স্মরণ-আধুনিক প্রেমের কবি আহসান হাবীব by জাহাঙ্গীর হোসেন
যাঁর কথা বলছি তিনি কোনো আগন্তুক নন। তিনিই আকুতি করে বলছেন, 'আমি কোন আগন্তুক নই... আমি জমিলার মা'র শূন্য খাঁ খাঁ রান্নাঘর থালা সব চিনি/সে আমারে চেনে।' যাঁকে এই বাংলার জমিলার মায়ের রান্নাঘরটা পর্যন্ত চেনে, তাঁকে কি চিনতে পেরেছেন?
'হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই/: যান, আপনার মা আসছেন। মা ডাকছেন যাই।' এই দুটি লাইন দিয়ে এই মানুষটি একটি কবিতা শেষ করেছিলেন। আর এই কবিতাটিই কি না শুরু করে দিল আমাদের বাংলা সাহিত্যে আধুনিক প্রেমের কবিতা নামে রবীন্দ্র-পরবর্তী এক অধ্যায়! তিনি আর কেউ নন, আমাদের মেঘনাপাড়ের কবি আহসান হাবীব। ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন পিরোজপুরের শংকরপাশা গ্রামে। বাবা হামিজুদ্দিন হাওলাদার এবং মা জমিলা খাতুন। পাঁচ ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পাস করে বরিশাল শহরে এসে বি এম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। ১৯৩৬ সালে তিনি কর্মের সন্ধানে তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯৩৭ সালে এসে দৈনিক তকবির পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন শুরু হয় মাত্র ১৭ টাকা মাসিক বেতনে। পরে তিনি ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার বুলবুল পত্রিকায় এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সওগাত-এ। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন আকাশবাণী কলকাতায়। রবীন্দ্র-নজরুলের সীমাহীন সৃষ্টির ছায়ায় তিনি নিজেকে ভাসিয়ে দেননি। বরং এরই মধ্যে তৈরি করেছিলেন নিজের একটি আলাদা জগৎ। আধুনিক রোমান্টিকতা যেমন এঁকেছেন লেখনিতে, তেমনি বাদ দেননি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিনি লিখেছেন- 'এরা সেই আপনি গড়া খেয়া নৌকায় হয়ত/পেরিয়ে যাবে গঙ্গা/মিলিয়ে যাবে পশ্চিম সীমান্তে/নদীর জলে ঝলসে উঠবে মুক্তি।' স্বল্পভাষী এই মানুষটি তখনকার শক্তিশালী লেখক শওকত ওসমানের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিলেন। আমৃত্যু তাঁদের এই বন্ধুতা অটুট ছিল। কবি ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর চলে আসেন পূর্ববঙ্গে এবং ২১ জুন বিয়ে করেন বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া নিবাসী মহসিন আলী মিয়ার মেয়ে সুফিয়া খাতুনকে। এই বছরই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাত্রি শেষ' প্রকাশিত হয়। আর এর প্রচ্ছদ আঁকেন জয়নুল আবেদিনের মতো মহান শিল্পী। কবি দুই মেয়ে ও দুই ছেলের জনক। দুই মেয়ে হলেন- কেয়া চৌধুরী ও জোহরা নাসরীন এবং দুই ছেলে হচ্ছেন মঈনুল আহসান সাবের ও মনজুরুল আহসান জাবের। কবিপুত্র মঈনুল আহসান সাবের বাংলাদেশের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক। তাঁর রচনাবলির মধ্যে আছে কাব্যগ্রন্থ 'রাত্রী শেষ', 'ছায়াহরিণ', 'সারু দুপুর'। আর উপন্যাস 'রাণী খালের সাঁকো', 'অরণ্য নীলিমা'। শিশুসাহিত্যের মধ্যে আছে 'জোছনা রাতের গল্প', 'পাখীরা ফিরে আসে' ইত্যাদি। ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই কবি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় একটি অংশ আলোকিত করে আছে এবং থাকবে।
জাহাঙ্গীর হোসেন
No comments