নৌ নিরাপত্তা-নিমজ্জিত মেহেরজান এবং কিছু ভাসমান প্রশ্ন by শেখ রোকন

মেহেরজান নিমজ্জনের সরল অঙ্কে যোগ-বিয়োগ করে হাতে থাকে পরিবেশ বিপর্যয়। সাড়ে সাতশ' টন পেট্রোলিয়াম যদি মেঘনার মোহনায় ছড়িয়ে পড়ে, এর ভয়াবহতা কল্পনা করাও কঠিন। ভাটিতে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে তেল। তাতে করে মৎস্যসম্পদ, এর বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বহুদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে।


অনেকে জানেন আমাদের 'জলের রূপালি শস্য' ইলিশ ওই পথেই সাগর থেকে নদীতে ঢোকে ডিম ছাড়ার জন্য, ওই এলাকাতেই বিচরণ করে জাটকা পরিণত হয় ইলিশে


মেহেরজানের কথা মনে আছে? দর্শক-পরিবেশকের তোপের মুখে পতন হওয়া সেই ঢাকাই চলচ্চিত্র নয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বাঙালি তরুণীর উদ্ভট প্রেমের কাহিনী ফাঁদা হয়েছিল; মেঘনায় নিমজ্জিত অয়েল ট্যাঙ্কার এমটি মেহেরজানের কথা বলছি। ট্যাঙ্কারটির উদ্ধার অভিযান 'স্থগিত' হয়েছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবি্লউটিএ) তখন জানিয়েছিল যে সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতি, স্রোত অনুকূল হলে এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর হলে 'অপারেশন মেহের' ফের শুরু হবে।
তারও আগে, আমাদের মনে আছে_ জুলাইয়ের ২৫ তারিখ রাতে মেঘনার কালীগঞ্জ-গোবিন্দপুর পয়েন্টে এমভি ফজলুল হক-৩ নামে কার্গো ভেসেলের সঙ্গে সংঘর্ষে ডুবে গিয়েছিল মাদার ট্যাঙ্কারটি। পরের কয়েক দিন দফায় দফায় সংবাদমাধ্যমে এসেছে মেহেরজান উদ্ধারের রুটিনমাফিক কাহিনী। যাত্রীবাহী লঞ্চ বা ট্রলার দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষের টনক নড়াতে ভাগ্যহত কিছু লাশের ছবি, স্বজনের আহাজারি সহকারে যেসব মর্মস্পর্শী সংবাদকাহিনী প্রকাশ হতে থাকে, এ ক্ষেত্রে তার দরকার পড়েনি। সংঘর্ষের পর এমভি ফজলুল হক গা ঢাকা দিয়েছিল। অয়েল ট্যাঙ্কারের জনৈক স্টাফও নিখোঁজ ছিলেন। সেটাতে কর্মরত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জনকে উদ্ধার করেছে আশপাশে থাকা জেলে নৌকাগুলো। বাকিজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি। কমবেশি সাড়ে সাতশ' টন ডিজেল ও পেট্রোল এবং বৃহৎ নৌযানটির বহুমূল্যের কাছে বেচারার জীবন-মৃত্যু হয়তো তুচ্ছই হয়ে গিয়েছিল।
রুটিন মেনে অন্যান্যবারের মতো এ ক্ষেত্রেও আমাদের উদ্ধারকারী জাহাজ হামযা ও রুস্তম স্পটে হাজির হয়েছিল। হাজির হয়েছিল বিআইডবি্লউটিএর জাহাজ সন্ধানী। ডুবে যাওয়ার পর ভরা মেঘনায় ভরা কটালের প্রবল ঘূর্ণি ও স্রোতে মেহেরজান কোথায় চলে গেছে, সেটা শনাক্ত করতেই দুই-তিন দিন চলে গিয়েছিল। ট্যাঙ্কারে রশি বেঁধে রেখে সেটাকে একদিকে নজরে রাখা হয়েছিল, অন্যদিকে চলছিল উদ্ধার অভিযানের জোগারযন্ত্র। নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক ব্যর্থতার পর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নৌবাহিনীর উদ্ধার জাহাজ বিএনএস সৈকত। শুরু হয়েছিল ৭২ ঘণ্টার যৌথ অভিযান 'অপারেশন মেহের'। লাভ হয়নি। প্রবল স্রোত, এক-দেড়শ' ফুট গভীরতা, ট্যাঙ্কারে জমে যাওয়া পলির বাধা পেরিয়ে অভিযান সফল করা কঠিনই ছিল। ছিল আবহাওয়ার বৈরিতা। টেলিভিশনে দেখা গেছে, বিআইডবি্লউটিএ কিংবা নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা অভিযান নিয়ে কথা বলছিলেন উত্তাল মেঘনায় দুলন্ত নৌযানে দাঁড়িয়ে। আকাশজুড়ে ছিল মেঘ আর বৃষ্টির ঘনঘটা। ডুবুরিরা বলেছেন, ট্যাঙ্কার ও জাহাজের আশপাশে জমে যাওয়া মাছ ধরার জালের কথা। মেঘনা এফোঁড়-ওফোঁড় করে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা ধরনের জাল পাতা থাকে। বিপুল বপুর ট্যাঙ্কারের নির্বিচার ভাটিয়ালি যাত্রায়, উদ্ধার জাহাজের তড়িঘড়ি যাতায়াতে সেগুলো সঙ্গী হয়েছিল। বিপদের সঙ্গী নয়, বিপত্তির কারণ। সংশ্লিষ্টদের ঈদ উদযাপনের প্রশ্নটিও হয়তো সঙ্গোপনে ছিল। ফলে অভিযান স্থগিত হয়েছিল সঙ্গত কারণেই।
