুর্বলতার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের েেত্র বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি এবং টেন্ডারিং এবং রিটেন্ডারিংয়ে দলবাজির কারণে প্রকল্প পিছিয়ে পড়ে। আর এ কারণেই মূলত পাইপলাইনে অর্থ জমে যায়। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিশ্রম্নত অর্থ ইচ্ছা করলে প্রকল্প বাসত্মবায়নের মাধ্যমে যে কোন মুহূর্তে ছাড় করতে পারে।
সূত্র জানায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সর্বশেষ ২০০৮ সাল পর্যনত্ম সকল দাতাদেশ এবং সংস্থা খাদ্য, অনুদান এবং ঋণ সহায়তা মিলে মোট ৫ হাজার ৯শ' ৩ কোটি ডলার বা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রম্নতি প্রদান করে। এর মধ্যে খাদ্য এবং অনুদান ছিল ২ হাজার ৪শ' ৮৯ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার। আর বাকি ৩ হাজার ৪শ' ১৪ কোটি ডলার ছিল প্রকল্প সহায়তার প্রতিশ্রম্নতি।
সূত্র জানায়, ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যনত্ম দাতারা সবকিছু মিলে মোট ৪ হাজার ৮শ' ৫২ কোটি ২০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের কাছে ছাড় করেছে। বাকি ৮শ' ৫৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড় করেনি। এর সঙ্গে গত এক বছরের প্রায় আরও দশ কোটি ডলার যোগ হবে বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। সে হিসেবে এখন দাতারা মোট প্রায় ৮শ' ৬৬ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা দাতাদের কাছে রয়ে গেছে।
জানা যায়, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে দাতারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশকে উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে প্রকল্প সহায়তার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে থাকে। এসব প্রতিশ্রম্নতির সময় দাতারা সময় এবং কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। যেমন, তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করতে হবে। আবার প্রকল্পের ৪০ বা ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারলে প্রথম কিসত্মির অর্থ ছাড় করা হবে। এভাবে প্রকল্প শেষ হওয়ার পরেই সমুদয় প্রতিশ্রম্নত অর্থ ছাড় করতে হয়। কিনত্মু বাংলাদেশে প্রকল্প বাসত্মবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সমতা, দ জনবল, রাজনৈতিক দলাদলি এবং বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাসত্মবায়নে বিশ্বমানের যন্ত্রপাতির অভাবে প্রকল্প সময়মতো সম্পন্ন করতে পারে না বিধায় প্রকল্প পিছিয়ে যায়। আর দাতাদের শর্ত এবং যথাসময়ের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করতে না পারার কারণে অর্থ ছাড়ে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। এভাবেই প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা পাইপলাইনে আটকে পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানত বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাসত্মবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সমতা খুবই সীমিত। তাঁর মতে, যে কোন সরকার দেশে বড় কোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করলে দাতারা তার অর্থ যোগান দিচ্ছে। কিনত্মু প্রকল্পটি বাসত্মবায়নের জন্য যত সমতাসম্পন্ন ঠিকাদারি কোম্পানি প্রয়োজন তা এখনও গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, এছাড়াও দেশে দ জনশক্তির অভাব রয়েছে। তাঁর মতে, এ দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনে দাতারা বিদু্যত এবং আইটি খাতের প্রকল্পেও অর্থায়ন করে থাকে। কিনত্মু এ দেশে এ বিষয়ক যথেষ্ট দ জনশক্তি না থাকার ফলে যথাসময়ে প্রকল্প বাসত্মবায়ন করতে পারে না।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোচ্য সমস্যা ছাড়াও আরও কয়েকটি সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। তাঁর মতে, অনেক সময় দাতা সংস্থাগুলো কোন প্রকল্প বাসত্মবায়নে দতা বৃদ্ধির জন্য ইআরডি বা সংশিস্নষ্ট খাতের কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিণের ব্যবস্থা করে থাকে। কিনত্মু দাতাদের বা মন্ত্রণালয়ের বাছাই তালিকা থেকে যে বাদ যায় পরবর্তীতে সেই কর্মকর্তা ওই প্রকল্পে নানাভাবে অসহযোগিতা করে। এছাড়াও দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ছাড় করার জন্য ফাইল চালাচালির সময়ও নানা রকম সমস্যায় ফেলে বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি করা, প্রশিণের অভাবসহ আরও বেশ কয়েকটি কারণে প্রকল্প পিছিয়ে যায়। আর প্রকল্প পিছিয়ে গেলেই সহায়তার অর্থ পাইপলাইনে চলে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশিস্নষ্ট অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূঁইয়া জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের বাসত্মবায়ন সমস্যাই দাতাদের অর্থ ছাড়ে বিলম্ব বা পর্যায়ক্রমে পাইপলাইনে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সুশীল সমাজে বলাবলি হয়ে থাকে যে, দাতাদের শর্তের কারণে প্রকল্প বাসত্মবায়নে সমস্যা হয়, আসলে তা নয়। তাঁর মতে, আমাদের বাসত্মবায়ন সমস্যার কারণেই প্রকল্প বাসত্মবায়ন পিছিয়ে যায়। আর প্রকল্প বাসত্মবায়ন পিছিয়ে গেলেই প্রকল্পের অর্থও পিছিয়ে যায়। তবে এখন আগের চেয়ে সমতা অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আগের বছর আমরা মাত্র ২৩ হাজার কোটি টাকার সংশোধিত এডিপির শতভাগ বাসত্মবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু চলতি বছর অনেক বড় এডিপি গ্রহণ করার পরও বাসত্মবায়ন হার বেড়েছে। তা ছাড়া বর্তমানে যে ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো প্রতিশ্রম্নত অর্থ পাইপলাইনে জমা হয়ে আছে তা গত কয়েক বছরের প্রতিশ্রম্নত অর্থ। সংশিস্নষ্ট প্রকল্পগুলো শেষ হওয়ার পরই এসব অর্থ ছাড় করা হলে পাইপলাইনে অর্থের পরিমাণ কমে আসবে।
এ সময় তিনি আরও বলেন, পাইপলাইনে অর্থ জমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, সময়মতো প্রকল্প বাসত্মবায়ন করতে না পারা। এজন্য তিনি দ জনশক্তির অভাব, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, দ ঠিকাদার এবং পুনর্দরপত্রের কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও দেশে অনেক দ বা বিশ্বমানের ঠিকাদার না থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, এসব সমস্যা দূর করতে পারলে আগামীতে পাইপলাইনে বেশি অর্থ জমা পড়বে না।
ইআরডির মহাপরিচালক মামুদা বেগম বলেন, আসলে পাইপলাইনে খুব বেশি অর্থ জমা নেই। তাঁর মতে, গত কয়েক বছরের অর্থ এখনও জমা রয়েছে বলে এর পরিমাণ বেশি দেখাচ্ছে। প্রকল্পগুলো শেষ হয়ে গেলে অর্থের পরিমাণও কমে আসবে। এছাড়া সবার মতো তিনিও দেশে প্রকল্প বাসত্মবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সমতা বাড়ানোর ওপর গুরম্নত্বারোপ করেন।
No comments