নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম- ট্রেনচালকের ওপর ঝাল মেটানো কেন? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
বড় অন্যায় করেছেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান! প্রথম আলোতে ‘আত্মঘাতী ছাত্রলীগের লাগাম টেনে ধরুন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। লেখাটি পড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন তাঁরা।
সমাবেশ শেষে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক উপাচার্য আবদুল মান্নানকে। এমনকি তাঁর সিন্ডিকেট সদস্যপদ বাতিল করার দাবিও উঠেছে সংবাদ সম্মেলনে। ছাত্রলীগের ‘ঐক্যবদ্ধ’ নেতারা ঘোষণা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো কোন্দল নেই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে অদ্ভুত একটি পঙিক্ত লিখেছিলেন: ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ পঙিক্তটি একসময় দুর্বোধ্য মনে হতো, এখন হয় না। এখন চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মধ্যেই এই বাক্যটির সারমর্ম ও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
ছাত্রলীগের দাবির অসারতা প্রমাণ করার জন্য কোনো যুক্তিতর্ক বা তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করার প্রয়োজন পড়েনি। ‘কোন্দল নেই’—ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে অন্তত চারজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে ছাত্রলীগ প্রমাণ করছে, অধ্যাপক মান্নানের লেখাটি কল্পকাহিনি ছিল না। মাত্র এক দিন আগে যে নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ‘কোনো কোন্দল নেই’, তাঁরাই এবার অন্য সুরে কথা বলতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদ এই হামলার ঘটনায় দায়ী করেছেন সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি মামুনুল হকের অনুসারীদের। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করতে সভাপতির অনুসারীরা আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে।’ পাঠক, বক্তব্যের বিষয়টি লক্ষ করুন। সহসভাপতি বলছেন, সভাপতির অনুসারীরা হামলা করেছে ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর’। অর্থাৎ, আমাদের নেতা-কর্মী ও তাঁদের নেতা-কর্মী যে আলাদা দুটি উপদল, এটি স্বীকার করতে তাঁদের আপত্তি নেই। তাহলে অধ্যাপক মান্নানকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো কেন?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা-সহিংসতার ব্যাপারটি শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে আমাদের বলার কিছু ছিল না (কে কার গোয়ালে ধোঁয়া দেয়)। কারণ, অধ্যাপক মান্নানের বিরুদ্ধে এই নেতা-কর্মীরা যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তাৎক্ষণিক ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন, তাতে বাকিরাও এই বার্তা পেয়েছেন যে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যতই দ্বিধাবিভক্তি থাকুক না কেন, কেউ উপদেশ-পরামর্শ দিতে এলে তাঁরা ‘ঐক্যবদ্ধ’ হয়ে বিষোদ্গার করবেন ও প্রয়োজনীয় ‘ব্যবস্থা’ নেবেন।
কিন্তু নিজেদের মধ্যে মারামারি-হানাহানির পর এই নেতা-কর্মীরা যখন হামলা চালান রেলস্টেশনে, জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করেন, তখন বলার থাকে। গত ২৫ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা ৫০ বার হামলা চালিয়েছে রেলস্টেশনে, অপহরণ করেছে অন্তত ১০০ জন ট্রেনচালককে (লোকোমাস্টার)। এসব চালককে মারধরও করা হয়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, নানা সময়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরাও এই দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত।
এ কথা সবাই জানেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শাটল ট্রেননির্ভর। শত শত শিক্ষার্থী এই ট্রেনে শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করেন প্রতিদিন। এ কারণে ছাত্রসংগঠনগুলো (মূলত ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির) তাঁদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যবস্তু বানায় শাটল ট্রেনকে।
সর্বশেষ ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের কারণে আবার হামলা হয়েছে শাটল ট্রেনে, চালককে অপহরণ করা হয়েছে। শুধু অপহরণ নয়, পরদিন মারধরও করা হয়েছে তাঁকে। এ রকম বিনা দোষে দিনের পর দিন আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আর কোনো স্থানে, আর কোনো পেশায় আছে কি না জানি না। অবিবেচক ছাত্রকর্মীদের কেউ কি ভাবেন না, এই লোকোমাস্টারদেরও সন্তান-সন্ততি আছে, তাঁদের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়!
