চালচিত্র-সেতুর যুদ্ধ ও জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা by শুভ রহমান
পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নেই করা হবে, প্রধানমন্ত্রীর এ চূড়ান্ত ঘোষণায় জাতি একদিকে যেমন আশান্বিত, তেমনি আবার সচেতন মহলের মনে নানা যৌক্তিক প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। অনেকেই এর পূর্বশর্ত হিসেবে বিরোধী দলকে নিয়ে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।
তার পরও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে শুধু আবেগতাড়িত না হয়ে বাস্তবতাকে হিসাবে নিয়েই নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু গড়ার সম্ভাবনাকে অবশ্যই বাস্তবে রূপায়িত করতে হবে। পদ্মা নদীর সেতু গড়ার এ যুদ্ধে জাতিকে জিততেই হবে। দেশের এটা হবে বৃহত্তম সেতু। পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ। খরচ হবে ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। কী করে আসবে এত টাকা! প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়েছেন প্রবাসীরা। সাড়া দিয়েছেন গ্রামের কৃষক। এমনকি স্কুলের ছেলেমেয়েরা টিফিনের পয়সা দিয়ে দেবে সেতু গড়তে। টাকা দেবেন সংসদ সদস্যরাও তাঁদের বেতন থেকে।
প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অর্থায়নের যে কথা এর আগে বলেছিলেন, সেটা নিছক কথার কথা ছিল না। যে চারটি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থা ঋণ দিতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণদাতা ছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল। ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের মাত্র চার মাসের মাথায় বিশ্বব্যাংক হাত গুটিয়ে নিয়েছে। টাকা ছাড় করার আগেই দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সরে গেছে। এ অবস্থায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতটুকু না দমে প্রয়োজনে নিজেদের অর্থায়নের কথাটা একেবারে সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, তাঁর এ ঘোষণায় অর্থমন্ত্রীসহ গোটা মন্ত্রিসভা সহমত পোষণ করতে পারেনি। এর পরও অনেকেরই দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।
এদিকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়। কিন্তু অন্যদিকে কেউ কেউ এতে এমনকি পরিহাস করার, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বিপ্লবী বলার মতো লঘু মানসিকতাও দেখিয়েছে।
তবে সেতু গড়ার যুদ্ধটাকে কিছুতেই হালকা করে দেখছেন না সচেতন সব মানুষই। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে আত্মমর্যাদার প্রশ্নটা তো আছেই, সামর্থ্যের প্রশ্নটাকেও লঘু করে দেখার কিছু নেই। সামর্থ্য তো আছেই আমাদের যথেষ্ট, প্রধানমন্ত্রী তা হিসাব কষে বলেও দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় সামর্থ্য, বড় মূলধন আমাদের দেশপ্রেম। তার পরিচয় ইতিমধ্যেই আমরা পাচ্ছি। বীমা অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, তারা ১১ হাজার কোটি টাকা দেবে। সিকদার গ্রুপ বলেছে, তারা দেবে ২০০ কোটি টাকা। অনেকেই অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে তাঁদের বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি ঐতিহাসিক ও গোটা জাতিকে একটা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার শামিল। তিনি মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, বিশ্বের যে কয়টি দেশ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে 'না' বলে দিয়ে নিজেদের অর্থায়নে উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে মালয়েশিয়া রয়েছে প্রথম সারিতে। লাতিন আমেরিকার ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশও নিজেদের অর্থায়নেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির মুখ দেখছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও নিজেদের অর্থায়ন, পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে বা অন্য আর কোনোভাবে সেতু তৈরির সম্ভাবনার কথা বলেছেন, তবে সব প্রস্তাবই হতে হবে গ্রহণযোগ্য। আত্মপ্রত্যয়কে সুদৃঢ় করতে তিনি বলেছেন, 'আমরা ক্ষমতায় এসে বিশ্বমন্দার মধ্যে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছি। পদ্মা সেতুও করতে পারব। পদ্মা সেতু করার জন্য ১৬ কোটি মানুষ আছে। দেশের বাইরে ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি রয়েছে।' প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকের রিজার্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'এক-দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে।' অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেছেন, 'আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই তিনটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আমাদের আছে ২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ।'
ইতিমধ্যে রিজার্ভের ওপর ভরসা করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করার কথা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর। তিনি ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব করেছেন।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতিও শেয়ারবাজার থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ জোগাড় করার সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
মোটের ওপর এসব থেকে স্পষ্ট যে একটি নয়, একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণের মতোই সামর্থ্য এ জাতির রয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া কেন? এর জবাব হলো, বিশ্বব্যাংক ও তার মূল সংগঠন আইএমএফ (আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল), এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকাল ধরেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নানা রকম অসম শর্তের জালে জড়িয়ে প্রকল্পঋণ প্রদান করে আসছে। এগুলো যে অর্থায়নের আড়ালে পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক স্বার্থই হাসিল করতে চেষ্টা করে, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টিগলিৎস স্বয়ং সে নোংরা খেলা তাঁর লেখায় ফাঁস করে দিয়েছেন। পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তি নিয়ন্ত্রিত লগ্নিপুঁজি বা ফিন্যান্স ক্যাপিটালের জাল ছিন্ন করে যে কখনো বেরিয়ে আসা সম্ভব, সে নতুন বাস্তবতারই সম্মুখীন হতে হয়নি এ দেশকে। আমাদের আগে তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশকে সে রকম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিংবা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠায় ও প্রকৃত জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় বৃহৎ শক্তিবর্গের ফিন্যান্স পুঁজি বাজেয়াপ্ত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশ নিজ অর্থায়নে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ বেছে নিয়েছে।
আমাদের দেশেও দুনিয়া-কাঁপানো মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পর আর্থসামাজিক অবস্থার সে রকম একটি পরিবর্তন প্রত্যাশিত থাকলেও দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও নানা কৌশলের মাধ্যমে বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপ্রবেশ ও হস্তক্ষেপ সে পরিবর্তনকে বিগত চার দশকই থামিয়ে রেখেছে।
আজ শাপে বর হওয়ার মতোই বৃহৎ শক্তিবর্গ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতির ঋণদান থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনাই এ জাতিকে উন্নয়নের একটি স্বাধীন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পথ অবলম্বনের জায়গায় এনে দাঁড় করাচ্ছে। এ অবস্থাটা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে ঋণপ্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জায়গায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের শলাপরামর্শ বর্ষিত হলেও বাংলাদেশ যে আবার আগের অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ঘোষণায় দেশ নতুন যে চেতনা ও অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, তার মধ্যেই জাতির বৃহত্তর কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলেই সচেতন বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এদিকে দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে সমাসীন বিশ্বব্যাংকের কিছু সাবেক সেবাদাস কোশেশ চালিয়ে যাচ্ছেন, সরকার যেন হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার বিশ্বব্যাংকে ধরনা দেয়। আকস্মিকভাবেই জাতির এমন একটি চেতনা ও অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভব কি না সে প্রশ্নও অনেক মহলে থাকলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলেই যে তার প্রকৃষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য চরম আত্মত্যাগ স্বীকারকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথেই যে দেশের মৌলিক আর্থসামাজিক পরিবর্তন সাধিত হতে পারে, মহাজোট সরকারের আমলে সে সত্যও অন্য সব সরকারের আমলের চেয়ে অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলেই তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আচরণের পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হলে দেশের তেল-গ্যাস ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও নিশ্চিত হবে। এ আমলেই নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে বাপেক্স ক্রমাগত অনেক গ্যাস ও তেলকূপ খনন ও সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত রেখেছে।
সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদেশি প্রযুক্তির যে অভাবের কথা তোলা হয়, দেশের আর্থিক সামর্থ্যবলেই সে অভাবও ঘোচানো সম্ভব হবে। তা ছাড়া বাপেক্সের মতোই এ ক্ষেত্রে দেশের প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম। এ দেশের অনেক মেধাবী ও দক্ষ প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। আজ দেশের প্রয়োজনে অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আহ্বান জানালে তাঁরা সাড়া না দিয়ে পারবেন না। একইভাবে দেশের অনেক বিত্তশালী তথা জাতীয় ধনিক শ্রেণীও দেশ গড়ার এমন প্রয়োজনে নিশ্চিতভাবেই সাড়া দেবে।
আমরা মনে করি, বিশ্বব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন, মাত্র এই যুক্তিতে নানা রকম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ, অসম শর্তের বেড়াজালের মধ্যে আর দেশকে আটকে না রেখে, ঋণপ্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য হাত না কচলে সোজাসুজি সব রকম ঝুঁকি নিয়েই এবার নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সূচনার মাধ্যমে উন্নয়নের স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন পথই আমাদের গ্রহণ করা উচিত। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের পরিচয় রাখার এটাই সুযোগ। বিরোধী দলসহ গোটা জাতিকে এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ করার জরুরি ও ঐতিহাসিক করণীয়টাও এ সরকারকেই সম্পন্ন করতে হবে।
পদ্মা সেতু যে নিছক যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নয়নই ঘটাবে তা নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বা আমূল পরিবর্তনের সূচনা করবে।
পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নতুন ভুবনে নিয়ে যাবে, দরিদ্র এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতিবহ নতুন আর্থসামাজিক অবস্থার সূচনা করবে।
মানিক বাবুর পদ্মা নদীর মাঝি কুবের শোষণ-বঞ্চনার জীর্ণ সমাজ ছেড়ে, সব বাধা চূর্ণ করে কপিলার হাত ধরে অজানা স্বপ্নের দেশ ময়নাদ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিল নতুন সমাজের বার্তাবহ হোসেন মাঝির অনুগামী হয়ে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তেমনি এই জীর্ণ সমাজের আবরণ খসিয়ে নতুন ও সমৃদ্ধ এক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েই মাথা তুলে দাঁড়াবে।
৯.৭.২০১২
প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অর্থায়নের যে কথা এর আগে বলেছিলেন, সেটা নিছক কথার কথা ছিল না। যে চারটি আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী সংস্থা ঋণ দিতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণদাতা ছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল। ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের মাত্র চার মাসের মাথায় বিশ্বব্যাংক হাত গুটিয়ে নিয়েছে। টাকা ছাড় করার আগেই দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে বিশ্বব্যাংক সরে গেছে। এ অবস্থায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতটুকু না দমে প্রয়োজনে নিজেদের অর্থায়নের কথাটা একেবারে সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু দেখা গেছে, তাঁর এ ঘোষণায় অর্থমন্ত্রীসহ গোটা মন্ত্রিসভা সহমত পোষণ করতে পারেনি। এর পরও অনেকেরই দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।
এদিকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায়। কিন্তু অন্যদিকে কেউ কেউ এতে এমনকি পরিহাস করার, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে বিপ্লবী বলার মতো লঘু মানসিকতাও দেখিয়েছে।
