ভিনদেশের ইমিগ্রেশন এবং আমাদের জাতীয় স্বার্থ by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

বাঙালি বহু বছর ধরেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আসছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানসহ অনেক দেশেই বাংলাদেশের কিছু শিক্ষাপিপাসু মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য গমন করেছে এবং এখনো করছে। বাংলাদেশে জন্মলাভের ফলে এ দেশের মানুষের এই উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।


ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি- সব ধরনের উচ্চশিক্ষার জন্যই বাঙালির এই বিদেশ সফর। দুই দশক ধরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরো একটি নতুন উপাখ্যান- ইমিগ্রেশন। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া- এই দুটি দেশ ব্যাপক হারে ইমিগ্রেশন দিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই ইমিগ্র্যান্ট করে হাজার হাজার শিক্ষিত এবং যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য তাদের দেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করা শিক্ষিতদের জন্য বিশেষ বিবেচনায় ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার সূচনা করেছে। ফলে আমাদের দেশের হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মানুষ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। নিরাপদ সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিশেষ করে দুর্নীতিহীন ও সৎভাবে অধিক উপার্জন করার আকর্ষণে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত অনেকেই বিদেশে প্রবাসজীবন যাপনের পথ বেছে নিয়েছে। বিষয়টি এমন একপর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে বিদেশে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে যাওয়ার সুযোগ যে পাচ্ছে, সেই-ই বাংলাদেশ ত্যাগ করতে দ্বিধা করছে না। বাংলাদেশের দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকারব্যবস্থা, অনুন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা- সব কিছুর ওপরই একটি নীরব প্রতিবাদ জানাতে কিছুসংখ্যক মানুষের দেশ ত্যাগের নেশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই নেশা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের জন্য না হলেও সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের ভাবনায় দেশ ত্যাগ করছে কিছু মানুষ। এমনটা বললে বোধ হয় খুব অত্যুক্তি হবে না, যেসব উচ্চশিক্ষিত সৎ জীবনযাপনকারী নাগরিক এখনো দেশে পড়ে আছে, তারা হয়তো বিদেশে স্থায়ীভাবে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ যেন এক নির্মম সত্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো শিক্ষকও যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রটিও যাচ্ছে, বিখ্যাত ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও যাচ্ছে, আবার অন্যদিকে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও যাচ্ছে। যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে, সে-ই বাংলাদেশ ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
ভয়ানক সংবাদ এটি। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, 'আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।' সেই সুর ধরে আরো হয়তো বলা যায়, 'আমাকে শিক্ষিত মানুষ দাও, আমি উন্নত জাতি উপহার দেব।' জাতি, রাষ্ট্র এবং দেশকে উন্নত করার জন্য যোগ্য, শিক্ষিত, সৎ এবং দেশপ্রেমিক জনগণ প্রয়োজন। যোগ্যতা এবং উন্নয়ন পাশাপাশি হাঁটে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি অর্জন করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, কিন্তু মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তার মধ্যে আবার শিক্ষিত এবং যোগ্য মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। বিশাল জনসমুদ্রের মাঝে হাতে গোনা কিছু উচ্চশিক্ষিত এবং যোগ্য মানুষের মধ্য থেকে যদি অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে বসবাস করে, তাহলে অভাগা এই দেশটির কী হবে?
পানি নিচের দিকে গড়ায়, আবার সেই পানি ফুটালে জলীয় বাষ্প হয়ে ওপরের দিকে যায়। এটাই প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক নিয়ম। অন্যদিকে অধিক সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে মানুষ ছুটবে, এটাই সামাজিক নিয়ম। এই নিয়ম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এর ব্যত্যয় কখনো ঘটেনি। তাই তো মানুষ বেশি সুযোগ-সুবিধার সন্ধানে দেশ ছেড়ে দেশান্তর হতেও পিছপা হয় না। আর যেখানে বাংলাদেশের কথা আসবে, সেখানে তো এর ব্যত্যয় হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। কেননা এখানে কেবল সুযোগ-সুবিধাই নয়, বরং এর সঙ্গে যোগ হয়ে আছে নিজ দেশে মানুষের নিরাপত্তাহীনতাসহ হাজারো সমস্যা। এখানে মানুষ তার জন্য, তার সন্তানের জন্য এবং তার পরিবারের জন্য স্বার্থপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। আর সে সুযোগটাই গ্রহণ করছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশ। বাংলাদেশ তিল তিল করে গড়ে তুলছে একজন সৎ, যোগ্য ও শিক্ষিত বাঙালি। আর একদিন বড় হয়ে সেই বাঙালিটিই ফাঁকি দিয়ে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে এমন একটি উন্নত দেশে। নিজ স্বার্থ, সন্তানের স্বার্থ এবং পরিবারের স্বার্থই বড় করে দেখছে এ ক্ষেত্রে দেশত্যাগী শিক্ষিত মানুষটি। বিনা পরিশ্রমে সুচতুর পদ্ধতিতে শুধু তাদের দেশের উন্নত অবস্থার সুযোগে এমন হাজার হাজার বাঙালিকে উন্নত দেশগুলো তাদের দেশে আটকে রাখছে ব্যক্তিস্বার্থের বেড়াজালে। শুধু বাংলাদেশই এই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে না, উন্নত দেশগুলোর হাতছানিতে ধরা দিচ্ছে চীন, পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ আরো কিছু এশিয়ার দেশ। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ভারত থেকে সমানতালে সুবিধা লাভ করতে পারছে না এসব উন্নত দেশ। ভারতের উন্নত সমাজব্যবস্থা তাদের জনগণের উন্নত অংশকে দেশের মধ্যে ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের একজন মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করে বিদেশেই থেকে যাচ্ছে, সেখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে একজন ভারতের মানুষ উচ্চশিক্ষা শেষে ভারতে ফিরে যাচ্ছে। তারা পৃথিবীর সব উন্নত দেশের উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করছে ঠিকই, কিন্তু সেই শিক্ষা লাভের পর অধিকাংশই স্বদেশে ফিরে গিয়ে ভারতের জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণ করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশে পাঠিয়ে তাকে হারাচ্ছে। এমনকি দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা লাভ করেও অনেকেই অধিকতর উন্নত এবং নিরাপদ জীবনব্যবস্থার জন্য উন্নত কোনো দেশে বসবাস করছে স্থায়ীভাবে।
কেন ভারত তার উচ্চশিক্ষিত নাগরিককে হারাচ্ছে না? কেন বাংলাদেশ হারাচ্ছে? ভারতের 'এনআরআই' (নন-রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান) একটি জনপ্রিয় শব্দ সেখানে। প্রত্যেক এনআরআই বিশেষভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করে থাকে। ভারতে ইনভেস্টমেন্ট থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত- সবখানে এনআরআই বিশেষ সুযোগ লাভ করে। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নত জীবনব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা লাভ করার পরও ভারতে বসবাসের আকর্ষণ বলবৎ থাকে ভারতীয়দের। তাই উন্নত দেশগুলো ভারত থেকে শিক্ষিত এবং ব্যবসায়ী ইমিগ্র্যান্ট খুব একটা পাচ্ছে না। ভারত থেকে শ্রমিক শ্রেণী ঠিকই ব্যাপক হারে মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে কাজ করার জন্য যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষিত ও বিত্তবান অংশ ইমিগ্রেশন নিয়ে স্থায়ীভাবে কোনো উন্নত দেশে বসবাস করছে না ব্যাপক হারে। আর কেউ কেউ তা করলেও সে সংখ্যা খুবই নগণ্য। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ এমন সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ থেকে মেধা এবং শিক্ষা পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইমিগ্রেশন নিয়ে বড় বড় ব্যবসায়ী, বিশেষায়িত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী একের পর এক দেশ ত্যাগ করে উন্নত দেশে বসবাস করছে স্থায়ীভাবে। অন্যদিকে আরেক দল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে আর দেশে ফিরে আসছে না। মেধাশূন্যতার এক ভয়ানক অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশ ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে। ইমিগ্রেশনের নামে এসব মেধাকে সহজেই নিয়ে নিচ্ছে উন্নত দেশগুলো।
মেধা ধরে রাখার জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রচেষ্টা বা পরিকল্পনা নেই। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং সরকার যদি দুর্নীতিমুক্ত হতে পারত, যদি সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া যেত আমাদের দেশের জনগণকে, যদি মেধা কাজে লাগানোর উপযুক্ত পরিবেশ এবং ক্ষেত্র উপহার দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো এতখানি মেধা পাচারের সুযোগ ঘটত না। বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষিত এবং ব্যবসায়ী মহলকে দেশের আকর্ষণে আটকে রাখার জন্য সেই সমাজ উপহার দিতে হবে, যেখানে তাদের মেধা ব্যবহারের সুযোগ থাকে, যেখানে তারা সামাজিক নিরাপত্তা পেতে পারে, যেখানে তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ থাকে। আর তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজব্যবস্থা। আর তখনই আমরাও ভারতের মতো বলতে পারব- আমাদের দেশের সুসন্তান উচ্চশিক্ষা লাভ করেও দেশেই থাকতে আগ্রহী হবে এবং বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে আসবে।
লেখক : কলাম লেখক ও ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.