প্রাপ্তির গৌরব ও হারানোর বেদনা by শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। আর সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। দেশের বিভিন্ন সংকটকালে ভেসে ওঠেন জাগতিককালের অবয়ব নিয়ে কিছু ব্যক্তি। সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জি ছিলেন তেমনই একজন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি আমার বাবা। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বন্ধু ও পথপ্রদর্শক।


এখন তার অনুপস্থিতি আমার প্রতিটি অসহায় মুহূর্তের নীরব সাক্ষী। আজ বাবার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।
সুনীল ব্যানার্জি স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তার সোনালি সময়ে তিনি দেশমাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর বিসিএস পাস করেও ক্যাডার সার্ভিসে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কেন নিয়েছিলেন? বাবা মনে করতেন, মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি হয় না। মানুষকে সারাজীবনই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। তিনি পুলিশ হতে পারতেন। সে ক্ষেত্রেও হয়তো সমাজের জন্য কিছু করতে পারতেন। তিনি সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছিলেন। কারণ এটাও তো যুদ্ধই। অস্ত্রের বদলে সাংবাদিকের হাতে থাকে কলম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক আর সাপ্তাহিকে প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত লিখেছেন কলাম।
১৯৪৭ সালের ২০ এপ্রিল সাতক্ষীরা শহরের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুনীল ব্যানার্জি। ১৯৭২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। দীর্ঘ কয়েক দশকের সাংবাদিকতা পেশায় তিনি দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক বাংলা এবং জনকণ্ঠে কাজ করেছেন। দেশের অবহেলিত জনপদ ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্টের আলোকে সুনীল ব্যানার্জি নামটি পাঠক মহলে হয়ে ওঠে পরিচিত। তার ছিল এলএলবি ডিগ্রি। সুতরাং ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে তার দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একাধারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির আজীবন সদস্য ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কার্যনির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য।
আমাদের দেশে বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। আমার বাবাকে আনুষ্ঠানিকভাবে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্মরণ করা হবে; সে দুরাশা আমি করি না। কিন্তু জানি, তাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, তার লেখনী যারা দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন সুনীল ব্যানার্জিকে। বিদেশে লেখক-কবিদের বাড়ি সংরক্ষণ করা হয় সরকারি উদ্যোগে। আমাদের এখানেও নেতা-নেত্রীদের নামে কত কিছু করা হয়! যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, দলীয় লোকের নামে সড়ক ও স্থাপনা করা হয়। দেশের বরেণ্য লেখক-সাংবাদিকদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই কেন? সরকার কি পারে না, নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকদের স্মৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগী হতে?
ব্যক্তিগতভাবে এ আমার গৌরব যে, সুনীল ব্যানার্জি আমার বাবা। আবার তাকে হারানোর বেদনাও আমি বহন করে চলছি। পদে পদে যখন ঠেকে যাই, তখন বাবার কথা মনে পড়ে। ২০০৬ সালের পর থেকে প্রতিটি ২৮ আগস্ট এলে প্রার্থনা করি, তার উদ্যম ও উদারতা সঞ্চারিত হোক সবার জীবনে। আমার নিজের জীবনে তো বটেই।

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ : প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জির ছেলে
jsb.shuvo@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.