কথা সামান্যই-ইতিহাসের সঙ্গে বসবাস by ফজলুল আলম
ইতিহাস ইতিহাস হয়েছে, কারণ আমরা সেটার সঙ্গে অতীতকে সমার্থক করেছি। অতীত ও বর্তমান যদি একটা কালের গর্ভেই থাকত, তবে কি ইতিহাস সৃষ্টি হতো? ঘটে গেছে এমন কিছু? বিশাল কিছু না হলেও ঘটে গেছে যা, তার তো হদিস রাখা উচিত।
মানবতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক ঘটনাই বিশাল ও উল্লেখযোগ্য- সেসব আমাদের জীবনে, বর্তমান জীবনে এবং ভবিষ্যৎ জীবনকেও কখনো ছেড়ে যাবে না।
আমরা কিন্তু শুধু বর্তমান তৈরি করি। এই বর্তমানই অতীত হয়ে যায়! হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না; কিন্তু হতে হয়। সব তো দুই হাতের পরিধিতে ধরে রাখা যায় না, কিছু তো ছাড়তে হয়। তার পরও যেটুকু সঙ্গে থাকে, সেটুকুও ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে যায়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইতিহাসের প্রয়োজন তেমন নেই, তবু আমরা ইতিহাস ছাড়া থাকতে পারি না, অথবা এভাবেও বলা যায় যে আমাদের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু রাজরাজড়াদের ইতিহাস নয়, আমার-তোমার জীবনের ইতিহাস। আজ সকালের কথা, গতকালের কথা, পরশুর কথা, সারা মাসের কথা, বছরের কথা, এক যুগের কথা, শতবর্ষের কথা, সহস্রাব্দের কথা। হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বের পরিধিতে, পরিধির বাইরে যত ঘটনা ঘটেছে, যত উন্নতি হয়েছে, যত জ্ঞান অর্জিত হয়েছে, জ্ঞানার্জনে যত ভুল হয়েছে, মানব সম্প্রদায়কে ঠিক পথে চালিত করার জন্য যত বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, সেসব বিশ্বাস ভাঙার জন্য যত চেষ্টা বা অপচেষ্টা হয়েছে, মানব সমাজে যত বিশাল শ্রেণীবিভাজন হয়েছে এবং সেই শ্রেণীবিভাজনের কারণে এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর ওপর প্রাধান্য ফলাতে গিয়ে যত না অত্যাচার করেছে- এই সব কিছু এখন ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তার পরও ইতিহাস জীবন্ত থেকে গেছে আমাদের কাছে। জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক- আমরা ইতিহাসের মধ্যেই থাকি। আমাদের জীবনে অতীত জীবন্ত রয়ে গেল কেন?
কারণ আমরা অতীতের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারছি না। ইতিহাসবিদ একজন তো বলেই দিলেন, 'ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়'। অবশ্য এই তাত্ত্বিক বক্তব্য আমি মানি না- কারণ বিশ্বমানবতা হাল ছেড়ে বসে নেই। তারা সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে। অতীতকে তারা ভোলেনি, অতীতের দুঃখজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেদিকে তারা সজাগ। নাৎসি বর্বরতার সঙ্গে তুলনা শুধু নয়, তাদের বর্বরতার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে তেমন খণ্ড খণ্ড ঘটনার কথা আমরা জানি। উদাহরণ দেওয়া যায়, পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট নিধনে, যুক্তরাষ্ট্রের জেলখানায় (বিশেষত গুয়ান্তানামো বেতে), এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার সময়, একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যাকালে, আফ্রিকার বিভিন্ন গোত্র-গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে গণহত্যা, বিভিন্নভাবে মানবতা অনেক বর্বরতার শিকার হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নাৎসিবাদের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। এটাও সঠিক হবে না বলা যে যেটুকু পুনরাবৃত্তি হয়েছে, সেটুকু পরিহাস মাত্র।
বাংলাদেশে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি এখন। ইউরোপে এখনো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের খুঁজে বের করার কাজ চলছে, ধরতে পারলে তাদেরও বিচার হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার মধ্যে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যোগাযোগ আছে; কিন্তু যে চারটি স্তম্ভের ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব, সেই স্তম্ভগুলো একে একে আমরা ভুলতে বসেছি। একবার ভুলেও গিয়েছিলাম। মৃত পাকিস্তানের কফিন বহনকারীরা আমাদের মধ্যে আবার সক্রিয় হয়ে আমাদেরই মাথায় লাশ ফেলল। একবার আমরা ভেবেছিলাম, সেই লাশ ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি, ভেবেছিলাম তাদের পরাজিত করেছি।
