চারদিক-বিদ্রোহীর জানা-অজানা by অমর সাহা
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কবিতা বিদ্রোহী রচনার ৯০ বছর পার হলো এবার। আর সে উপলক্ষেই এবার ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে পালন করেছে বিদ্রোহী রচনার ৯০ বছর পূর্তি উৎসব। দুই দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে দুই দেশেই আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম উৎসব; সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসহ সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিরা যোগ দেন। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতে উদ্যাপিত হয় বিদ্রোহী রচনার এই ৯০ বছর পূর্তি উৎসব। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের শুরু ৪ জুলাই আর সমাপ্তি ৬ জুলাই।
পশ্চিমবঙ্গে তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবার বিদ্রোহী কবিতাকে নিয়ে আয়োজিত বিশেষ সেমিনার। এতে অংশ নেন কলকাতা আর বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল গবেষকেরা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সাহিত্য একাডেমির কলকাতার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই সেমিনার। আর এই সেমিনারের নজরুল বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় উঠে আসে বিদ্রোহী রচনার নানা জানা-অজানা কথা। আলোচনায় অংশ নেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতার বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার, অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী, নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী, বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী অনুপ ঘোষাল, বাঁধন সেনগুপ্ত, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কবি রশিদ হায়দারসহ কলকাতার বিশিষ্টজনেরা।
সেমিনারে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপিকা ও নজরুল গবেষক সুমিতা চক্রবর্তী তুলে ধরেন নজরুলের ঐতিহাসিক সৃষ্টি বিদ্রোহী রচনার নানা জানা-অজানা কথা। বলেন, নজরুল চিরকালই ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ বিরাট মাপের মানুষ। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের একটি একতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়ায় বসবাস করছিলেন নজরুল। আর এখানেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা বিদ্রোহী। সেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে। লিখেছিলেন পেনসিল দিয়ে। অধ্যাপিকা বলেছেন, সেদিন ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার থাকলেও অধিকাংশ মানুষ লিখত দোয়াত-কলম দিয়ে। বারবার দোয়াত থেকে কালি তুলে। কিন্তু নজরুল কবিতা লিখতে গিয়ে ছন্দের তাল ঠিক রাখার জন্য আর দোয়াত-কলম ব্যবহার করেননি। কারণ, তাতে বারবার কাগজের ওপর কালি-কলম দিয়ে তাল ঠোকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো কবি সেদিন এই বিদ্রোহী কবিতা লিখেছিলেন পেনসিল দিয়ে, যাতে লেখার তাল ও লয় ঠিক রাখা যায়। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর লেখা কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা গ্রন্থে বলেছেন, নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন সম্ভবত শেষ রাতে। কবিতা লেখার পরের দিন ভোরে নজরুল প্রথম কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান কমরেড মুজাফ্ফর আহমদকে। মুজাফ্ফর আহমদ তো কবিতাটি শুনে থ হয়ে যান। বলেন, দারুণ হয়েছে। সকালে তৎকালীন মাসিক মোসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক আসেন কবির কাছে। কবি শোনান তাঁর কবিতাটি। কবিতা শুনে আফজালুল হক জানান, তিনিই প্রকাশ করবেন কবিতাটি। নজরুল দিয়েও দেন। এর পরই এ খবর চলে যায় সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার কাছে। পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছুটে আসেন কবির কাছে। বলেন তিনিও ছাপবেন কবিতাটি। নজরুল বলেন, তিনি তো তা দিয়ে দিয়েছেন মোসলেম ভারত পত্রিকাকে। এরপর অবিনাশ ভট্টাচার্য বলেন, তিনি কবিতাটি ছাপবেন পুনর্মুদ্রিত কপি হিসেবে। কবি তাতে সম্মত হন। দিয়েও দেন কবিতার কপি। কিন্তু কার্যত কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়ে যায় বিজলী পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত কপি হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা বলেন, মাসিক মোসলেম ভারত পত্রিকাটি ছিল অনিয়মিত। এই কবিতা ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় বের হলেও সেই কার্তিক সংখ্যা বিলম্বে, অর্থাৎ প্রকাশ পায় ফাল্গুন মাসে। কিন্তু সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ ছাপা হয়ে যায় কবিতাটি। ফলে প্রথম ছাপার অক্ষরে বিদ্রোহী কবিতা বাজারে আসে বিজলী পত্রিকাতেই। এরপর অবশ্য এই বিদ্রোহী ছাপা হয় মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) এবং ধূমকেতু (১৯২২-এর ২২ আগস্ট) পত্রিকায়। অধ্যাপিকা বলেন, সেদিন এই বিদ্রোহী কবিতাকে অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন সাহিত্যিক অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁরা সবাই ছিলেন নজরুলের প্রিয়জন, বন্ধু।
আর অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার বলেছেন, বিদ্রোহী নজরুলের বিস্ময়কর সৃষ্টি। এই সৃষ্টির আবেদন চিরকালের সীমা অতিক্রম করে গেছে। তিনি দুঃখ করে এ কথাও বলেছেন, ‘আমরা নজরুলকে স্মরণ করি, অনুসরণ করি না। এটাই বড় দুঃখ।’ সেমিনারের সভাপতি প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘নজরুলের সৃষ্টি যেন ম্যাজিকের মতো। মাত্র ২০-২১ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে এত কিছু কীভাবে লিখলেন, তা এখনো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিদ্রোহী তুলনাহীন। অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন নজরুল, আর সেটাই ফুটে উঠেছে বিদ্রোহীতে।’ বাংলাদেশের কবি নুরুল হুদা বলেছেন, কবি নজরুলের অনবদ্য সৃষ্টি বিদ্রোহী। বিদ্রোহীর আবেদন আজ বিশ্বব্যাপী। এই কবি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় আর এখন জাগ্রত আছেন বাংলাদেশে।
