ডিসিদের ডাকা সভায় না গেলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা by আশরাফুল হক রাজীব

অবশেষে সরকার জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে জেলাপর্যায়ে অনুষ্ঠিত সভায় অনুপস্থিত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ২৬ জুন সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে পাঠানো পৃথক দুটি চিঠিতে এ কথা জানানো হয়।


চিঠিতে জেলাপর্যায়ে অনুষ্ঠিত সভায় অনুপস্থিত সদস্যদের তালিকা পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার এখন থেকে ব্যবস্থা নেবে। এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার পর তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।
আন্তক্যাডার দ্বন্দ্বের জের ধরে মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। বিষয়টি সরকারের জন্য বড় ধরনের সমস্যা হয়ে আছে। জেলা সমন্বয় সভায় অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রতিবছরই জেলা প্রশাসক সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। আজ মঙ্গলবার থেকে চলতি বছরের তিন দিনের ডিসি সম্মেলন শুরু হচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো এবারের সম্মেলনেও নিশ্চিতভাবেই এ অভিযোগ উঠবে। প্রশাসন ক্যাডার এ বিষয়টি নিয়ে সব সময়ই সোচ্চার। এ অবস্থায় সরকারের শেষ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ২৬ জুন সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের পাঠানো চিঠিতে এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
দুটি চিঠিতেই বলা হয়েছে, জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জেলাপর্যায়ে একাধিক কমিটি রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উপযুক্ত সদস্যের অনুপস্থিতি ও নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিত্ব সভাগুলোকে গুরুত্বহীন করে তোলে। এটা জনস্বার্থে গৃহীত সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে অসহযোগিতার শামিল।
চিঠিতে বলা হয়, জেলাপর্যায়ে অনুষ্ঠিত সভায় অনুপস্থিত সদস্যদের তালিকা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে এর অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে হবে। অনুপস্থিত সদস্যদের (কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্যও চিঠিতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ধরনের চিঠি পেয়েছি। এ ব্যাপারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।'
একজন জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, জেলাপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সভায় এসপিদের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই সভায় এসপিরা নিজেরা না গিয়ে জুনিয়র কোনো কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দেন। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি পরে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও সমস্যা দেখা দেয়। ওই জেলা প্রশাসক জানান, সভায় উপদেষ্টা হিসেবে স্থানীয় সব এমপি অংশ নেন।
জানা গেছে, জেলাপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি ছাড়াও জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি, জেলা কর্ণধার কমিটি, জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, জেলা পরিবার পরিকল্পনা কমিটি, বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে গঠিত কমিটিসহ বেশির ভাগ কমিটির প্রধান হচ্ছেন জেলা প্রশাসক। সংশ্লিষ্ট দপ্তরপ্রধান সেই কমিটির সদস্যসচিব থাকেন। এ ধরনের সভায় উপযুক্ত কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি সরকারের উদ্যোগ বাস্তবায়নে অসহযোগিতা ও অবহেলার শামিল বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে। জানা যায়, বরিশাল বিভাগের একজন জেলা প্রশাসকের অভিযোগের ভিত্তিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
শুধু মাঠপর্যায়ে নয়, সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়েও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সচিব সভা আহ্বান করলেও সেখানে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়ে উপস্থিত হন। অথচ কোনো সচিব সভায় উপস্থিত না থাকতে পারলে তাঁকে লিখিতভাবে জানানোর রেওয়াজ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তমন্ত্রণালয় সভায়ও যথাযথ ব্যক্তিরা না গিয়ে তাঁদের অধীনদের পাঠানো হচ্ছে। এ কারণে মাঠ প্রশাসনের আদলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনেও শিগগির যথাযথ ব্যক্তিকে সভায় অংশ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
জানা যায়, প্রতিটি ডিসি সম্মেলনেই মাঠপর্যায়ে এসপিদের অসহযোগিতার বিষয়টি উঠে আসে। কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারেন না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। এবার ডিসি সম্মেলনের পূর্বমুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এসেছে। আজ মঙ্গলবার থেকে চলতি বছরের তিন দিনের ডিসি সম্মেলন শুরু হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এ সম্মেলন উদ্বোধন করবেন। এরপর ২০টি কার্য অধিবেশনে ৩৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা ডিসিদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলবেন।
গত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে একাধিক ডিসি জেলাপর্যায়ের সভাগুলোতে এসপিদের উপস্থিত না থাকার বিষয়ে অভিযোগ করে বলেন, এ সমস্যার কারণে তাঁরা যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ কারণে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে থাকে বলেও ডিসিরা অভিযোগ করেন। সম্মেলনে জেলা প্রশাসকরা আরো বলেন, এসপির অনুপস্থিতিতে তাঁর জুনিয়র বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত যদিও নেওয়া হয়, অনেক সময় পুলিশ সুপার তা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন।
একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, মানসিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক প্রভাবসহ কিছু কারণে ডিসিদের ডাকা সভা এসপিরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ডিসিদের মতো এসপিরাও বিসিএসের একই গ্রেডের কর্মকর্তা। এ ছাড়া অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

No comments

Powered by Blogger.