বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু by শাহীন রেজা নূর
পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে তেলেসমাতির চূড়ান্ত পর্ব আমরা দেখলাম। বিশ্বব্যাংক অবশেষে বাংলাদেশ সরকারের কতিপয় কর্মকর্তা, ব্যক্তি এবং কানাডার একটি পরামর্শক কোম্পানির দুর্নীতি তদন্তের বিষয়কে কেন্দ্র করে এই প্রকল্পে অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। এই প্রকল্পের প্রধান ঋণ প্রদানকারী সংস্থা হবার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের।
তাছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা, আইডিবি প্রভৃতি সংস্থারও এই প্রকল্পে ঋণ প্রদানের কথা। এই বহুমুখী সেতু নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের একারই দেয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। পদ্মা সেতু আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ক্ষেত্রে অপরিহার্য আর সেজন্য এই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই যারপরনাই সচেষ্ট ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা দেখা গেল যা কোনক্রমেই সমীচীন ছিল না। এ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে পদ্মা সেতু নির্মাণের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। আর সে মোতাবেক কাজও শুরু হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে তার নিজস্ব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের অনুকূলে কাজ পাইয়ে দেবার জন্য তদ্বির ও হস্তক্ষেপের অভিযোগ উত্থাপন করে। পরামর্শক কোম্পানি হিসেবে কানাডার একটি কোম্পানিকে নিয়োগ দানের জন্য মন্ত্রী ও সরকারের কতিপয় উর্ধতন আমলা এবং বাংলাদেশের কয়েক নাগরিকের কমিশন বা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও তোলা হয় বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে। আর এ সব ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্তসহ কিছু পরামর্শ তারা সরকারকে প্রদান করে। সরকার বিশ্বব্যাংকের এ সব অভিযোগ গোড়া থেকেই অস্বীকার করে আসছিল এবং বিশেষ করে আবুল হোসেনের ব্যাপারে অনঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আবুল হোসেন প্রধানত একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসা ক্ষেত্রে তার শনৈঃশনৈঃ তরক্কীর পেছনে কোন সে জাদুমন্ত্র কাজ করেছে এই নিয়ে সমাজে নানা ধরনের কথা প্রচলিত রয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্বব্যাংক নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত এমন অভিযোগও বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য কতিপয় উন্নত দেশের পক্ষে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন অভিযোগও এন্তার। বাংলাদেশের বেলায় বিশ্বব্যাংকের এ হেন আচরণ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যমূলক কিংবা বিশেষ কোন দেশী-বিদেশী মহল দ্বারা প্রভাবিত কিনা তা বলার সময় এখনও হয়নি। যদিও আমাদের অর্থমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে এমন ধারার একটি কিছু বলেই মনে করছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছেন বলে কাফে-রেস্তরাঁয়, এমনকি রাজনৈতিক মহলেও গুঞ্জন শোনা যায়। গত কয়েক দিন ধরে অধ্যাপক ইউনূস তার সামাজিক ব্যবসা নিয়ে এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যে সব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন এবং তারই সমর্থনে মার্কিন সিনেটের ১৮ মহিলা এমপি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে ওকালতি করেছেনÑএ সব কিছুই ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে দেশের সব মহলেই। হিলারির বাংলাদেশ সফরকালে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক এবং গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে তার বিভিন্ন মন্তব্য স্বাভাবিকভাবেই জনমনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। অধ্যাপক ইউনূস কিংবা হিলারি বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোন ভূমিকা পালন করছেন এর কোন সত্যতা আছে কি না তা যাচাই না করেই চলছে ব্যাপক গুঞ্জরণ। যাক, এখন আমাদের করণীয় কি? বিকল্প তহবিলের সন্ধানে সরকার ইতোমধ্যেই নড়াচড়া শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মন কষাকষি চলাকালেই নতুন যোগাযোগমন্ত্রী মালয়েশিয়ার একটি প্রস্তাব নিয়ে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়। বিশ্বব্যাংক অর্থ না দিলেও মালয়েশীয় সহায়তায় এই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সরকার তাদের অবস্থান ঘোষণা করে। ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এত বেশি কথা কেন বলছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়! রাস্তাঘাট নির্মাণ সেতু-কালভার্ট মেরামত বিষয়ে দু’একদিন পর পর সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি এত কথা না বলে কাজ করলেই তো পারেন। তার তো কথা নয়, কাজ বেশি করার কথা। সেতু বা রাস্তাঘাট নির্মিত হলে জনসাধারণই তা বলবে এবং মন্ত্রীর নামও তখন ভক্তিভরে উচ্চারণ করবে। কিন্তু তা না করে শুধু যদি কথার ফুলঝুরি বর্ষণ করেন মন্ত্রী তাহলে তাতে নিজের তো হয়ই এমনকি তার সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এ প্রসঙ্গে এক সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি দীর্ঘদিন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সবার মতে, তার সময়ে দেশে অনেক রাস্তাঘাট ও ব্রিজ কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। যমুনা সেতুটিও তার সময়েই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। এত সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে কখনও পত্রপত্রিকায় বিবৃতি বা জনসভায় কিংবা মিডিয়ায় ক্ষণে-ক্ষণে বক্তব্য দিতে কেউ শোনেনি। গলাবাজি করে কিছুকাল মানুষকে চমকে দেয়া বা থমকে রাখা যায়, কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে তা হিতে বিপরীতই হয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কথা বলেছেন যৎসামান্য, কাজ করেছেন অনেক বেশি। কিন্তু এ সরকারের প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন প্রায় তিন বছর দায়িত্বে থেকেও ঢাকার যানজট নিরসন, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ; রাস্তাঘাট মেরামত, মনোরেল, আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে কিংবা পদ্মা সেতু কোন ক্ষেত্রেই এক রত্তি সাফল্য দেখাতে পারেননি। এ সব ক্ষেত্রে কোন কাজই হয়নি। বিএনপি আমলে যেমন সারা দেশে মামুন-তারেকরা বৈদ্যুতিক খুঁটি লাগালেও এক ওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারেনি, এই প্রকল্পে কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে ঐকমত্যের অভাবে, ঠিক তেমনি শোনা যায় আবুল হোসেন তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাওয়াতে কিংবা কমিশনের পারসেনটেজ নির্ধারণ বিষয়ে অধিক ব্যস্ত থাকায় অন্যদিকে মনোনিবেশই করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের আগেরবার তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আর দু’টি পাসপোর্ট ব্যবহারের অভিযোগে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। কিন্তু এবার তিনি এই সরকারের কাছে কেন এত অপরিহার্য হয়ে উঠলেন তা বোঝা দুষ্কর। অবশ্য, বাজারে এই নিয়ে অনেক রকম গুঞ্জন শোনা যায়। কোন খুঁটির জোরে তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পেরেছেন? তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কোন কোন ব্যক্তির সমর্থন-সহানুভূতির কথা বাজারে চাউর হয়েছে। এর সত্যাসত্য তিনি বা তারাই ভাল বলতে পারবেন। আমি শুধু বলতে চাই বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু প্রশ্নে দুর্নীতির অভিযোগ এনে আবুল হোসেনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল তখন সরকার কেন তাকে সাফ-সুতরো বানানোর জন্য এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল? কেনইবা আবুল হোসেন নিজে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ‘মিথ্যা’ প্রমাণের জন্য স্বপদ থেকে সরে দাঁড়াবার মতো সৎ সাহস বা নৈতিক বল দেখালেন না? মন্ত্রিত্বই এত বড় ব্যাপার হয়ে গেল যে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় কোটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় অপরিহার্য এই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টির প্রতি তিনি এত হেলাফেলা ভাব দেখাতে পারলেন? সরকার বলছে যে, বিশ্বব্যাংকের চাওয়া অনুযায়ী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিলে তদন্তের আগেই তাকে বা সরকারকে স্বীকার করে নিতে হয় যে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই তাকে অন্য আরেকটি (কারও কারও মতে অধিক লাভজনক) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত করে সরকার এ ক্ষেত্রে নিজের অনঢ় অবস্থানকে ধরে রাখতে গিয়ে বিশ্বব্যাংককে অধিকতর বিরাগভাজন করে তুলেছে। দৈনিক স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন, ‘সরকার আবুল হোসেনকে বাঁচাতে গিয়ে প্রকারান্তরে দেশবাসীকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমানিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে।’ একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার কেন সততা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের ঐ অভিযোগের আলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে অপসারণের মাধ্যমে সরকারের সততা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারল না? তবে কি বুঝে নিতে হবে যে, আবুল হোসেনের বিষয়ে দেশবাসীর মনে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার যথেষ্ট ভিত্তি আছে? যদি তা না হয় তাহলে কেন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করা সত্ত্বেও এক ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য গোটা প্রকল্পটিকেই এইভাবে বিসর্জন দেয়া? এই দেশে গণতন্ত্রের তুবড়ি ছোটে সবার মুখে, অথচ গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য যে সব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সে সব বিষয় তলিয়ে যায় দলীয় সঙ্কীর্ণতার বা ব্যক্তি তোষণের প্লাবনে। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভাকে স্মার্ট এবং দুর্নীতিমুক্ত বলে অভিহিত করেছেন একাধিকবার। আর মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত এ বিষয়টিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মন্ত্রিপরিষদের কারও কারও বিরুদ্ধে যখন দেশে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তখন প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর রাখার স্বার্থে ওই ব্যক্তি কেন আগেভাগেই পদত্যাগ করেননি? আবুল হোসেন যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সত্যিকারের একনিষ্ঠ ও অনুগত হন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখার প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন না কেনÑএমন প্রশ্নও বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে। তাহলে কি বুঝে নিতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে যাদের প্রতি আস্থা স্থাপন করছেন বা করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলেই এর মর্যাদা রক্ষা করতে ইচ্ছুক নয়? নইলে পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে (যার ওপর কিনা আগামী নির্বাচনের সাফল্যও অনেকখানি নির্ভরশীল) মন্ত্রীবরের কোন রকম মাথাব্যাথাই থাকে না কেন? ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া বা দল কর্তৃক এই জাতীয় লোককে রাজনীতিক বনার সুযোগ করে দেয়ার নতিজা আজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে না? আবুল হোসেন যদি নিজেকে ‘নিষ্কলুষ’ প্রমাণ করার স্বার্থে তথা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করে তদন্তে নিরপরাধ প্রমাণের পর পুনরায় স্বপদে ফিরে আসতেন তাহলে তার নিজের এবং সরকারের কত বড় উপকার হতো তা কি তিনি কোন মুহূর্তেও একবার ভেবে দেখেছেন? না দেখেননি। কেননা, এ রকমটা দেখার জন্য যে ধরনের মানসিকতা ও সংস্কৃতি-চেতনা থাকার দরকার তা এদের নেই, থাকেও না। আত্মমগ্ন ব্যক্তিদের তা থাকে না এটিই সার-সত্য। এখনও তিনি সহজ উপায় অবলম্বন না করে নিজেকে ‘পূত-পবিত্র, নিষ্কলুষ ও অম্লান’ বলে দাবি করে ফিরছেন অথচ পদত্যাগ করে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের সুযোগ দিতে নারাজ। এ সবই বুঝিবা মাদারীর খেল!
অস্বীকার করার জো নেই যে, এই প্রকল্প বিষয়ে আমাদের সরকারও যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আজ এমন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে পারিনি। বরং আত্মম্ভরিতা, জেদ এবং উস্কানিমূলক কথা ও কার্যকলাপ দ্বারা তাদেরকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছি। সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মহল, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগই বিষয়টিকে অনেকখানি হাল্কাভাবে নিয়ে তামাশারই খোরাক জুগিয়েছে মাত্র। বিকল্প অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের ব্যয় কতগুণ বাড়বে এবং তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপর কতখানি বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা আমরা হিসেবে নিয়েছি কি? বিশ্বব্যাংক যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করে থাকে আর আমরা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং বিশ্বব্যাংকের এ বিষয়ক অন্যান্য শর্ত মেনে নিতাম ও এর পরও তারা যদি এই চুক্তি বাতিল করত তাহলে বলটি নিশ্চয়ই আমাদের সরকারের কোর্টে থাকত এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ‘অসৎ’ উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীর কাছেই খোলাসা হয়ে যেত বা আমরা তা তাদের কাছে খোলাসা করে মেলে ধরতে পারতাম। কিন্তু এখন কি হলো? বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যুঝতে যেয়ে আমরাই অপমানিত হলাম, ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, আমরা হেরে গেলামÑওরা জিতে গেল! এই সেতুকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে এমন কথাও কেউ কেউ বলে থাকেন আর তাদের মতে, এটিও বিশ্বব্যাংকের গোস্সার আরেকটি কারণ। এই সেতু প্রথমে আরিচায় হবার কথা, অতঃপর তা করা হলো মাওয়ায়। এতে বিএনপি নেত্রী বললেন, ‘আমরা কি তার (শেখ হাসিনার) বাড়িতে যাওয়ার জন্য পদ্মা সেতু করব?’ অর্থাৎ, এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিল। এ ধরনের বৃহত্তর প্রকল্পে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি। যমুনা সেতুর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল সরকারই একমত ছিল। কিন্তু এই পদ্মা সেতু রাজনৈতিকভাবে সব পক্ষকে এক মোহনায় আনতে পারেনি, ফলে এ ব্যাপারে অর্থের যোগান দেবার পূর্বে যোগানদাতাদের নতুন করে ভাবতে হয়েছে হয়তোবা।
সে যাক। পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে এক অপরিহার্যতা ও বাস্তবতা। এটির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক যে ভূমিকা নিয়েছে তা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থারই নামান্তরÑযা অভিপ্রেত নয় নিশ্চয়ই। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই আশা প্রকাশ করেছেন যে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাপারে পুনরায় আলোচনা অচিরেই শুরু করা যাবে। আমরাও আশা করি যে, বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বাংলাদেশের মানুষদের স্বার্থে। বাংলাদেশকে শান্তিময় ও সমৃদ্ধ এলাকায় রূপান্তরিত করতে তাদের এ দায় রয়েছে নিশ্চয়ই!
আরেকটি কথা, সংসদে বা সভা-সমিতিতে বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের প্রয়োজন নেই বলে আমরা যারা তারস্বরে চিৎকার করে বেড়াই তাদের নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে দায়িত্বহীন মন্তব্য করা যে জাতির জন্য শুভ ফল বয়ে আনে নাÑ এটিই বুঝি তার সর্বশেষ নমুনা। তবে একই সঙ্গে বলতেই হবে যে, বিশ্বব্যাংক বা যে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার উচিত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে জেদাজেদি নয় সংশ্লিষ্ট দেশটির প্রকৃত চাওয়ার বিষয়টিকে বিশেষভাবে আমলে নেয়া। আমরা নিজেরা এ ধরনের সেতু নির্মাণের ব্যাপারে যেদিন সত্যিকার অর্থে সারা দেশে গণজাগারণ সৃষ্টি এবং সকল মানুষকে এক মোহনায় এনে অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংগ্রহ করার মতো রাজনৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারব সেদিনই কেবল আমাদের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থের কোন প্রয়োজন হবে না। তার আগ পর্যন্ত এ ধরনের বিশাল কর্মযজ্ঞে এই সাহায্য প্রয়োজন পড়বে বৈ কী!
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিলের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত নিয়েও বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্বব্যাংক নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত এমন অভিযোগও বিভিন্ন মহল থেকে উত্থাপিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এখন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য কতিপয় উন্নত দেশের পক্ষে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন অভিযোগও এন্তার। বাংলাদেশের বেলায় বিশ্বব্যাংকের এ হেন আচরণ রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, উদ্দেশ্যমূলক কিংবা বিশেষ কোন দেশী-বিদেশী মহল দ্বারা প্রভাবিত কিনা তা বলার সময় এখনও হয়নি। যদিও আমাদের অর্থমন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে এমন ধারার একটি কিছু বলেই মনে করছেন। অধ্যাপক ইউনূস এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছেন বলে কাফে-রেস্তরাঁয়, এমনকি রাজনৈতিক মহলেও গুঞ্জন শোনা যায়। গত কয়েক দিন ধরে অধ্যাপক ইউনূস তার সামাজিক ব্যবসা নিয়ে এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যে সব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন এবং তারই সমর্থনে মার্কিন সিনেটের ১৮ মহিলা এমপি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরে গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে ওকালতি করেছেনÑএ সব কিছুই ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে দেশের সব মহলেই। হিলারির বাংলাদেশ সফরকালে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক এবং গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে তার বিভিন্ন মন্তব্য স্বাভাবিকভাবেই জনমনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। অধ্যাপক ইউনূস কিংবা হিলারি বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোন ভূমিকা পালন করছেন এর কোন সত্যতা আছে কি না তা যাচাই না করেই চলছে ব্যাপক গুঞ্জরণ। যাক, এখন আমাদের করণীয় কি? বিকল্প তহবিলের সন্ধানে সরকার ইতোমধ্যেই নড়াচড়া শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মন কষাকষি চলাকালেই নতুন যোগাযোগমন্ত্রী মালয়েশিয়ার একটি প্রস্তাব নিয়ে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়। বিশ্বব্যাংক অর্থ না দিলেও মালয়েশীয় সহায়তায় এই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সরকার তাদের অবস্থান ঘোষণা করে। ওবায়দুল কাদের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এত বেশি কথা কেন বলছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়! রাস্তাঘাট নির্মাণ সেতু-কালভার্ট মেরামত বিষয়ে দু’একদিন পর পর সংবাদ মাধ্যমের কাছে তিনি এত কথা না বলে কাজ করলেই তো পারেন। তার তো কথা নয়, কাজ বেশি করার কথা। সেতু বা রাস্তাঘাট নির্মিত হলে জনসাধারণই তা বলবে এবং মন্ত্রীর নামও তখন ভক্তিভরে উচ্চারণ করবে। কিন্তু তা না করে শুধু যদি কথার ফুলঝুরি বর্ষণ করেন মন্ত্রী তাহলে তাতে নিজের তো হয়ই এমনকি তার সরকারেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। এ প্রসঙ্গে এক সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি দীর্ঘদিন যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সবার মতে, তার সময়ে দেশে অনেক রাস্তাঘাট ও ব্রিজ কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। যমুনা সেতুটিও তার সময়েই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। এত সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে কখনও পত্রপত্রিকায় বিবৃতি বা জনসভায় কিংবা মিডিয়ায় ক্ষণে-ক্ষণে বক্তব্য দিতে কেউ শোনেনি। গলাবাজি করে কিছুকাল মানুষকে চমকে দেয়া বা থমকে রাখা যায়, কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে তা হিতে বিপরীতই হয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কথা বলেছেন যৎসামান্য, কাজ করেছেন অনেক বেশি। কিন্তু এ সরকারের প্রথম যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন প্রায় তিন বছর দায়িত্বে থেকেও ঢাকার যানজট নিরসন, রাস্তাঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ; রাস্তাঘাট মেরামত, মনোরেল, আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে কিংবা পদ্মা সেতু কোন ক্ষেত্রেই এক রত্তি সাফল্য দেখাতে পারেননি। এ সব ক্ষেত্রে কোন কাজই হয়নি। বিএনপি আমলে যেমন সারা দেশে মামুন-তারেকরা বৈদ্যুতিক খুঁটি লাগালেও এক ওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারেনি, এই প্রকল্পে কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে ঐকমত্যের অভাবে, ঠিক তেমনি শোনা যায় আবুল হোসেন তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাওয়াতে কিংবা কমিশনের পারসেনটেজ নির্ধারণ বিষয়ে অধিক ব্যস্ত থাকায় অন্যদিকে মনোনিবেশই করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের আগেরবার তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন আর দু’টি পাসপোর্ট ব্যবহারের অভিযোগে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে। কিন্তু এবার তিনি এই সরকারের কাছে কেন এত অপরিহার্য হয়ে উঠলেন তা বোঝা দুষ্কর। অবশ্য, বাজারে এই নিয়ে অনেক রকম গুঞ্জন শোনা যায়। কোন খুঁটির জোরে তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পেরেছেন? তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কোন কোন ব্যক্তির সমর্থন-সহানুভূতির কথা বাজারে চাউর হয়েছে। এর সত্যাসত্য তিনি বা তারাই ভাল বলতে পারবেন। আমি শুধু বলতে চাই বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতু প্রশ্নে দুর্নীতির অভিযোগ এনে আবুল হোসেনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিল তখন সরকার কেন তাকে সাফ-সুতরো বানানোর জন্য এত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল? কেনইবা আবুল হোসেন নিজে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ‘মিথ্যা’ প্রমাণের জন্য স্বপদ থেকে সরে দাঁড়াবার মতো সৎ সাহস বা নৈতিক বল দেখালেন না? মন্ত্রিত্বই এত বড় ব্যাপার হয়ে গেল যে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয় কোটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় অপরিহার্য এই পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টির প্রতি তিনি এত হেলাফেলা ভাব দেখাতে পারলেন? সরকার বলছে যে, বিশ্বব্যাংকের চাওয়া অনুযায়ী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দিলে তদন্তের আগেই তাকে বা সরকারকে স্বীকার করে নিতে হয় যে তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই তাকে অন্য আরেকটি (কারও কারও মতে অধিক লাভজনক) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত করে সরকার এ ক্ষেত্রে নিজের অনঢ় অবস্থানকে ধরে রাখতে গিয়ে বিশ্বব্যাংককে অধিকতর বিরাগভাজন করে তুলেছে। দৈনিক স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন, ‘সরকার আবুল হোসেনকে বাঁচাতে গিয়ে প্রকারান্তরে দেশবাসীকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমানিত হবার সুযোগ করে দিয়েছে।’ একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার কেন সততা ও স্বচ্ছতার প্রয়োজনে বিশ্বব্যাংকের ঐ অভিযোগের আলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে অপসারণের মাধ্যমে সরকারের সততা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারল না? তবে কি বুঝে নিতে হবে যে, আবুল হোসেনের বিষয়ে দেশবাসীর মনে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার যথেষ্ট ভিত্তি আছে? যদি তা না হয় তাহলে কেন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টিকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রদান করা সত্ত্বেও এক ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য গোটা প্রকল্পটিকেই এইভাবে বিসর্জন দেয়া? এই দেশে গণতন্ত্রের তুবড়ি ছোটে সবার মুখে, অথচ গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য যে সব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সে সব বিষয় তলিয়ে যায় দলীয় সঙ্কীর্ণতার বা ব্যক্তি তোষণের প্লাবনে। প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভাকে স্মার্ট এবং দুর্নীতিমুক্ত বলে অভিহিত করেছেন একাধিকবার। আর মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত এ বিষয়টিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই মন্ত্রিপরিষদের কারও কারও বিরুদ্ধে যখন দেশে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তখন প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর রাখার স্বার্থে ওই ব্যক্তি কেন আগেভাগেই পদত্যাগ করেননি? আবুল হোসেন যদি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সত্যিকারের একনিষ্ঠ ও অনুগত হন তাহলে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখার প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন না কেনÑএমন প্রশ্নও বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে। তাহলে কি বুঝে নিতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে যাদের প্রতি আস্থা স্থাপন করছেন বা করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলেই এর মর্যাদা রক্ষা করতে ইচ্ছুক নয়? নইলে পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে (যার ওপর কিনা আগামী নির্বাচনের সাফল্যও অনেকখানি নির্ভরশীল) মন্ত্রীবরের কোন রকম মাথাব্যাথাই থাকে না কেন? ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া বা দল কর্তৃক এই জাতীয় লোককে রাজনীতিক বনার সুযোগ করে দেয়ার নতিজা আজ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে না? আবুল হোসেন যদি নিজেকে ‘নিষ্কলুষ’ প্রমাণ করার স্বার্থে তথা সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করে তদন্তে নিরপরাধ প্রমাণের পর পুনরায় স্বপদে ফিরে আসতেন তাহলে তার নিজের এবং সরকারের কত বড় উপকার হতো তা কি তিনি কোন মুহূর্তেও একবার ভেবে দেখেছেন? না দেখেননি। কেননা, এ রকমটা দেখার জন্য যে ধরনের মানসিকতা ও সংস্কৃতি-চেতনা থাকার দরকার তা এদের নেই, থাকেও না। আত্মমগ্ন ব্যক্তিদের তা থাকে না এটিই সার-সত্য। এখনও তিনি সহজ উপায় অবলম্বন না করে নিজেকে ‘পূত-পবিত্র, নিষ্কলুষ ও অম্লান’ বলে দাবি করে ফিরছেন অথচ পদত্যাগ করে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণের সুযোগ দিতে নারাজ। এ সবই বুঝিবা মাদারীর খেল!
অস্বীকার করার জো নেই যে, এই প্রকল্প বিষয়ে আমাদের সরকারও যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আজ এমন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে পারিনি। বরং আত্মম্ভরিতা, জেদ এবং উস্কানিমূলক কথা ও কার্যকলাপ দ্বারা তাদেরকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছি। সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মহল, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগই বিষয়টিকে অনেকখানি হাল্কাভাবে নিয়ে তামাশারই খোরাক জুগিয়েছে মাত্র। বিকল্প অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণের ব্যয় কতগুণ বাড়বে এবং তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির ওপর কতখানি বিরূপ প্রভাব ফেলবে তা আমরা হিসেবে নিয়েছি কি? বিশ্বব্যাংক যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করে থাকে আর আমরা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সরকারী কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং বিশ্বব্যাংকের এ বিষয়ক অন্যান্য শর্ত মেনে নিতাম ও এর পরও তারা যদি এই চুক্তি বাতিল করত তাহলে বলটি নিশ্চয়ই আমাদের সরকারের কোর্টে থাকত এবং একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ‘অসৎ’ উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীর কাছেই খোলাসা হয়ে যেত বা আমরা তা তাদের কাছে খোলাসা করে মেলে ধরতে পারতাম। কিন্তু এখন কি হলো? বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যুঝতে যেয়ে আমরাই অপমানিত হলাম, ক্ষতিগ্রস্ত হলাম, আমরা হেরে গেলামÑওরা জিতে গেল! এই সেতুকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে এমন কথাও কেউ কেউ বলে থাকেন আর তাদের মতে, এটিও বিশ্বব্যাংকের গোস্সার আরেকটি কারণ। এই সেতু প্রথমে আরিচায় হবার কথা, অতঃপর তা করা হলো মাওয়ায়। এতে বিএনপি নেত্রী বললেন, ‘আমরা কি তার (শেখ হাসিনার) বাড়িতে যাওয়ার জন্য পদ্মা সেতু করব?’ অর্থাৎ, এ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিল। এ ধরনের বৃহত্তর প্রকল্পে জাতীয় ঐকমত্য জরুরি। যমুনা সেতুর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল সরকারই একমত ছিল। কিন্তু এই পদ্মা সেতু রাজনৈতিকভাবে সব পক্ষকে এক মোহনায় আনতে পারেনি, ফলে এ ব্যাপারে অর্থের যোগান দেবার পূর্বে যোগানদাতাদের নতুন করে ভাবতে হয়েছে হয়তোবা।
সে যাক। পদ্মা সেতু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে এক অপরিহার্যতা ও বাস্তবতা। এটির ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক যে ভূমিকা নিয়েছে তা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থারই নামান্তরÑযা অভিপ্রেত নয় নিশ্চয়ই। অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই আশা প্রকাশ করেছেন যে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ ব্যাপারে পুনরায় আলোচনা অচিরেই শুরু করা যাবে। আমরাও আশা করি যে, বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে বাংলাদেশের মানুষদের স্বার্থে। বাংলাদেশকে শান্তিময় ও সমৃদ্ধ এলাকায় রূপান্তরিত করতে তাদের এ দায় রয়েছে নিশ্চয়ই!
আরেকটি কথা, সংসদে বা সভা-সমিতিতে বিশ্বব্যাংকের সাহায্যের প্রয়োজন নেই বলে আমরা যারা তারস্বরে চিৎকার করে বেড়াই তাদের নিশ্চয়ই বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্ত থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে দায়িত্বহীন মন্তব্য করা যে জাতির জন্য শুভ ফল বয়ে আনে নাÑ এটিই বুঝি তার সর্বশেষ নমুনা। তবে একই সঙ্গে বলতেই হবে যে, বিশ্বব্যাংক বা যে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার উচিত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে জেদাজেদি নয় সংশ্লিষ্ট দেশটির প্রকৃত চাওয়ার বিষয়টিকে বিশেষভাবে আমলে নেয়া। আমরা নিজেরা এ ধরনের সেতু নির্মাণের ব্যাপারে যেদিন সত্যিকার অর্থে সারা দেশে গণজাগারণ সৃষ্টি এবং সকল মানুষকে এক মোহনায় এনে অভ্যন্তরীণভাবে অর্থ সংগ্রহ করার মতো রাজনৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারব সেদিনই কেবল আমাদের জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থের কোন প্রয়োজন হবে না। তার আগ পর্যন্ত এ ধরনের বিশাল কর্মযজ্ঞে এই সাহায্য প্রয়োজন পড়বে বৈ কী!
No comments