শাটল ট্রেনের চালকদের কারও দাঁত ভেঙে ফেলেছেন ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা, কারও বা চোখ গুরুতর জখম হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবং রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে বিভিন্ন সময় সমঝোতা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সেসব বৈঠকের কোনোটিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম একটি বৈঠকে চালকেরা দাবি করেছিলেন, শাটল ট্রেন চলার সময় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কোনো রেলকর্মী নিহত হলে ছয় লাখ টাকা, পঙ্গু ও গুরুতর আহত হলে চার লাখ টাকা এবং আহত হলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পরও না তারা দাবি পূরণ করেছে, না চালকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এবং রেলস্টেশনে হামলা, চালকদের অপহরণ ও পেটানোর ঘটনা ছাত্রসংগঠনের নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
অধ্যাপক আবদুল মান্নানের নিবন্ধ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এ লেখায় অধ্যাপক মান্নান ষাটের দশকে ছাত্রলীগের গৌরবময় কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেছেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বদান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে স্বাধীন দেশে বীরের মতো ফিরে আসা ছাত্রলীগের নেতাদের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যাঁরা ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন কে কোথায় আছেন, তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বর্তমান ছাত্রলীগের নেতাদের মতো দুর্বৃত্তপনার অভিযোগ শোনা যায়নি। এই মূল্যায়ন আমলে নিয়ে যদি বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতেন, দলের গৌরবময় অতীতকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করতেন, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। যথারীতি তাঁরা সমালোচককে শত্রু ভেবেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন, তাঁর সিন্ডিকেট সদস্যপদ বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। অবশ্য এতে তিনি খুব বিচলিত বা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে মনে হয় না, বরং তিনি ক্যাম্পাসে না গেলে যদি ছাত্রলীগের ‘ঐক্য’ অটুট থাকে, আর কোনো ট্রেনচালক আক্রান্ত না হন, রেলস্টেশন ভাঙচুরের হাত থেকে রক্ষা পায়, তাহলে আমাদের সবারই খুশি হওয়ার কথা।
ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের ফলে সৃষ্ট সংঘর্ষের ঘটনায় নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধের পর অন্তঃকোন্দল মিটে যাবে—এই গ্যারান্টি দেবে কে?
তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়ার সুযোগ পান, তাঁদের দুর্ভোগ দেখে সত্যি মন খারাপ হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মেধাবীরা আসেন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে, তাঁদের অভিভাবকদের জন্য করুণা হয়। এই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্গতির কারণ হয়ে ছাত্রলীগ কী ধরনের সাফল্য অর্জন করতে চায়?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে অদ্ভুত একটি পঙিক্ত লিখেছিলেন: ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ পঙিক্তটি একসময় দুর্বোধ্য মনে হতো, এখন হয় না। এখন চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মধ্যেই এই বাক্যটির সারমর্ম ও ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়।
ছাত্রলীগের দাবির অসারতা প্রমাণ করার জন্য কোনো যুক্তিতর্ক বা তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করার প্রয়োজন পড়েনি। ‘কোন্দল নেই’—ঘোষণার মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে অন্তত চারজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে ছাত্রলীগ প্রমাণ করছে, অধ্যাপক মান্নানের লেখাটি কল্পকাহিনি ছিল না। মাত্র এক দিন আগে যে নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ‘কোনো কোন্দল নেই’, তাঁরাই এবার অন্য সুরে কথা বলতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবুল মনসুর আহমদ এই হামলার ঘটনায় দায়ী করেছেন সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি মামুনুল হকের অনুসারীদের। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করতে সভাপতির অনুসারীরা আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করে।’ পাঠক, বক্তব্যের বিষয়টি লক্ষ করুন। সহসভাপতি বলছেন, সভাপতির অনুসারীরা হামলা করেছে ‘আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর’। অর্থাৎ, আমাদের নেতা-কর্মী ও তাঁদের নেতা-কর্মী যে আলাদা দুটি উপদল, এটি স্বীকার করতে তাঁদের আপত্তি নেই। তাহলে অধ্যাপক মান্নানকে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো কেন?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হামলা-সহিংসতার ব্যাপারটি শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে আমাদের বলার কিছু ছিল না (কে কার গোয়ালে ধোঁয়া দেয়)। কারণ, অধ্যাপক মান্নানের বিরুদ্ধে এই নেতা-কর্মীরা যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং তাৎক্ষণিক ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন, তাতে বাকিরাও এই বার্তা পেয়েছেন যে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যতই দ্বিধাবিভক্তি থাকুক না কেন, কেউ উপদেশ-পরামর্শ দিতে এলে তাঁরা ‘ঐক্যবদ্ধ’ হয়ে বিষোদ্গার করবেন ও প্রয়োজনীয় ‘ব্যবস্থা’ নেবেন।