কিন্তু বাঙালির চরিত্রে কৃতজ্ঞতাবোধের পরিমাণ সম্ভবত বেশি নয়। যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ডাকে বাঙালি জেগে উঠেছিল, আজ সে তা ভুলতে বসেছে। যে স্বাধীনতা পেয়ে বাংলায় আজ সুরম্য অট্টালিকার পর অট্টালিকা উঠছে, নব্য ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (দরিদ্রের সংখ্যা নিয়ে নব্য ধনীরা মাথা ঘামায় না), রিকশা আর ঘোড়ার গাড়ির জায়গায় ব্র্যান্ড নিউ দামি মোটর গাড়ি রাজপথের শোভাবর্ধন করছে, যে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারে আমাদের শিল্পায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের নগরায়ণে সহায় হয়েছে, সেই সব হাতের মুঠোয় আসার পেছনের কারণ আমরা দ্রুত ভুলতে পারি। আমরা ভুলে যাই যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকের ফলেই এসব আমরা পেয়েছি, তাই আমাদের অনেকে যারা মৃত পাকিস্তানের শব আমাদের মাথায় ফেলেছে, তাদের সঙ্গে ঘর করতে যায় ('অনেকে' বলব কেন, বলা উচিত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিই পাচ্ছে)। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে 'ফিনিশড প্রোডাক্ট' তৈরির শিল্পায়নে আমাদের নজর নেই, আমরা প্রাকৃতিক সম্পদ সরাসরি দিয়ে দিতে প্রস্তুত, কারণ তাতে আমাদের লাখো-কোটি ডলার আয় হবে বলে ভাবি, ভাবি না যে এই কাঁচামাল সম্পদের জন্যই বেনিয়াজাত ভারত দখল করেছিল। আজ আমরা ব্যক্তিস্বার্থে শুধু কালোটাকার খেলা খেলি না, প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের এক বিরাট অংশ অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায় খরচ করি এবং সেই সঙ্গে ব্যাংকের গাফিলতিতে বা যোগসাজশে বিদেশি ব্যাংকে নিজেদের নামে টাকা পাচার করি।
আরো তেমন কিছু ঘটছে, কারণ আমরা বর্তমানকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
পলাশীর যুদ্ধ, ব্রিটিশ বিতাড়িত করার জন্য সংগ্রাম, বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম- এসব আমাদের কাছে ইতিহাস মাত্র, সম্ভবত মৃত ইতিহাস। জাতিসত্তা যে সবার কাছে, সব জাতির কাছে একই অর্থবহ, তা আমরা ভুলে যাই। জাতিসত্তার কথায় আমরা টেনে আনি জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, গোষ্ঠীপ্রাধান্যতা, অতীতের বংশের গর্ব ইত্যাদি। আমাদের শিল্পগোষ্ঠী মনে করে, তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তাদের অনেকের বর্তমান কার্যকলাপের প্রতি সমর্থন দেওয়া যায় না।
এখানে এসে যায় দলীয় রাজনীতি। দলীয় রাজনীতি সর্বদাই পুরোপুরি বর্তমানভিত্তিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে। ফলে কয়েকটি আপ্তবাক্য উচ্চারণ করা ছাড়া অতীতের বা ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। সেটাও মেনে নেওয়া যায়, যদি তারা বর্তমানকে বর্তমানের আলোকে দেখতে সক্ষম হয়। কোনো দলীয় রাজনীতি (বিশেষত এখন বা অতীতে ক্ষমতায় থাকা দল হলে) অতীত ফেলতে পারে না বিধায় তারা বর্তমানকে প্রাধান্য দিতে পারে না।
ব্রিটিশরা চলে গেলে, পরবর্তী সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিতাড়িত করার পরও আমাদের রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন হলো না, বদল হলো কিছু মুখ। বাংলাদেশ পেয়ে আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, জাতি-বর্ণ-ধর্মগত বৈষম্য চলে গেল; এখন আমরা সবাই সমান। কিন্তু দুদিনেই দেখা গেল, আমাদের সদ্য প্রাপ্ত বর্তমান অতীতকেই অনুসরণ করছে। বাঙালি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। আমরা আবার ফিরে গেলাম এক নতুন অতীতে। এবার আমাদের জনগোষ্ঠীর ওপর ছড়ি ঘোরানো শুরু করল বাঙালিরাই।
আমরা বর্তমানকে নিয়ে বাস করতে পারি না। কারণ আমাদের বলা হয়েছে, অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। অথচ আমাদের বর্তমানই বাস্তব, আমরা যে উন্নতি করতে চাই, তা বাস্তবসম্মত হতেই হবে। সে জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রে আমূল পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের প্রথম সহায়ক হবে গণতন্ত্রের আইনকানুনে পরিবর্তন ও কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করা। জ্ঞানী ব্যক্তি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সেসব জানেন; কিন্তু মুখ ফুটে বলেন না। তাঁরা হালকা সমালোচনা করেই ক্ষান্ত, কারণ তারাও অতীতের সঙ্গে বসবাস করেন; তাঁরা অনেকেই মনে মনে তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের বা নবগঠিত সরকারের উপদেষ্টা হতে চান।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক
No comments