রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল উন্নয়ন প্রকল্পে অনিশ্চয়তা- লোকদেখানো কাজ করে সাত কোটি টাকার বিল উত্তোলন! by আরিফুল হক
রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কাজ শুরুর এক বছর পর হঠাৎ প্রকল্পটি সিটি করপোরেশন থেকে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগে (এলজিইডি) হস্তান্তর করায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামাসুন্দরী খালের পুরোটা খনন, খালের পাড় সংরক্ষণ ও সেতু নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু লোকদেখানো কাজ করে পাঁচ ঠিকাদার ইতিমধ্যে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।শহরের ভেতর প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহী খালটি খনন করা হয় ১৮৯০ সালে। সে সময় কলেরা, মহামারিসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে জনগণকে মুক্ত রাখতে রাজা জানকী বল্লভ সেন খালটি তাঁর মা শ্যামাসুন্দরীর নামে খনন করেন।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, খালটির উন্নয়নে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ২২ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে খালের পাড় সংরক্ষণ বাবদ সাড়ে ১৬ কোটি ও খাল খননে এক কোটি ৪১ লাখ টাকা এবং খালের ওপর নতুন করে তিনটি সেতু নির্মাণ ও একটি সেতু সংস্কার বাবদ চার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২২ কোটির মধ্যে নয় কোটি ৯৫ লাখ টাকা প্রকল্প খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ দেওয়ার কথা।
খালের পাড় সংরক্ষণকাজে চার ঠিকাদারের মধ্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বিভাগের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খানের ছোট ভাই শামীম খান রয়েছেন। অন্য তিনজন হলেন: সার্দুল হোসেন, শফিকুল ইসলাম ও রাজা মিয়া। এ ছাড়া খাল খননের ঠিকাদার হলেন এমদাদুল হোসেন ও সেতু নির্মাণের ঠিকাদার হলেন খায়রুল কবির।
সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন জানান, ছয় ঠিকাদারের মধ্যে সেতু নির্মাণের ঠিকাদার ছাড়া বাকি পাঁচজনকে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, খালের পূর্ব-উত্তর দিকে শহরের সিও বাজার এলাকায় মাত্র এক হাজার ফুট খালের পাড় সংরক্ষণের কাজ হয়েছে। ১২ কিলোমিটার খাল খনন করে দুই পাড়ে সিমেন্টের স্পার বসানোর কথা; সেখানে স্পার বসানো হয়েছে মাত্র এক হাজার ফুটে। দরপত্র অনুযায়ী কাজটি আগামী জুনের মধ্যে শেষ করতে হবে। পুরো খালের কোথাও কোনো কাজ দেখা যায়নি।
ঠিকাদার শামীম খান বলেন, ‘খালের দুই পাড়ের জন্য স্পার নির্মাণ করেছি অন্য স্থানে। কিন্তু খালের পাড়ে তা বসানোর কাজ এখনো হয়নি।’
জানা যায়, সরফুদ্দীন আহমেদ নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এ প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জানতে পেরেছি, এ প্রকল্পের কাজে অনিয়ম রয়েছে। আমি শপথ না নেওয়া পর্যন্ত এ কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে ২০ জানুয়ারি প্রকল্পের সব কাগজসহ তহবিলে থাকা তিন কোটি ১০ লাখ টাকা এলজিইডিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনা জানাজানি হলে, সরফুদ্দীন আহমেদ ২১ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে আবু আলম মো. শহিদ খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন। সরফুদ্দীন বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ না করে ঠিকাদারদের টাকা দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগ পাওয়ার পর গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে সরেজমিনে কাজের এলাকা পরিদর্শন করি। সেখানে দেখতে পাই, কোনো কাজ হয়নি। এ জন্য কাজ বন্ধ রাখতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিই। সে অনুযায়ী কাজ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার পর সচিব পুরো প্রকল্পটি এলজিইডিতে হস্তান্তর করেন, এটি ষড়যন্ত্রমূলক।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে আবু আলম মো. শহিদ খান প্রথম আলোকে জানান, প্রকল্পটি হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে দুই মাস আগে। সিটি করপোরেশনের কাছে থাকায় নির্মাণকাজের অগ্রগতি হচ্ছিল না। কাজটি চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ করতে হবে। আর তা না করতে পারলে টাকা ফেরত যাবে। তাই প্রকল্পটি হস্তান্তর করা হয়।
No comments