রাঙা মাটির শান্তিনিকেতনে একদিন by প্রবীর বিকাশ সরকার
রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতন সমার্থক। সম্প্রতি সুযোগ পেয়েছি সেই শান্তিনিকেতনে যাওয়ার। ২২ মার্চ (২০১১) একদিনের একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিল কলকাতার সাকুরা একাডেমী জাপানি ভাষার স্কুল আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে 'রবীন্দ্রনাথ ও জাপান' বিষয়ের ওপর। বক্তাদের মধ্যে জাপান থেকে দু'জন আমন্ত্রিত ছিলেন_
একজন অধ্যাপিকা ড. নিওয়া কিয়োকো আর আমি। ড. নিওয়া উপস্থিত হননি, আমি গিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ত্রিগুণা সেমিনার কক্ষে জাপান-রবীন্দ্রনাথবিষয়ক কিছু অজানা অধ্যায় তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছিলাম বন্ধুবর জাপানি ভাষার তিন প্রশিক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস, প্রত্যয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনিন্দ্য কুণ্ডের কল্যাণে। তাদের সঙ্গে আগেই কথা হয়েছিল চারজনে মিলে শান্তিনিকেতনে যাব।
যাওয়ার ব্যবস্থাটা বিপুলই করল। ২৪ তারিখ ভোরে বিপুলের বারাসাত বাসা থেকে বেরিয়ে বিরাটি শহরে টাটা সুমো পাজেরো নিয়ে অপেক্ষমাণ প্রত্যয়, তার স্ত্রী শম্পা ও শিশুপুত্র এবং অনিন্দ্যর সঙ্গে মিলিত হয়ে যাত্রা শুরু করলাম সাড়ে ৮টায়। দিলি্লমুখী চওড়া এবং মসৃণ হাইওয়ে ধরে শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটে চলল বীরভূম জেলার দিকে। বীরভূমের বোলপুর থেকে দুই কিলোমিটার দূরেই শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনের লালচে-গেরুয়া ধূলিময় গ্রাম্য শহরে পেঁৗছলাম ১১টার দিকে। রাস্তার দু'পাশে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন হোটেল, কুটির, বাগানবাড়ি সদৃশ থাকার জায়গা। অনেক ঐতিহ্যবাহী বাহারি পণ্যসামগ্রীর দোকানপাট। অত লোকজনও নেই। খুবই ছিমছাম নিরাভরণ শান্তিনিকেতন শহর। আমরা শহর ছাড়িয়ে লাল মাটির কাঁচা পথ ধরে একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত 'বাউলমন' নামক চমৎকার কটেজ পেলাম। খুবই সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন। দূরে সবুজ ছায়াঘেরা গ্রাম। চারদিকে নানা গাছগাছালির মধ্যে ঘর এবং বসার জায়গা।
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ৪টার দিকে দ্বিতল রবীন্দ্রভবন তথা রবীন্দ্র জাদুঘর ও গবেষণাগারের দিকে গেলাম। রবীন্দ্রভবনের নিচে নীলাঞ্জন বসে। বেশ পরিসর, পরিচ্ছন্ন তার কক্ষটি। ওপরে রবীন্দ্রনাথবিষয়ক জাদুঘর, দুর্লভ সব আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি, চিঠি এবং বিভিন্ন দেশে প্রাপ্ত উপহারের সমাহার। অনন্যসাধারণ সংগ্রহশালা। পাশেই গ্রন্থাগার, অডিও ভিজ্যুয়াল সংরক্ষণশালা সেখানে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে রেকর্ডকৃত বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি এবং প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে। গ্রন্থাগার দেখতে গিয়ে দেখি অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বই পড়ছেন। নীলাঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলে জানাল, স্যার এখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কিছুদিন আছেন।
রবীন্দ্রভবন সংলগ্ন 'উত্তরায়ন' প্রকল্পের পাঁচটি ভবন দেখলাম। এগুলোতে কবি দীর্ঘজীবন বসবাস এবং বহু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ যথাক্রমে উদয়ন, শ্যামলী, কোণার্ক, উদীচী এবং পুনশ্চ বাড়িগুলো। এগুলোর সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। উদয়ন নামক রবীন্দ্রনাথের বৈঠকখানা এতই জীবন্ত যে এখনই বুঝি কবি ভেতর মহল থেকে বেরিয়ে আসবেন! অনেক ছোট ছোট কক্ষ। তবে বাড়িগুলোর ছাদ বেশ নিচু। চারদিকে বড় বড় গাছ, ফুলের বাগান, ছিমছাম পাখিডাকা পরিবেশ মন ভালো করে দেওয়ার প্রাকৃতিক পরিচর্যাকেন্দ্র বলা চলে। ছবি তোলা নিষেধ বলে তোলা গেল না।
পরদিন সাড়ে ১০টায় আমি বিপুলদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ওরা তখন কলাভবন, পাঠভবন, ক্যান্টিন, সঙ্গীতভবন ইত্যাদি দেখছিল। ক্যাম্পাসজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে পাথুরে ও ধাতব ভাস্কর্য। সঙ্গীতভবনের ভেতরে সঙ্গীতচর্চার ক্লাস প্রত্যক্ষ করলাম। এসব ঘুরে দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। এবার গেলাম যা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের সেটা হলো 'নিপ্পন ভবন'। ভবনে গিয়ে সত্যি অভিভূত হলাম! বিশ্বভারতী যে বদলাচ্ছে এটাই তার প্রমাণ। জাপানি আদলে তৈরি চমৎকার নিরিবিলি এই শিক্ষা অনুষদটি প্রতিষ্ঠানটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। সমৃদ্ধ একটি জাপানি গ্রন্থাগার রয়েছে সেখানে। ২৫ তারিখ বিকেলের দিকে 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ' শান্তিনিকেতন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছিলাম। উন্মাতাল বিষণ্নতায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমে। মনের মধ্যে বারবার ভেসে উঠছিল উত্তরায়ন প্রকল্পের পঞ্চভবনের অসংখ্য নির্জন কক্ষ আর জিনিসপত্রগুলো যেখানে রবিঠাকুরের ছায়াস্মৃতি আজও জীবন্ত।
