বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু কথা, কিছু ভাবনা
এস এম তারিকুল ইসলাম, নাজিয়া জাবিন, মো. শরিফুল ইসলাম, খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম, আসিফ আল মতিন, মো. জসিম উদ্দিন, মো. আল-হেলাল, মো. নজরুল ইসলাম, সিফাত রুমানা, মো. সদরুল ইসলাম সরকার
একটি গ্লাসের অর্ধেক পানি, গ্লাসের এমন স্ট্যাটাস নেতিবাচকদের দৃষ্টিতে গ্লাসটি অর্ধেক খালি এবং ইতিবাচকদের দৃষ্টিতে অর্ধেক পানিপূর্ণ। কিন্তু গ্লাসটি অর্ধেক খালি- ইতিবাচক দৃষ্টিধারীরা এ কথা অস্বীকার করবেন না; বরং খালি অংশটুকু পূরণ করার লক্ষ্যে ইতিবাচক প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাবেন। 'গ্লাসটি অর্ধেক পূর্ণ বা অর্ধেক খালি'- কথা দুটি একই বাস্তবতা প্রকাশ করলেও উভয় পক্ষ সহজ সত্যকে পাশ কাটিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে দাঁড়িয়ে ইতি ও নেতির দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, এমনটি আজকাল প্রায়শই দেখা যাচ্ছে। ইতিবাচক দৃষ্টিধারীরা দ্রুত উন্নয়নশীল এই বাংলাদেশে ইদানীং নেতিবাদীদের সংখ্যাই বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। সম্পদের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সদিচ্ছা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার আমাদের আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে সহায়ক হতে পারে। এটা জেনেও আমাদের ইতিবাচক ইচ্ছাশক্তিটাকে নানা অজুহাতে দমিয়ে রেখে, উল্টো সদিচ্ছা যতটুকু আছে তা ধ্বংসের প্রয়াসে আজ আমরা লিপ্ত হয়েছি। সত্যিকার অর্থে, আজ আমরা নিজেরা নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নই। অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতেই সবাই সিদ্ধহস্ত। অন্যের উন্নতি দেখে চোখ রাঙানো আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য নয়, সবাই দলবদ্ধ হচ্ছে অন্যকে হেনস্তা করার জন্য; আর তাতেই যেন চরম আনন্দ।
দুর্নীতির সংজ্ঞাটাও আজ যেন আপেক্ষিক। একজনের দৃষ্টিতে অন্যজন দুর্নীতিবাজ। কেননা ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক, একজনের দাবি অন্যজন বাস্তবায়ন করেনি। দুর্নীতির প্যারামিটারগুলো মনে হয় তার প্রকৃত অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে, সবাই নিজের মতো করে দুর্নীতি সম্পর্কে ভেবে নেয়। ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ এক সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। আজ কারো সফলতা দেখলেই আমরা তার অনিয়ম বা তার চাচা-মামার যোগসাজশ আছে কি না তা খোঁজা শুরু করি। এবং ধরে নিই, অনিয়মের মাধ্যমেই সে সফল হয়েছে। মেধাশক্তি, পরিশ্রম, যোগ্যতাবলে যে সে সফল হতে পারে, আমরা তা ভাবনায় আনি না। আজকাল সবাই সফল হওয়ার পন্থা খোঁজে, পরিশ্রমবিমুখ হয়ে গেছি আমরা। নিজেদের প্রচেষ্টা চালানোর শক্তিটাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের কারণে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। ক্লাসরত অবস্থায় তাদের ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে রণক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। তারা শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল করে কখনো গোষ্ঠীগত, কখনো ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতে চায়। তারা যদি সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করত, তবে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হতো। ব্যক্তি পর্যায়ে দলাদলি করে সুবিধা আদায়ে তারা সচেতন। সচেতন শিক্ষক সমাজের ব্যানারে তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। যার মাধ্যমে তারা শিক্ষক সমাজকে কলুষিত করছে। বিভিন্ন পদের প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টির কাছে শিক্ষার্থীদের সাধারণ চাহিদা এখন ধূসরপ্রায়। সুবিধা করতে না পেরে তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে এক দফার আন্দোলনে নেমেছে। এই চরিত্রের লোকদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এদের জন্য আমরা রংপুর অঞ্চলের লোকেরা আজ অবহেলিত। অনুন্নত আমাদের এই জনপদ। এদের কারণেই আমরা একাত্তরে হারিয়েছি অসংখ্য স্বাধীনতাকামী জীবন।
আমরা শিক্ষক। আমাদের চিন্তাভাবনা সর্বদা শিক্ষাকেন্দ্রিক। ছাত্রছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। আজ যাদের ক্লাসে কম পাওয়া যায়, যাদের কারণে শিক্ষার্থীরা সেমিস্টারের জট পার করছে, তারাই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ তারা এখন ক্ষমতাসীন হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা আজ আমাদের দেশে এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীরা আজ তুরুপের তাস। আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের মূল চালিকাশক্তি তো এক ধরনের ছাত্র। মুক্তচিন্তা ও আদর্শ নিয়ে যেখানে ছাত্রদের বেড়ে ওঠার কথা, তা নয়; তাদের মতাদর্শে তারা ছাত্রদের পরিচালিত হতে চাপ প্রয়োগ করছে। তাদের মাথায় সেই বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কথায় কথায় শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ছাত্রদের এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাদের 'গডফাদার' কিছু শিক্ষক। ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁয়তারায় তারা আজ সংঘবদ্ধ। এক ধরনের ছাত্র সংগঠনের সহায়তায় শিক্ষক হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের এই দেশে ঘটেছে। আর তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে এক শ্রেণীর শিক্ষকই। তারা আজ কুরাজনীতির চর্চা করছে। ব্যবহার করছে সরলমতি শিক্ষার্থীদের। প্রশাসনকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াসে তারা বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মদদদাতা হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় নিয়ে কুরাজনীতির বিষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঢেলে দিতে তারা পটু। তাদের কানমন্ত্রে আজ শিক্ষার্থীরা দিশেহারা। তাদের অন্তর ও বাহির বদলে যায় ঘন ঘন। স্বার্থ হাসিলের জন্য বদলায়, স্বার্থ হাসিল হলে বদলায়, মৌসুমে মৌসুমে বদলায়। দশকে দশকে আরো বেশি পরিবর্তন ঘটে। তাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ একেবারে অন্য রকম হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে দ্বিধা করে না। বদলানোর জন্য তাদের প্রয়োজন একটি মাত্র উপলক্ষ। ভণ্ডামি করতে, ভাঁড়ামি করতে, স্বার্থ আদায় করতে তারা চায় একটি উপলক্ষ, তা স্বকৃতও হতে পারে। আমরা চাই না শিক্ষাঙ্গনকে সেই উল্টো ধারার দিকে চিরদিনের জন্য ঠেলে দিতে। আমরা চাই স্থিতিশীল একটি শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিক্ষা সমুন্নত করবে জীবন।
লেখকবৃন্দ : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক
দুর্নীতির সংজ্ঞাটাও আজ যেন আপেক্ষিক। একজনের দৃষ্টিতে অন্যজন দুর্নীতিবাজ। কেননা ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক, একজনের দাবি অন্যজন বাস্তবায়ন করেনি। দুর্নীতির প্যারামিটারগুলো মনে হয় তার প্রকৃত অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে, সবাই নিজের মতো করে দুর্নীতি সম্পর্কে ভেবে নেয়। ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ এক সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। আজ কারো সফলতা দেখলেই আমরা তার অনিয়ম বা তার চাচা-মামার যোগসাজশ আছে কি না তা খোঁজা শুরু করি। এবং ধরে নিই, অনিয়মের মাধ্যমেই সে সফল হয়েছে। মেধাশক্তি, পরিশ্রম, যোগ্যতাবলে যে সে সফল হতে পারে, আমরা তা ভাবনায় আনি না। আজকাল সবাই সফল হওয়ার পন্থা খোঁজে, পরিশ্রমবিমুখ হয়ে গেছি আমরা। নিজেদের প্রচেষ্টা চালানোর শক্তিটাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের কারণে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। ক্লাসরত অবস্থায় তাদের ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে রণক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। তারা শিক্ষাঙ্গন অস্থিতিশীল করে কখনো গোষ্ঠীগত, কখনো ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতে চায়। তারা যদি সার্বিক মঙ্গলের কথা চিন্তা করত, তবে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হতো। ব্যক্তি পর্যায়ে দলাদলি করে সুবিধা আদায়ে তারা সচেতন। সচেতন শিক্ষক সমাজের ব্যানারে তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। যার মাধ্যমে তারা শিক্ষক সমাজকে কলুষিত করছে। বিভিন্ন পদের প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টির কাছে শিক্ষার্থীদের সাধারণ চাহিদা এখন ধূসরপ্রায়। সুবিধা করতে না পেরে তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে এক দফার আন্দোলনে নেমেছে। এই চরিত্রের লোকদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এদের জন্য আমরা রংপুর অঞ্চলের লোকেরা আজ অবহেলিত। অনুন্নত আমাদের এই জনপদ। এদের কারণেই আমরা একাত্তরে হারিয়েছি অসংখ্য স্বাধীনতাকামী জীবন।
আমরা শিক্ষক। আমাদের চিন্তাভাবনা সর্বদা শিক্ষাকেন্দ্রিক। ছাত্রছাত্রীদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। আজ যাদের ক্লাসে কম পাওয়া যায়, যাদের কারণে শিক্ষার্থীরা সেমিস্টারের জট পার করছে, তারাই শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কারণ তারা এখন ক্ষমতাসীন হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে। অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা আজ আমাদের দেশে এক রীতিতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীরা আজ তুরুপের তাস। আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক দলের মূল চালিকাশক্তি তো এক ধরনের ছাত্র। মুক্তচিন্তা ও আদর্শ নিয়ে যেখানে ছাত্রদের বেড়ে ওঠার কথা, তা নয়; তাদের মতাদর্শে তারা ছাত্রদের পরিচালিত হতে চাপ প্রয়োগ করছে। তাদের মাথায় সেই বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কথায় কথায় শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা ছাত্রদের এক ধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাদের 'গডফাদার' কিছু শিক্ষক। ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁয়তারায় তারা আজ সংঘবদ্ধ। এক ধরনের ছাত্র সংগঠনের সহায়তায় শিক্ষক হত্যার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের এই দেশে ঘটেছে। আর তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে এক শ্রেণীর শিক্ষকই। তারা আজ কুরাজনীতির চর্চা করছে। ব্যবহার করছে সরলমতি শিক্ষার্থীদের। প্রশাসনকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াসে তারা বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মদদদাতা হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় নিয়ে কুরাজনীতির বিষ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঢেলে দিতে তারা পটু। তাদের কানমন্ত্রে আজ শিক্ষার্থীরা দিশেহারা। তাদের অন্তর ও বাহির বদলে যায় ঘন ঘন। স্বার্থ হাসিলের জন্য বদলায়, স্বার্থ হাসিল হলে বদলায়, মৌসুমে মৌসুমে বদলায়। দশকে দশকে আরো বেশি পরিবর্তন ঘটে। তাদের স্বভাব-চরিত্র ও আচরণ একেবারে অন্য রকম হয়ে যায়। প্রয়োজন হলে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে দ্বিধা করে না। বদলানোর জন্য তাদের প্রয়োজন একটি মাত্র উপলক্ষ। ভণ্ডামি করতে, ভাঁড়ামি করতে, স্বার্থ আদায় করতে তারা চায় একটি উপলক্ষ, তা স্বকৃতও হতে পারে। আমরা চাই না শিক্ষাঙ্গনকে সেই উল্টো ধারার দিকে চিরদিনের জন্য ঠেলে দিতে। আমরা চাই স্থিতিশীল একটি শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিক্ষা সমুন্নত করবে জীবন।
লেখকবৃন্দ : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের তরুণ শিক্ষক
No comments