তবে সেতু গড়ার যুদ্ধটাকে কিছুতেই হালকা করে দেখছেন না সচেতন সব মানুষই। পদ্মা সেতুর ব্যাপারে আত্মমর্যাদার প্রশ্নটা তো আছেই, সামর্থ্যের প্রশ্নটাকেও লঘু করে দেখার কিছু নেই। সামর্থ্য তো আছেই আমাদের যথেষ্ট, প্রধানমন্ত্রী তা হিসাব কষে বলেও দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় সামর্থ্য, বড় মূলধন আমাদের দেশপ্রেম। তার পরিচয় ইতিমধ্যেই আমরা পাচ্ছি। বীমা অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, তারা ১১ হাজার কোটি টাকা দেবে। সিকদার গ্রুপ বলেছে, তারা দেবে ২০০ কোটি টাকা। অনেকেই অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে তাঁদের বিনিয়োগে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাটি ঐতিহাসিক ও গোটা জাতিকে একটা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার শামিল। তিনি মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, বিশ্বের যে কয়টি দেশ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফকে 'না' বলে দিয়ে নিজেদের অর্থায়নে উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের মধ্যে মালয়েশিয়া রয়েছে প্রথম সারিতে। লাতিন আমেরিকার ভেনিজুয়েলা, আর্জেন্টিনাসহ কয়েকটি দেশও নিজেদের অর্থায়নেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির মুখ দেখছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও নিজেদের অর্থায়ন, পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) ভিত্তিতে বা অন্য আর কোনোভাবে সেতু তৈরির সম্ভাবনার কথা বলেছেন, তবে সব প্রস্তাবই হতে হবে গ্রহণযোগ্য। আত্মপ্রত্যয়কে সুদৃঢ় করতে তিনি বলেছেন, 'আমরা ক্ষমতায় এসে বিশ্বমন্দার মধ্যে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছি। পদ্মা সেতুও করতে পারব। পদ্মা সেতু করার জন্য ১৬ কোটি মানুষ আছে। দেশের বাইরে ৮০ লাখ প্রবাসী বাঙালি রয়েছে।' প্রধানমন্ত্রী ব্যাংকের রিজার্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'এক-দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে।' অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেছেন, 'আমাদের নিজেদের অর্থায়নেই তিনটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আমাদের আছে ২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ।'
ইতিমধ্যে রিজার্ভের ওপর ভরসা করে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করার কথা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর। তিনি ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার ব্যয় করা যেতে পারে বলে প্রস্তাব করেছেন।
ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সভাপতিও শেয়ারবাজার থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের অর্থ জোগাড় করার সম্ভাবনার কথা বলেছেন।
মোটের ওপর এসব থেকে স্পষ্ট যে একটি নয়, একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণের মতোই সামর্থ্য এ জাতির রয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া কেন? এর জবাব হলো, বিশ্বব্যাংক ও তার মূল সংগঠন আইএমএফ (আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল), এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকাল ধরেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নানা রকম অসম শর্তের জালে জড়িয়ে প্রকল্পঋণ প্রদান করে আসছে। এগুলো যে অর্থায়নের আড়ালে পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক স্বার্থই হাসিল করতে চেষ্টা করে, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টিগলিৎস স্বয়ং সে নোংরা খেলা তাঁর লেখায় ফাঁস করে দিয়েছেন। পাশ্চাত্য বৃহৎ শক্তি নিয়ন্ত্রিত লগ্নিপুঁজি বা ফিন্যান্স ক্যাপিটালের জাল ছিন্ন করে যে কখনো বেরিয়ে আসা সম্ভব, সে নতুন বাস্তবতারই সম্মুখীন হতে হয়নি এ দেশকে। আমাদের আগে তৃতীয় বিশ্বের অন্য অনেক দেশকে সে রকম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কিংবা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠায় ও প্রকৃত জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় বৃহৎ শক্তিবর্গের ফিন্যান্স পুঁজি বাজেয়াপ্ত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশ নিজ অর্থায়নে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথ বেছে নিয়েছে।
আমাদের দেশেও দুনিয়া-কাঁপানো মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার পর আর্থসামাজিক অবস্থার সে রকম একটি পরিবর্তন প্রত্যাশিত থাকলেও দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ও নানা কৌশলের মাধ্যমে বৃহৎ শক্তিবর্গের অনুপ্রবেশ ও হস্তক্ষেপ সে পরিবর্তনকে বিগত চার দশকই থামিয়ে রেখেছে।
আজ শাপে বর হওয়ার মতোই বৃহৎ শক্তিবর্গ নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতির ঋণদান থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার একটি ঘটনাই এ জাতিকে উন্নয়নের একটি স্বাধীন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পথ অবলম্বনের জায়গায় এনে দাঁড় করাচ্ছে। এ অবস্থাটা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে ঋণপ্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জায়গায় যাওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের শলাপরামর্শ বর্ষিত হলেও বাংলাদেশ যে আবার আগের অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে, এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ। বরং প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ঘোষণায় দেশ নতুন যে চেতনা ও অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, তার মধ্যেই জাতির বৃহত্তর কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলেই সচেতন বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এদিকে দেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে সমাসীন বিশ্বব্যাংকের কিছু সাবেক সেবাদাস কোশেশ চালিয়ে যাচ্ছেন, সরকার যেন হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার বিশ্বব্যাংকে ধরনা দেয়। আকস্মিকভাবেই জাতির এমন একটি চেতনা ও অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভব কি না সে প্রশ্নও অনেক মহলে থাকলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলেই যে তার প্রকৃষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য চরম আত্মত্যাগ স্বীকারকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথেই যে দেশের মৌলিক আর্থসামাজিক পরিবর্তন সাধিত হতে পারে, মহাজোট সরকারের আমলে সে সত্যও অন্য সব সরকারের আমলের চেয়ে অধিকতর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলেই তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বন্দর ব্যবস্থাপনায় দেশের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের অন্যায় আচরণের পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হলে দেশের তেল-গ্যাস ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও নিশ্চিত হবে। এ আমলেই নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে বাপেক্স ক্রমাগত অনেক গ্যাস ও তেলকূপ খনন ও সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত রেখেছে।
সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদেশি প্রযুক্তির যে অভাবের কথা তোলা হয়, দেশের আর্থিক সামর্থ্যবলেই সে অভাবও ঘোচানো সম্ভব হবে। তা ছাড়া বাপেক্সের মতোই এ ক্ষেত্রে দেশের প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম। এ দেশের অনেক মেধাবী ও দক্ষ প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ বিদেশে কর্মরত রয়েছেন। আজ দেশের প্রয়োজনে অবদান রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাঁদের আহ্বান জানালে তাঁরা সাড়া না দিয়ে পারবেন না। একইভাবে দেশের অনেক বিত্তশালী তথা জাতীয় ধনিক শ্রেণীও দেশ গড়ার এমন প্রয়োজনে নিশ্চিতভাবেই সাড়া দেবে।
আমরা মনে করি, বিশ্বব্যাংকের সুদের হার সর্বনিম্ন, মাত্র এই যুক্তিতে নানা রকম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ, অসম শর্তের বেড়াজালের মধ্যে আর দেশকে আটকে না রেখে, ঋণপ্রস্তাব পুনর্বিবেচনার জন্য হাত না কচলে সোজাসুজি সব রকম ঝুঁকি নিয়েই এবার নিজেদের অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সূচনার মাধ্যমে উন্নয়নের স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন পথই আমাদের গ্রহণ করা উচিত। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের পরিচয় রাখার এটাই সুযোগ। বিরোধী দলসহ গোটা জাতিকে এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ করার জরুরি ও ঐতিহাসিক করণীয়টাও এ সরকারকেই সম্পন্ন করতে হবে।
পদ্মা সেতু যে নিছক যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক উন্নয়নই ঘটাবে তা নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বা আমূল পরিবর্তনের সূচনা করবে।
পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নতুন ভুবনে নিয়ে যাবে, দরিদ্র এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতিবহ নতুন আর্থসামাজিক অবস্থার সূচনা করবে।
মানিক বাবুর পদ্মা নদীর মাঝি কুবের শোষণ-বঞ্চনার জীর্ণ সমাজ ছেড়ে, সব বাধা চূর্ণ করে কপিলার হাত ধরে অজানা স্বপ্নের দেশ ময়নাদ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিল নতুন সমাজের বার্তাবহ হোসেন মাঝির অনুগামী হয়ে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু তেমনি এই জীর্ণ সমাজের আবরণ খসিয়ে নতুন ও সমৃদ্ধ এক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েই মাথা তুলে দাঁড়াবে।
৯.৭.২০১২
No comments