probirsrkr06@gmail.com
যাওয়ার ব্যবস্থাটা বিপুলই করল। ২৪ তারিখ ভোরে বিপুলের বারাসাত বাসা থেকে বেরিয়ে বিরাটি শহরে টাটা সুমো পাজেরো নিয়ে অপেক্ষমাণ প্রত্যয়, তার স্ত্রী শম্পা ও শিশুপুত্র এবং অনিন্দ্যর সঙ্গে মিলিত হয়ে যাত্রা শুরু করলাম সাড়ে ৮টায়। দিলি্লমুখী চওড়া এবং মসৃণ হাইওয়ে ধরে শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটে চলল বীরভূম জেলার দিকে। বীরভূমের বোলপুর থেকে দুই কিলোমিটার দূরেই শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনের লালচে-গেরুয়া ধূলিময় গ্রাম্য শহরে পেঁৗছলাম ১১টার দিকে। রাস্তার দু'পাশে বেশ কিছু আকর্ষণীয় পর্যটন হোটেল, কুটির, বাগানবাড়ি সদৃশ থাকার জায়গা। অনেক ঐতিহ্যবাহী বাহারি পণ্যসামগ্রীর দোকানপাট। অত লোকজনও নেই। খুবই ছিমছাম নিরাভরণ শান্তিনিকেতন শহর। আমরা শহর ছাড়িয়ে লাল মাটির কাঁচা পথ ধরে একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত 'বাউলমন' নামক চমৎকার কটেজ পেলাম। খুবই সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন। দূরে সবুজ ছায়াঘেরা গ্রাম। চারদিকে নানা গাছগাছালির মধ্যে ঘর এবং বসার জায়গা।
বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ৪টার দিকে দ্বিতল রবীন্দ্রভবন তথা রবীন্দ্র জাদুঘর ও গবেষণাগারের দিকে গেলাম। রবীন্দ্রভবনের নিচে নীলাঞ্জন বসে। বেশ পরিসর, পরিচ্ছন্ন তার কক্ষটি। ওপরে রবীন্দ্রনাথবিষয়ক জাদুঘর, দুর্লভ সব আলোকচিত্র, পাণ্ডুলিপি, চিঠি এবং বিভিন্ন দেশে প্রাপ্ত উপহারের সমাহার। অনন্যসাধারণ সংগ্রহশালা। পাশেই গ্রন্থাগার, অডিও ভিজ্যুয়াল সংরক্ষণশালা সেখানে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে রেকর্ডকৃত বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি এবং প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে। গ্রন্থাগার দেখতে গিয়ে দেখি অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বই পড়ছেন। নীলাঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলে জানাল, স্যার এখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কিছুদিন আছেন।
রবীন্দ্রভবন সংলগ্ন 'উত্তরায়ন' প্রকল্পের পাঁচটি ভবন দেখলাম। এগুলোতে কবি দীর্ঘজীবন বসবাস এবং বহু কর্মকাণ্ড সম্পাদন করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ যথাক্রমে উদয়ন, শ্যামলী, কোণার্ক, উদীচী এবং পুনশ্চ বাড়িগুলো। এগুলোর সংস্কার করে পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। উদয়ন নামক রবীন্দ্রনাথের বৈঠকখানা এতই জীবন্ত যে এখনই বুঝি কবি ভেতর মহল থেকে বেরিয়ে আসবেন! অনেক ছোট ছোট কক্ষ। তবে বাড়িগুলোর ছাদ বেশ নিচু। চারদিকে বড় বড় গাছ, ফুলের বাগান, ছিমছাম পাখিডাকা পরিবেশ মন ভালো করে দেওয়ার প্রাকৃতিক পরিচর্যাকেন্দ্র বলা চলে। ছবি তোলা নিষেধ বলে তোলা গেল না।
পরদিন সাড়ে ১০টায় আমি বিপুলদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ওরা তখন কলাভবন, পাঠভবন, ক্যান্টিন, সঙ্গীতভবন ইত্যাদি দেখছিল। ক্যাম্পাসজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে পাথুরে ও ধাতব ভাস্কর্য। সঙ্গীতভবনের ভেতরে সঙ্গীতচর্চার ক্লাস প্রত্যক্ষ করলাম। এসব ঘুরে দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। এবার গেলাম যা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের সেটা হলো 'নিপ্পন ভবন'। ভবনে গিয়ে সত্যি অভিভূত হলাম! বিশ্বভারতী যে বদলাচ্ছে এটাই তার প্রমাণ। জাপানি আদলে তৈরি চমৎকার নিরিবিলি এই শিক্ষা অনুষদটি প্রতিষ্ঠানটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। সমৃদ্ধ একটি জাপানি গ্রন্থাগার রয়েছে সেখানে। ২৫ তারিখ বিকেলের দিকে 'গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ' শান্তিনিকেতন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরছিলাম। উন্মাতাল বিষণ্নতায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমে। মনের মধ্যে বারবার ভেসে উঠছিল উত্তরায়ন প্রকল্পের পঞ্চভবনের অসংখ্য নির্জন কক্ষ আর জিনিসপত্রগুলো যেখানে রবিঠাকুরের ছায়াস্মৃতি আজও জীবন্ত।
probirsrkr06@gmail.com
No comments