এখন, প্রাকৃতি-অপ্রাকৃতিক এসব বাধা_ উত্তাল নদী, গোমড়া আকাশ, পলি, মেছো জাল_ না থাকলেই কি এমটি মেহেরজানকে তীরে ভেড়ানো সম্ভব ছিল? বৃষ্টিমুখর ঈদের পর গত কয়েক দিনে আকাশে মিঠেকড়া রোদ দেখা যাচ্ছে। নদীও অপেক্ষাকৃত শান্ত। স্থগিত অভিযান শুরু হচ্ছে না কেন? যারা খোঁজখবর রাখেন তারা জানেন, এ স্থগিতাবস্থা অনির্দিষ্টকালের। হয়তো কখনোই শুরু হবে না। কারণ সিম্পল। সরল অঙ্কের ব্যাপার।
আমাদের উদ্ধারকারী জাহাজ হামযা ও রুস্তমের সম্মিলিত উত্তোলন ক্ষমতা ১২০ টন। ওদিকে নিমজ্জিত ট্যাঙ্কারের ওজনই ২০০ থেকে ২৫০ টন। ডিজেল ও পেট্রোল রয়েছে ৭৫০ টন। ট্যাঙ্কারের ফাঁক-ফোকরে জমা পানি ও পলির ওজনও ধরতে হবে। সব মিলিয়ে মেঘনার মতো বিশাল ও প্রবল নদী দূরে থাক, শান্ত হাওরেও যদি এমটি মেহেরজান ডুব দিত, সেটাকে তুলে আনার ক্ষমতা হামযা-রুস্তম ভ্রাতৃদ্বয়ের ছিল না। একটা কৌশল নেওয়া হয়েছিল ট্যাঙ্কারটিকে বেঁধে তীরের দিকে নিয়ে আসা, তারপর তেল ও জল আলাদা করে উদ্ধার করা। হাজার টনের বেশি একটি বোঝা প্রবল স্রোতের মধ্য দিয়ে টেনে আনার মতো রশি কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাও প্রশ্ন বটে। তারপরও আমরা ধরে নিতে পারি, বিআইডবি্লউটিএ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড মিলে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছে আন্তরিকতা থেকেই। যে আন্তরিকতায় মুমূর্ষু রোগীর শেষ সময়েও ডাক্তার নানা ইনজেকশন দিয়ে নিঃশ্বাস ধরে রাখার চেষ্টা চালায়। নিষ্ফল জেনেও যেভাবে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। সব বিবেচনায় অপারেশন মেহেরজান সংশ্লিষ্টদের সাধুবাদ জানানোই বোধহয় কর্তব্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, কর্তব্য সারলেই কি সব শেষ হয়ে যায়? কর্তব্যের পর কহতব্য অনেক কিছু কি থাকে না? অগোছালো আন্তরিকতাই কি শেষ কথা? আমাদের নদীতে সাঁতার কাটতে আসা মেহেরজানের ভাগ্যে কি সলিলসমাধিই লেখা ছিল? জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের হত্যাভাগ্য এক নাগরিকের খোঁজখবর না-ই মিলতে পারে। মানি, প্রতিদিন অনেক খবর আসে কাগজের পাতা ভরে; তারপরও কি জীবনপাতার অনেক খবর অগোচরে রয়ে যায় না! জনপ্রিয় বাংলা গায়ক তো সে কথাই ইথারে ভাসিয়ে দিচ্ছেন! নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানের খরচের কথাও থাকুক। অভিযানের সব তরীই যে দ্বীপের দেখা পায় না_ এ আর নতুন কী! সাড়ে সাতশ' টন ডিজেল ও পেট্রোলের দাম কত! সেও না হয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি যমুনার পকেট থেকে গেল। সরকার কি মাল দরিয়া মে ঢাল_এমন বাক্য যে দেশে প্রবাদে পরিণত হয়, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির দুর্ঘটনায় পতিত তেলের মূল্য নিয়ে মাথা ঘামানো হয়তো বৃথাই। যতদূর জানা গেছে, ট্যাঙ্কারটি ছিল বেসরকারি মালিকানায়। মালিকপক্ষ যদিও হয়রানির ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে আছে, তাদের লোকসান বোধহয় তেল বহনের ভাড়াটুকুই। কারণ এ ধরনের বৃহৎ নৌযানের বীমা করানো থাকে। ট্যাঙ্কারটি যে দুর্ঘটনায় পড়ে ডুবে গেছে, বীমা কোম্পানিকে সে ব্যাপারে রাজি করাতে বেগ পেতে হবে না চার আনার। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, সংবাদপত্রের কাটিং, টেলিভিশনের ফুটেজ তো আছেই! নৌবিধি লঙ্ঘন করে তারা রাতে কেন বড় ট্যাঙ্কারটি ব্যস্ত নদীপথ দিয়ে চালাচ্ছিল, সে নিয়েও হয়তো মালিকপক্ষকে খুব বেশি জবাবদিহি করতে হবে না। সবাই তো করে! এমভি ফজলুল হক-৩ কি একইভাবে অনুমতি ছাড়া রাতে নদীপথ পাড়ি দিচ্ছিল না?
এটা ঠিক, মেহেরজানডুবির মধ্য দিয়ে নৌ নিরাপত্তার আরেকটি বড় ফোকর আমাদের সামনে মুখব্যাদান করে থাকল। যে বিপুল পরিমাণ ত্রুক্রড ও রিফাইনড পেট্রোলিয়াম আমরা সাগরপথে আমদানি করি; চট্টগ্রাম থেকে তার সিংহভাগই পরিবহন হয় নদীপথে। এমটি মেহেরজানের মতো অয়েল ট্যাঙ্কারে করেই। অথচ এমন ভারী নৌযান নিমজ্জিত হলে তা টেনে তোলার ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ নেই! বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে আশা করা যায়, মেহেরজান ট্র্যাজেডির পর কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে। খোদা না খাস্তা, আরেকটি ট্যাঙ্কারডুবির সময় আমরা সেটাকে পাশেই পাব।
সব মিলিয়ে মেহেরজান নিমজ্জনের সরল অঙ্কে যোগ-বিয়োগ করে হাতে থাকে পরিবেশ বিপর্যয়। সাড়ে সাতশ' টন পেট্রোলিয়াম যদি মেঘনার মোহনায় ছড়িয়ে পড়ে, এর ভয়াবহতা কল্পনা করাও কঠিন। ভাটিতে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে তেল। তাতে করে মৎস্যসম্পদ, এর বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র বহুদিনের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে। অনেকে জানেন আমাদের 'জলের রূপালি শস্য' ইলিশ ওই পথেই সাগর থেকে নদীতে ঢোকে ডিম ছাড়ার জন্য, ওই এলাকাতেই বিচরণ করে জাটকা পরিণত হয় ইলিশে। মেঘনার বুকে ও দুই তীরে যে উদ্ভিজ সম্পদ হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে, তাতেও ধাক্কা দেবে ভাসমান ডিজেল ও পেট্রোল। মাছ ফুরালে, পানি দূষিত হলে বক, পানকৌড়ি, অঞ্জনা, গাঙচিলদের কী হবে? কী হবে শুশুক, ডলফিন, ঘড়িয়াল, কচ্ছপ, কুমিরদের? শামুক-ঝিনুকের? তেল ভাসতে ভাসতে সুন্দরবনে যে যাবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? তখন বিপদ চারগুণ হয়ে দেখা দেবে। জলজ ও বনজ সম্পদনির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবিকা কি বিপন্ন হবে না? জোয়ার ও ভাটায় ভর করে তেল যখন নদীর চর ও দুই পারের লোকালয়ে পেঁৗছবে, তখন জনস্বাস্থ্যও পড়বে হুমকির মুখে। মেহেরজান উদ্ধার স্থগিত করে হাত-পা গুটিয়ে রেখে আর যাই হোক, পার পাওয়া যাবে না।
স্থানীয় জেলেরা যদিও মেহেরজান নিমজ্জনের পরপরই ওই এলাকায় তেলের বুদ্বুদ দেখেছে, পরে প্রমাণ হয়েছে যে সেটা ইঞ্জিনের তেল। কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ট্যাঙ্কারের তেল এখনও লিক করেনি। পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রশ্নটি তখনই আসবে। কিন্তু প্রবল স্রোত, জোয়ার-ভাটায় পলির ধাক্কা ও এক-দেড়শ' ফুট পানির ভয়ানক চাপে ট্যাঙ্কারটি কতদিন অটুট থাকবে? যদি লিকেজ হয়েই পড়ে, তেলের আগ্রাসন থেকে পরিবেশ বাঁচানোর পরিকল্পনা কি কর্তৃপক্ষ করে রেখেছে? নাকি তেল ভাসলে তখন দেখা যাবে?

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.