কিন্তু নিজেদের মধ্যে মারামারি-হানাহানির পর এই নেতা-কর্মীরা যখন হামলা চালান রেলস্টেশনে, জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন করেন, তখন বলার থাকে। গত ২৫ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা ৫০ বার হামলা চালিয়েছে রেলস্টেশনে, অপহরণ করেছে অন্তত ১০০ জন ট্রেনচালককে (লোকোমাস্টার)। এসব চালককে মারধরও করা হয়েছে। শুধু ছাত্রলীগ নয়, নানা সময়ে ছাত্রশিবিরের কর্মীরাও এই দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত।
এ কথা সবাই জানেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা শাটল ট্রেননির্ভর। শত শত শিক্ষার্থী এই ট্রেনে শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করেন প্রতিদিন। এ কারণে ছাত্রসংগঠনগুলো (মূলত ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির) তাঁদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যবস্তু বানায় শাটল ট্রেনকে।
সর্বশেষ ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের কারণে আবার হামলা হয়েছে শাটল ট্রেনে, চালককে অপহরণ করা হয়েছে। শুধু অপহরণ নয়, পরদিন মারধরও করা হয়েছে তাঁকে। এ রকম বিনা দোষে দিনের পর দিন আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা আর কোনো স্থানে, আর কোনো পেশায় আছে কি না জানি না। অবিবেচক ছাত্রকর্মীদের কেউ কি ভাবেন না, এই লোকোমাস্টারদেরও সন্তান-সন্ততি আছে, তাঁদের সন্তানেরাও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়!
শাটল ট্রেনের চালকদের কারও দাঁত ভেঙে ফেলেছেন ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা, কারও বা চোখ গুরুতর জখম হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এবং রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে বিভিন্ন সময় সমঝোতা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সেসব বৈঠকের কোনোটিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম একটি বৈঠকে চালকেরা দাবি করেছিলেন, শাটল ট্রেন চলার সময় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কোনো রেলকর্মী নিহত হলে ছয় লাখ টাকা, পঙ্গু ও গুরুতর আহত হলে চার লাখ টাকা এবং আহত হলে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এত বছর পরও না তারা দাবি পূরণ করেছে, না চালকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এবং রেলস্টেশনে হামলা, চালকদের অপহরণ ও পেটানোর ঘটনা ছাত্রসংগঠনের নিয়মিত কর্মসূচির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
অধ্যাপক আবদুল মান্নানের নিবন্ধ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এ লেখায় অধ্যাপক মান্নান ষাটের দশকে ছাত্রলীগের গৌরবময় কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেছেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বদান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে স্বাধীন দেশে বীরের মতো ফিরে আসা ছাত্রলীগের নেতাদের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। এমনকি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে যাঁরা ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা এখন কে কোথায় আছেন, তার সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বর্তমান ছাত্রলীগের নেতাদের মতো দুর্বৃত্তপনার অভিযোগ শোনা যায়নি। এই মূল্যায়ন আমলে নিয়ে যদি বর্তমান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতেন, দলের গৌরবময় অতীতকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করতেন, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। যথারীতি তাঁরা সমালোচককে শত্রু ভেবেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবদুল মান্নানকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছেন, তাঁর সিন্ডিকেট সদস্যপদ বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতারা। অবশ্য এতে তিনি খুব বিচলিত বা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে মনে হয় না, বরং তিনি ক্যাম্পাসে না গেলে যদি ছাত্রলীগের ‘ঐক্য’ অটুট থাকে, আর কোনো ট্রেনচালক আক্রান্ত না হন, রেলস্টেশন ভাঙচুরের হাত থেকে রক্ষা পায়, তাহলে আমাদের সবারই খুশি হওয়ার কথা।
ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের ফলে সৃষ্ট সংঘর্ষের ঘটনায় নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধের পর অন্তঃকোন্দল মিটে যাবে—এই গ্যারান্টি দেবে কে?
তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়ার সুযোগ পান, তাঁদের দুর্ভোগ দেখে সত্যি মন খারাপ হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই মেধাবীরা আসেন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে, তাঁদের অভিভাবকদের জন্য করুণা হয়। এই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্গতির কারণ হয়ে ছাত্রলীগ কী ধরনের সাফল্য অর্জন করতে চায়?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments