বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৫০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। করম আলী হাওলাদার, বীর প্রতীক দক্ষ এক যোদ্ধা জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত বাহাদুরাবাদ নৌবন্দর। এর অবস্থান যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ে। একসময় রেল যোগাযোগের জন্য বাহাদুরাবাদ ঘাট ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষত ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগ রক্ষায় ওই ঘাটের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। ঘাটে তখন পাঁচটি জেটি ছিল। এর মধ্যে দুটি যাত্রীবাহী স্টিমার, দুটি সামরিক যানসহ রেলওয়াগন-তেলের ট্যাংকার এবং একটি সি-ট্রাক লঞ্চ ও সামরিক (আর্টিলারিসহ) মালামাল পারাপারের কাজে ব্যবহূত হতো।
৩১ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দল (তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলে ছিলেন করম আলী হাওলাদার। তিনি ছিলেন মূল আক্রমণকারী দল ‘ডি’ (ডেলটা) কোম্পানিতে এবং একটি প্লাটুনের নেতৃত্বে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা সেদিন নির্ধারিত সময়ে (শেষ রাত) ঘাটের রেললাইনের জংশন পয়েন্টে অবস্থান নেন। এরপর সবার আগে করম আলী হাওলাদার তাঁর দল নিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যান। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল জেনারেটরবাহী রেলওয়াগন ও এর আশপাশের ছোট ছোট বাংকারে আক্রমণ করে তা ধ্বংস করা।
ঘটনাচক্রে তখন ওয়াগনের চারদিকের বাংকারে পাকিস্তানি সেনারা ছিল না। তারা লাইনের অপর পাশে ডিউটি শুরুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল এবং লাইনের ওপর একটি যাত্রীবাহী রেলের সানটিং চলছিল। সানটিং ইঞ্জিন সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করম আলী হাওলাদার সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে প্রথমে জেনারেটরবাহী রেলওয়াগন এবং সানটিং ইঞ্জিনের ওপর রকেট নিক্ষেপ করেন।
করম আলী হাওলাদারের ছোড়া রকেট নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানে। প্রথম রকেটের আঘাতেই জেনারেটর অকেজো এবং সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। গোলার শব্দ পেয়ে তাঁদের অন্যান্য উপদলও আক্রমণ শুরু করে। আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। অবশ্য কিছুক্ষণ পর নিজেদের গুছিয়ে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
কিন্তু অতর্কিত আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাঁচার জন্য অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার না জানায় তারা নদীতে ডুবে মারা যায়। পরে করম আলী হাওলাদার রকেট লঞ্চার থেকে রকেট ছুড়ে নদীতে থাকা সব নৌযান—বার্জ, পন্টুন, টাগ ও লঞ্চ ধ্বংস করেন। সেগুলো রকেটের আঘাতে ফুটো হয়ে পানিতে ডুবে যায়।
করম আলী হাওলাদার চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে এই রেজিমেন্টকে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তাঁর কোম্পানি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়িতে ছিল। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে করম আলী হাওলাদার ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ২৮ মার্চ রংপুর থেকে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তিনি অ্যাম্বুশ করেন। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। বাহাদুরাবাদ ও দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য করম আলী হাওলাদারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫৬।
করম আলী হাওলাদার স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ১৯৮৮ সালে মারা যান। পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউনিয়নের ভরপাশা গ্রামে। বাবার নাম গোলাম আলী হাওলাদার, মা লতিফুন্নেছা। স্ত্রী খোদেজা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও চার মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর বরিশাল নিজস্ব প্রতিনিধি সাইফুর রহমান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
১৯৭১ সালে সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। ঘাটে তখন পাঁচটি জেটি ছিল। এর মধ্যে দুটি যাত্রীবাহী স্টিমার, দুটি সামরিক যানসহ রেলওয়াগন-তেলের ট্যাংকার এবং একটি সি-ট্রাক লঞ্চ ও সামরিক (আর্টিলারিসহ) মালামাল পারাপারের কাজে ব্যবহূত হতো।
৩১ জুলাই মুক্তিবাহিনীর একটি দল (তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) বাহাদুরাবাদ ঘাটে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দলে ছিলেন করম আলী হাওলাদার। তিনি ছিলেন মূল আক্রমণকারী দল ‘ডি’ (ডেলটা) কোম্পানিতে এবং একটি প্লাটুনের নেতৃত্বে।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা সেদিন নির্ধারিত সময়ে (শেষ রাত) ঘাটের রেললাইনের জংশন পয়েন্টে অবস্থান নেন। এরপর সবার আগে করম আলী হাওলাদার তাঁর দল নিয়ে আক্রমণের জন্য এগিয়ে যান। তাঁর ওপর দায়িত্ব ছিল জেনারেটরবাহী রেলওয়াগন ও এর আশপাশের ছোট ছোট বাংকারে আক্রমণ করে তা ধ্বংস করা।
ঘটনাচক্রে তখন ওয়াগনের চারদিকের বাংকারে পাকিস্তানি সেনারা ছিল না। তারা লাইনের অপর পাশে ডিউটি শুরুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল এবং লাইনের ওপর একটি যাত্রীবাহী রেলের সানটিং চলছিল। সানটিং ইঞ্জিন সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করম আলী হাওলাদার সহযোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে প্রথমে জেনারেটরবাহী রেলওয়াগন এবং সানটিং ইঞ্জিনের ওপর রকেট নিক্ষেপ করেন।
করম আলী হাওলাদারের ছোড়া রকেট নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানে। প্রথম রকেটের আঘাতেই জেনারেটর অকেজো এবং সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। গোলার শব্দ পেয়ে তাঁদের অন্যান্য উপদলও আক্রমণ শুরু করে। আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হকচকিত হয়ে পড়ে। অবশ্য কিছুক্ষণ পর নিজেদের গুছিয়ে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে।
কিন্তু অতর্কিত আক্রমণে বেশির ভাগ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাঁচার জন্য অনেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার না জানায় তারা নদীতে ডুবে মারা যায়। পরে করম আলী হাওলাদার রকেট লঞ্চার থেকে রকেট ছুড়ে নদীতে থাকা সব নৌযান—বার্জ, পন্টুন, টাগ ও লঞ্চ ধ্বংস করেন। সেগুলো রকেটের আঘাতে ফুটো হয়ে পানিতে ডুবে যায়।
করম আলী হাওলাদার চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে। মার্চ মাসে এই রেজিমেন্টকে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তাঁর কোম্পানি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়িতে ছিল। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে করম আলী হাওলাদার ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ২৮ মার্চ রংপুর থেকে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তিনি অ্যাম্বুশ করেন। তাঁদের আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। বাহাদুরাবাদ ও দেওয়ানগঞ্জ যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট সাহস, দক্ষতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য করম আলী হাওলাদারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫৬।
করম আলী হাওলাদার স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সুবেদার হিসেবে অবসর নেন। ১৯৮৮ সালে মারা যান। পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউনিয়নের ভরপাশা গ্রামে। বাবার নাম গোলাম আলী হাওলাদার, মা লতিফুন্নেছা। স্ত্রী খোদেজা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও চার মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর বরিশাল নিজস্ব প্রতিনিধি সাইফুর রহমান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments