ঋণচুক্তি বাতিলে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত ॥ আর অনুরোধ নয়-০ পদ্মা সেতু বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত -০ বিশ্বব্যাংক নিজে সহায়তা করতে চাইলে গ্রহণ করা হবে
পদ্মা সেতুতে ঋণচুক্তি বাতিল সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বিশ্বব্যাংককে অনুরোধ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে এমন বিবেচনায় নিজে থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে সহায়তা করতে চাইলে সরকার স্বাগত জানাবে। সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিকে বিডি নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা কখনই হবে না- একথা কিন্তু বলিনি। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য এই মুহূর্তে অনুরোধ না জানানো সরকারের এখনকার অবস্থান।
বৈঠক সূত্র বলছে, বিতর্কিত কানাডীয় এসএনসি লাভালিনের পরিবর্তে নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শকের বাছাই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রিসভা নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে। শীঘ্র দরপ্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকের পর মন্ত্রিসভার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, চারভাগ সুদে অনেকেই ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু সরকার আরও কম সুদের হার, তিন ভাগের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে। এখন মূলত এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে দরকাষাকষি হচ্ছে। এই পরিমাণ সুদে ঋণ নিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্ত্রিসভা মনে করছে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই প্রস্তাব যাচাই বাছাই চলছে। তাদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া যায় কিনা বিবেচনা করা হবে। এছাড়া অন্য দাতা সংস্থা যারা রয়েছে তাদের কাছেও সরকার এই প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে ব্রিটেনের হালক্রো গ্রুপকে কাজ দেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রতিষ্ঠানটি যমুনা সেতুতে কাজ করায় তাদের গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সেতু বিভাগের তরফ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, বাস্তবায়নকাল এবং বছরে কত অর্থের প্রয়োজন সে বিষয়ে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয়।
বৈঠকে চার পন্থায় অর্থায়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। অন্য মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে অর্থ সেতু প্রকল্পে আনা, দেশীয় ব্যাংক, বীমা এবং অন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থের সংস্থান এবং প্রবাসীদের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক ছাড়া অন্য দাতাদের কাছে সেতুতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়া হবে।
বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এবং জনকল্যাণ বিবেচনা করে প্রকল্পগুলো বাছাই করা হবে। মন্ত্রণালয়গুলো পৃথকভাবে প্রকল্প বাছাই করবে। যেসব প্রকল্পে পরে অর্থের দরকার হবে ওই অর্থ সেতু প্রকল্পে দেয়া হবে। তিনি বলেন, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতোমধ্যে ব্যাংক, বীমা এবং বেসরকারী উদ্যোক্তারা সেতুতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এই অর্থ নেয়া কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা নির্ধারণ এবং কোন কোন খাত থেকে অর্থ নেয়া যায় তা পর্যালোচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ এবং সেতু বিভাগ সমন্বিত বৈঠক করবে। তবে শুধু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করলে চলবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) সংগ্রহ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রবাসীরা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বছরে আমাদের ১৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে। সেখান থেকে বছরে পদ্মা সেতুর জন্য এক বিলিয়ন ডলার খরচ করলে কোন সমস্যা হবে না। সচিব বলেন, চলতি অর্থবছরে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যয় হবে ২৭৫ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে অন্য উৎস নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও অন্য দাতারা ঋণ দিতে আগ্রহী। তিনি বলেন, সরকার আশা করছে সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের জনগণের এই অভিযাত্রায় দাতারা সম্পৃক্ত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতিতে কোন সঙ্কট সৃষ্টি হবে কি না তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অপর প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে সরকারের কোন ত্রুটি বা দোষ নেই। এ দেশের মানুষ মনে করে, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত অন্যায্য এবং অনৈতিক ছিল। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, দেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি হয়েছে। দেশের মানুষ বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। বিদেশেও মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকার যা করার করবে। তবে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে কি না জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, যা প্রয়োজন করা হবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের কারণে ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সরকার মনে করছে আর দেরি গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই প্রাথমিক অবস্থায় সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে চায়।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। এই সময় ধরেই সব প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় আমরা নিজেদের অর্থেই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করব। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শকের দরপত্র মূল্যায়ন করে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রথমটি ছিল কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন। অন্যগুলো হলো যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ ইউকে, নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একম এ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি হাইপয়েন্ট রেলেন্ড। বিশ্বব্যাংক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে। বিশ্বব্যাংক দাবি করে, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন এবং তাঁর সহযোগীরা এসএনসি লাভালিনকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশায় কাজ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক চীনা ভূয়া প্রতিষ্ঠান ভেনচুরা ইন্টারন্যাশনালকে কাজ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনটি চিঠি দিয়েছে, যা সরকার গ্রহণ করেনি।
সরকারী সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বব্যাংক গত ৫ জুনে লিখিতভাবে তাদের অবস্থান সরকারকে জানায়। এ সময় কতিপয় বিষয়ে সরকারের সম্মতি চায়। সরকারের পক্ষ থেকে ১২ জুনে এই বিষয়ে সরকারের মতামত এবং পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে জাননো হয়। এ সময় চূড়ান্ত আলোচনার জন্য বিশ্বব্যাংকে আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক ২৩ জুন এই বিষয়ে ঢাকায় আলোচনার জন্য একটি দলকে প্রেরণ করে। এই দলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন পৃথক বৈঠক করে। বিশ্বব্যাংক এই সময়ে সরকারের কাছে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) দাবি করে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজের বিষয়ে বিদেশী উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটি টার্মস অব রেফারেন্সে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্মতি দিতে বলে। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং সরকার দেশের সম্মানের কথা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
এসব টানাপোড়েনের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি গত ২৯ জুন বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এরপর এডিবিও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
পদ্মা সেতুর ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে সরকার। এরমধ্যে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। সেতুর অর্থায়নের বিষয়ে সর্বশেষ রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, পদ্মা সেতুর সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা ধরে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত কোন বছরে কত টাকা অর্থায়ন হবে সে পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
বৈঠক সূত্র বলছে, বিতর্কিত কানাডীয় এসএনসি লাভালিনের পরিবর্তে নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শকের বাছাই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রিসভা নীতিগত সম্মতি জানিয়েছে। শীঘ্র দরপ্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। বৈঠকের পর মন্ত্রিসভার এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, চারভাগ সুদে অনেকেই ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু সরকার আরও কম সুদের হার, তিন ভাগের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে। এখন মূলত এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে দরকাষাকষি হচ্ছে। এই পরিমাণ সুদে ঋণ নিয়ে সেতু নির্মাণ করা হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্ত্রিসভা মনে করছে। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই প্রস্তাব যাচাই বাছাই চলছে। তাদের কাছ থেকে অর্থ নেয়া যায় কিনা বিবেচনা করা হবে। এছাড়া অন্য দাতা সংস্থা যারা রয়েছে তাদের কাছেও সরকার এই প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে ব্রিটেনের হালক্রো গ্রুপকে কাজ দেয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রতিষ্ঠানটি যমুনা সেতুতে কাজ করায় তাদের গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে মন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সেতু বিভাগের তরফ থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, বাস্তবায়নকাল এবং বছরে কত অর্থের প্রয়োজন সে বিষয়ে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করা হয়।
বৈঠকে চার পন্থায় অর্থায়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। অন্য মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে অর্থ সেতু প্রকল্পে আনা, দেশীয় ব্যাংক, বীমা এবং অন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থের সংস্থান এবং প্রবাসীদের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করা। এছাড়া বিশ্ব ব্যাংক ছাড়া অন্য দাতাদের কাছে সেতুতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়া হবে।
বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়কে প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন এবং জনকল্যাণ বিবেচনা করে প্রকল্পগুলো বাছাই করা হবে। মন্ত্রণালয়গুলো পৃথকভাবে প্রকল্প বাছাই করবে। যেসব প্রকল্পে পরে অর্থের দরকার হবে ওই অর্থ সেতু প্রকল্পে দেয়া হবে। তিনি বলেন, দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইতোমধ্যে ব্যাংক, বীমা এবং বেসরকারী উদ্যোক্তারা সেতুতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এই অর্থ নেয়া কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তা নির্ধারণ এবং কোন কোন খাত থেকে অর্থ নেয়া যায় তা পর্যালোচনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ এবং সেতু বিভাগ সমন্বিত বৈঠক করবে। তবে শুধু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করলে চলবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে বন্ড ছেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) সংগ্রহ করা হবে। ইতোমধ্যে প্রবাসীরা পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বছরে আমাদের ১৩ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে। সেখান থেকে বছরে পদ্মা সেতুর জন্য এক বিলিয়ন ডলার খরচ করলে কোন সমস্যা হবে না। সচিব বলেন, চলতি অর্থবছরে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণকাজে ব্যয় হবে ২৭৫ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে অন্য উৎস নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক সরে গেলেও অন্য দাতারা ঋণ দিতে আগ্রহী। তিনি বলেন, সরকার আশা করছে সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের জনগণের এই অভিযাত্রায় দাতারা সম্পৃক্ত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতিতে কোন সঙ্কট সৃষ্টি হবে কি না তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অপর প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে সরকারের কোন ত্রুটি বা দোষ নেই। এ দেশের মানুষ মনে করে, বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত অন্যায্য এবং অনৈতিক ছিল। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, দেশের ভাবমূর্তিরও ক্ষতি হয়েছে। দেশের মানুষ বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। বিদেশেও মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। ভাবমূর্তি উদ্ধারের পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকার যা করার করবে। তবে সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে কি না জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, যা প্রয়োজন করা হবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের কারণে ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সরকার মনে করছে আর দেরি গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই প্রাথমিক অবস্থায় সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে চায়।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। এই সময় ধরেই সব প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় আমরা নিজেদের অর্থেই সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করব। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা বজায় রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে ২০১২-১৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ তদারকি পরামর্শকের দরপত্র মূল্যায়ন করে প্রাথমিকভাবে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রথমটি ছিল কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন। অন্যগুলো হলো যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান হালক্রো গ্রুপ ইউকে, নিউজিল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান একম এ্যান্ড এজেডএল, জাপানের ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের জয়েন্ট ভেনচার কোম্পানি হাইপয়েন্ট রেলেন্ড। বিশ্বব্যাংক এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করে। বিশ্বব্যাংক দাবি করে, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন এবং তাঁর সহযোগীরা এসএনসি লাভালিনকে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার প্রত্যাশায় কাজ পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক চীনা ভূয়া প্রতিষ্ঠান ভেনচুরা ইন্টারন্যাশনালকে কাজ দেয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনটি চিঠি দিয়েছে, যা সরকার গ্রহণ করেনি।
সরকারী সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বব্যাংক গত ৫ জুনে লিখিতভাবে তাদের অবস্থান সরকারকে জানায়। এ সময় কতিপয় বিষয়ে সরকারের সম্মতি চায়। সরকারের পক্ষ থেকে ১২ জুনে এই বিষয়ে সরকারের মতামত এবং পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে জাননো হয়। এ সময় চূড়ান্ত আলোচনার জন্য বিশ্বব্যাংকে আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক ২৩ জুন এই বিষয়ে ঢাকায় আলোচনার জন্য একটি দলকে প্রেরণ করে। এই দলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন পৃথক বৈঠক করে। বিশ্বব্যাংক এই সময়ে সরকারের কাছে তিনটি বিষয় নিয়ে সমঝোতা চায়। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) দাবি করে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাজের বিষয়ে বিদেশী উপদেষ্টাদের সঙ্গে একটি টার্মস অব রেফারেন্সে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্মতি দিতে বলে। দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং সরকার দেশের সম্মানের কথা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
এসব টানাপোড়েনের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি গত ২৯ জুন বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এরপর এডিবিও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়।
পদ্মা সেতুর ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে সরকার। এরমধ্যে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। সেতুর অর্থায়নের বিষয়ে সর্বশেষ রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের রূপরেখার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী জানান, পদ্মা সেতুর সম্ভাব্য নির্মাণ ব্যয় ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা ধরে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত কোন বছরে কত টাকা অর্থায়ন হবে সে পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
No comments