অমর সাহা
কলকাতা
পশ্চিমবঙ্গে তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবার বিদ্রোহী কবিতাকে নিয়ে আয়োজিত বিশেষ সেমিনার। এতে অংশ নেন কলকাতা আর বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল গবেষকেরা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সাহিত্য একাডেমির কলকাতার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই সেমিনার। আর এই সেমিনারের নজরুল বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় উঠে আসে বিদ্রোহী রচনার নানা জানা-অজানা কথা। আলোচনায় অংশ নেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতার বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার, অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তী, নজরুলের পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী, বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী অনুপ ঘোষাল, বাঁধন সেনগুপ্ত, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বাংলাদেশের নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কবি রশিদ হায়দারসহ কলকাতার বিশিষ্টজনেরা।
সেমিনারে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপিকা ও নজরুল গবেষক সুমিতা চক্রবর্তী তুলে ধরেন নজরুলের ঐতিহাসিক সৃষ্টি বিদ্রোহী রচনার নানা জানা-অজানা কথা। বলেন, নজরুল চিরকালই ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ বিরাট মাপের মানুষ। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের একটি একতলা বাড়ির নিচতলায় ভাড়ায় বসবাস করছিলেন নজরুল। আর এখানেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা বিদ্রোহী। সেই ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে। লিখেছিলেন পেনসিল দিয়ে। অধ্যাপিকা বলেছেন, সেদিন ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার থাকলেও অধিকাংশ মানুষ লিখত দোয়াত-কলম দিয়ে। বারবার দোয়াত থেকে কালি তুলে। কিন্তু নজরুল কবিতা লিখতে গিয়ে ছন্দের তাল ঠিক রাখার জন্য আর দোয়াত-কলম ব্যবহার করেননি। কারণ, তাতে বারবার কাগজের ওপর কালি-কলম দিয়ে তাল ঠোকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই তো কবি সেদিন এই বিদ্রোহী কবিতা লিখেছিলেন পেনসিল দিয়ে, যাতে লেখার তাল ও লয় ঠিক রাখা যায়। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ তাঁর লেখা কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা গ্রন্থে বলেছেন, নজরুল কবিতাটি লিখেছিলেন সম্ভবত শেষ রাতে। কবিতা লেখার পরের দিন ভোরে নজরুল প্রথম কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান কমরেড মুজাফ্ফর আহমদকে। মুজাফ্ফর আহমদ তো কবিতাটি শুনে থ হয়ে যান। বলেন, দারুণ হয়েছে। সকালে তৎকালীন মাসিক মোসলেম ভারত পত্রিকার সম্পাদক আফজালুল হক আসেন কবির কাছে। কবি শোনান তাঁর কবিতাটি। কবিতা শুনে আফজালুল হক জানান, তিনিই প্রকাশ করবেন কবিতাটি। নজরুল দিয়েও দেন। এর পরই এ খবর চলে যায় সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকার কাছে। পত্রিকার ম্যানেজার অবিনাশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছুটে আসেন কবির কাছে। বলেন তিনিও ছাপবেন কবিতাটি। নজরুল বলেন, তিনি তো তা দিয়ে দিয়েছেন মোসলেম ভারত পত্রিকাকে। এরপর অবিনাশ ভট্টাচার্য বলেন, তিনি কবিতাটি ছাপবেন পুনর্মুদ্রিত কপি হিসেবে। কবি তাতে সম্মত হন। দিয়েও দেন কবিতার কপি। কিন্তু কার্যত কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়ে যায় বিজলী পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত কপি হিসেবে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপিকা বলেন, মাসিক মোসলেম ভারত পত্রিকাটি ছিল অনিয়মিত। এই কবিতা ১৩২৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় বের হলেও সেই কার্তিক সংখ্যা বিলম্বে, অর্থাৎ প্রকাশ পায় ফাল্গুন মাসে। কিন্তু সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ২২ পৌষ ছাপা হয়ে যায় কবিতাটি। ফলে প্রথম ছাপার অক্ষরে বিদ্রোহী কবিতা বাজারে আসে বিজলী পত্রিকাতেই। এরপর অবশ্য এই বিদ্রোহী ছাপা হয় মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) এবং ধূমকেতু (১৯২২-এর ২২ আগস্ট) পত্রিকায়। অধ্যাপিকা বলেন, সেদিন এই বিদ্রোহী কবিতাকে অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন সাহিত্যিক অচিন্ত কুমার সেনগুপ্ত, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁরা সবাই ছিলেন নজরুলের প্রিয়জন, বন্ধু।
আর অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার বলেছেন, বিদ্রোহী নজরুলের বিস্ময়কর সৃষ্টি। এই সৃষ্টির আবেদন চিরকালের সীমা অতিক্রম করে গেছে। তিনি দুঃখ করে এ কথাও বলেছেন, ‘আমরা নজরুলকে স্মরণ করি, অনুসরণ করি না। এটাই বড় দুঃখ।’ সেমিনারের সভাপতি প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘নজরুলের সৃষ্টি যেন ম্যাজিকের মতো। মাত্র ২০-২১ বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে এত কিছু কীভাবে লিখলেন, তা এখনো আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিদ্রোহী তুলনাহীন। অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন নজরুল, আর সেটাই ফুটে উঠেছে বিদ্রোহীতে।’ বাংলাদেশের কবি নুরুল হুদা বলেছেন, কবি নজরুলের অনবদ্য সৃষ্টি বিদ্রোহী। বিদ্রোহীর আবেদন আজ বিশ্বব্যাপী। এই কবি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় আর এখন জাগ্রত আছেন বাংলাদেশে।
অমর সাহা
কলকাতা
No comments